মুসলিম ভোটের চেনা সুর এবার প্রশ্নের মুখে: কণাদ দাশগুপ্তর কলম

কণাদ দাশগুপ্ত

‘মুসলিমরা বিজেপিকে পছন্দ করেনা, ভোটও দেয়না৷’

বাংলা-সহ বহু রাজ্যে এই ধারনাই চালু আছে৷ বিজেপি মুসলিম ভোট পায়না, এই ভোট ভাগ হয় বিজেপি-বিরোধী শিবিরে৷ বাংলার বিজেপি-বিরোধী দলগুলিও এটাই ভাবে৷ কিন্তু ২০২১-এর ভোটে এই ধারনা কতখানি বাস্তবসম্মত? বিজেপি- বিরোধী দলগুলির এই ‘নিশ্চিত বিশ্বাস’ এবার অগ্নিপরীক্ষার সামনে৷

দীর্ঘদিন চালু থাকা এই ‘মিথ’ রাজ্যে ভেঙ্গেছে ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে৷ এ রাজ্যে মুসলিম ভোটার বেশি, এমন কেন্দ্রগুলিতে বিজেপি প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোটসংখ্যা অনেকটাই প্রমান করেছে, মুসলিমরাও বিজেপিকে ভোট দিচ্ছেন৷ আর দিনকয়েক আগে মুসলিম অধ্যুষিত নিজামের শহর হায়দরাবাদে যে ফল করেছে বিজেপি, তাতে বোধহয় আরও স্পষ্ট হয়েছে এই ‘মিথ’-এ ভরসা করা আত্মঘাতী হবেই৷

হায়দরাবাদ পুরসভায় বিজেপি
৪ আসন নিয়ে যাত্রা শুরু করে এখন ৪৮ আসন৷ গ্রেটার হায়দরাবাদ মিউনিসিপাল কর্পোরেশন বা GHMC ভোটের ফল দেখার পর এবং একুশের ভোটে যাওয়ার আগে বাংলার বিজেপি-বিরোধী দলগুলির নতুন করে অঙ্ক কষতে বসা উচিত, অবশ্যই নিজেদের স্বার্থে৷ ওই পুরভোটের ফল বলছে, মুসলিম মন জয়ে অনেকটাই সাফল্য পাচ্ছে গেরুয়া শিবির৷ অনেক কিছু প্রমান করার তাগিদ নিয়েই এবার হায়দরাবাদে ভোট করতে নেমেছিলো বিজেপি। একটি পুরসভার ভোট হওয়া সত্ত্বেও রাজ্য নেতাদের উপর আদৌ ভরসা করেনি দিল্লির বিজেপি৷ ঠিক যেমন বঙ্গ- বিজেপির নেতাদের উপর এখনও পর্যন্ত ন্যূনতম ভরসাও করছেন না শাহ-নাড্ডা৷ উত্তরপ্রদেশ থেকে যোগী আদিত্যনাথ-সহ একাধিক ভিনরাজ্যের নেতাকে হায়দরাবাদে ভোট করতে, প্রচার করতে পাঠানো হয়েছিলো৷ বিস্ময়ের বিষয়, নিজামের শহরে প্রচারে গিয়েও নিজস্ব স্টাইলেই হিন্দুত্বের ধ্বজা তুলেছিলেন যোগী। তবুও ফলাফলে দেখা যাচ্ছে মুসলিম ভোট যথেষ্টভাবেই কুড়িয়েছে বিজেপি৷ যোগী দাপটের সঙ্গে ওখানে বলেছেন, এবার নিজামের শহর হায়দরাবাদের নাম বদল করে ‘ভাগ্যনগর’ করা হবে৷ তবুও ভোট পেয়েছে বিজেপি৷ প্রচারে গিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও সরাসরি হিন্দুত্বের বার্তা দিয়েছেন৷ দক্ষিণ বেঙ্গালুরুর বিজেপি সাংসদ তেজস্বী সূর্য প্রচারে গিয়ে বলেছিলেন, ‘‘KCR হায়দরাবাদকে ইস্তানবুল করতে চাইছেন। AIMIM ভারতের হায়দরাবাদকে পাকিস্তানের হায়দরাবাদ করতে চায়। আর আমরা হায়দরাবাদকে ভাগ্যনগর বানাবো, ইস্তানবুল নয়।’’ প্রচারে এ সব বলার পরেও বিজেপি ৪৮ আসন পেয়েছে৷ বিজেপির পাওয়া ওই ৪৮ আসনের পিছনে মুসলিম ভোটের অবদান নিশ্চিতভাবেই
রয়েছে৷ ফলপ্রকাশের পর দেশের রাজনৈতিক মহল ভাবতে বসেছে, এভাবে হিন্দুত্বের জিগির তুলেও হায়দরাবাদে বিজেপি বেনজির এই ফল করেছে কোন রহস্যে ? এই ফল জাতীয় রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি করেছে বললে ভুল বলা হবে না৷

আগামী একুশে দেশের যে চার রাজ্যে ভোট হতে চলেছে, তার অন্যতম পশ্চিমবঙ্গ৷ ভোটের ফল কী হবে, সময় তা বলবে৷ কিন্তু এটা স্বীকার করতেই হবে রাজ্যের শাসক দলকে এখন থেকেই কিছুটা চাপে রেখেছে বিজেপি৷ বিজেপি যথারীতি বাংলার ভোটে হিন্দু-কার্ডই খেলবে৷ তার মোকাবিলায় তৃণমূল-সহ রাজ্যের বিজেপি-বিরোধী দলগুলির অনেকখানি ভরসা ওই মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক৷ কারন, এই দলগুলি যে কোনও কারনেই হোক, আজও ভাবে এবং ভুল করেই ভাবে, মুসলিমরা কখনই বিজেপিকে ভোট দেবে না৷ এ রাজ্যের সংখ্যালঘু মুসলিম ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তাদের প্রতিই ‘কমিটেড’, এমনই মনে করে তৃৃণমূল কংগ্রেস৷ গত লোকসভা ভোটের পরেও তৃণমূল কেন এই ধারনা পোষণ করে, তা রহস্যাবৃত৷ এ রাজ্য এই প্রথমবার কোনও রাজনৈতিক দল, অর্থাৎ তৃণমূল কংগ্রেস ভোট-ময়দানে নেমেছে এক পেশাদার ইলেকশন- স্ট্র্যাটেজিস্ট-এর অধিনায়কত্বে৷ স্ট্র্যাটেজিস্ট যখন আছে, তখন ধরেই নেওয়া যায়, দলটির হোমওয়ার্ক দুর্দান্ত৷ তেমন যদি হয়ে থাকে, তাহলে কোন তথ্যের ভিত্তিতে স্ট্র্যাটেজিস্ট ধারনা করছেন, রাজ্যের মুসলিম ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তাঁর ক্লায়েন্ট- দলের বাক্সেই আসবে, তা বোঝা মুশকিল৷
২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের দু-একটি কেন্দ্রের ফলাফলের দিকে একবার নজর দেওয়া যেতে পারে৷
◾দক্ষিণ মালদহ লোকসভা কেন্দ্র :-
এই কেন্দ্রে ৬৪ শতাংশ ভোটার মুসলিম। কংগ্রেস প্রার্থী পেয়েছেন ৪,৪৪,২৭০ ভোট, (৩৪.৭৩%)৷ বিজেপি পেয়েছে ৪,৩৬,০৪৮, (৩৪.০৯%) এবং তৃণমূলের মুসলিম প্রার্থীর প্রাপ্তি ৩,৫১,৩৫৩, (২৭.৪৭%)৷

◾উত্তর মালদহ লোকসভা কেন্দ্র:- বিজেপির হিন্দু প্রার্থী
পেয়েছেন ৫,০৯,৫২৪ ভোট,(৩৭. ৬১%)৷ তৃণমূলের মুসলিম প্রার্থী পেয়েছেন ৪,২৫,২৩৬ ভোট, (৩১.৩৯%) এবং কংগ্রেসের মুসলিম প্রার্থী পেয়েছেন ৩,০৫,২৭০ ভোট, (২২. ৫৩%)৷

◾জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্র:-
তৃণমূলের মুসলিম প্রার্থী পেয়েছেন ৫,৬২,৮৩৮ ভোট, (৪৩.১৫%)৷ এখানে মুসলিম ভোটার ৮২% এবং বিজেপির মুসলিম প্রার্থী পেয়েছেন ৩,১৭,০৫৬ ভোট (২৪.৩%) এবং কংগ্রেসের হিন্দু প্রার্থী পেয়েছেন ২,৫৫,৮৩৬ ভোট, (১৯.৬১%)৷
এই তিন কেন্দ্র, যেখানে মুসলিম ভোটারই সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেখানে বিজেপি প্রার্থীরা এত বিপুল ভোট কোথা থেকে পেলেন? কারা দিলেন ? কেন পেলেন ? এই তিন কেন্দ্রে শুধু হিন্দুরাই বিজেপিকে প্রায় সাড়ে ১২ লক্ষ ভোট এনে দিলেন ? এমন হতে পারে ? সুতরাং ধরে নেওয়াই যায়, মুসলিম ভোটাররা জেনে বুঝে, সজ্ঞানে বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন৷ ফলে,তৃণমূল সংখ্যালঘু ভোট পেয়ে থাকে, আর বিজেপি হিন্দু ভোট পায়, এই থিওরি ভুলে যাওয়ার সময় এসেছে৷ এবং একইসঙ্গে মাথায় রাখতে হবে হায়দরাবাদ পুরভোটের ফল৷ একুশের বঙ্গভোটে যদি মিম প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করে, তাহলেও বিজেপি ১০ থেকে ১৫ শতাংশ মুসলিম ভোট পাবে। তেমন হলে অনেক হিসাব গুলিয়ে যাবে৷

২০১১-এর আগে প্রতিটি ভোটে দেখা গিয়েছে, মুসলিমরা বামফ্রন্ট বা সিপিএমকে ভোট দিয়েছে। মুসলিম ভোটের কিছু অংশ অবশ্য কংগ্রেসও পেয়েছে। ২০১১-র পর থেকে তৃণমূল ধারাবাহিকভাবেই দাবি করে আসছে, রাজ্যের সংখ্যালঘু ভোটের সিংহভাগ তাদের ঝুলিতে৷ তাই যদি হয়, তাহলে মালদার দুই আসনে তৃণমূল হারলো কেন ? ২০১৯- এর লোকসভা ভোটের ফল বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে, উত্তর দিনাজপুর, মালদহ, মুর্শিদাবাদের সংখ্যালঘুরা এখন বিজেপিকে পছন্দ করছেন।
২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যের মুসলিম ভোট কোন দল পাবে, কেন পাবে এবং ২০১৯-এ কেন তৃণমূল পেলো না, তা নিয়ে পুরোদস্তুর সমীক্ষা নিশ্চয়ই করেছে তৃণমূল৷ প্রার্থীর তথাকথিত যোগ্যতা, কারা প্রার্থী হতে পারেন, কাদের টিকিট দেওয়া হবে না,শুধুই সে সব দেখে বেড়ালে, কাজ অসম্পূর্ণ থাকবেই৷ বিস্তর গবেষণা করে ‘যোগ্যতম’ প্রার্থী না হয় বাছাই হলো, কিন্তু মুসলিম-প্রধান এলাকায় সেই সব প্রার্থীকে জিতিয়ে দেবেন কারা, তার সমীক্ষাও তো বেশি গুরুত্বপূর্ণ à§·

আরও পড়ুন:‘স্বাস্থ্যসাথী’তে আবেদনের ঢল, কার্ডের বদলে বিমাপত্র দেওয়ার ভাবনা নবান্নের!

তৃণমূলকে এবং তৃনমূলের ভোট- বিশেষজ্ঞদের মাথায় রাখতে হবে, এবারের ভোটে মুসলিম ভোট ভয়ঙ্করভাবে কাটাকাটি হবে৷ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম ভোট নিজেদের পক্ষে আনতে তৃণমূলকে লড়তে হবে কংগ্রেস, বাম, বিজেপি, AIMIM, আব্বাস সিদ্দিকির দলের সঙ্গে৷ চোখ-কান খোলা থাকলে বোঝা যায়, মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে আব্বাস সিদ্দিকির জনপ্রিয়তা হু হু করে বাড়ছে৷ ফুরফুরার অন্যান্য পীরজাদাদের একশো হাত পিছনে ফেলে দিয়েছেন এই আব্বাস সিদ্দিকি, এটাই বাস্তব৷ আবার এই পাঁচ শিবিরের কেউ, অন্য কারো সঙ্গে জোট বেঁধে ফেললে, লড়াই কঠিনতম হবে৷ এই লড়াইয়ে তৃণমূলের সাফল্য পাওয়া অসম্ভব না হলেও খুবই কঠিন৷ কারন একটাই, তৃণমূলে গ্রহণযোগ্য মুসলিম নেতার অভাব রয়েছে৷ যে এক-আধজন আছেন, তাদের গত পাঁচ বছর শো-কেস-এ ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে৷ ফলে তাঁদের অতীত ভাবমূর্তির কিছুই আর অবশিষ্ট নেই৷ শূন্য থেকে তাদের শুরু করতে হবে৷ যে সব পীরজাদার ভরসা তৃণমূল করছে, তারা নিজেদের ঘরেই চ্যালেঞ্জের মুখে৷ তাছাড়া, ‘মিম – মিম’ প্রচার চালিয়ে শাসক দলই বাংলায় ওই দলকে একটা আকার দিয়ে দিয়েছে৷ ওয়াইসি সম্পর্কে সাধারণ মুসলিমদের একটা কৌতূহলও তৈরি হয়েছে৷ ওদিকে পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে যথেষ্ট পরিমান মুসলিম ভোট পেয়েছে বিজেপি৷ এবং সবার উপরে তৃণমূলের সর্বস্তরে একটা আত্ম- সন্তুষ্টি কাজ করেই চলেছে যে, ‘মুসলিমরা বিজেপিকে ভোট দেয়না’à§·

এই ‘আত্ম-সন্তুষ্টি’ দীর্ঘজীবী হলে ব্যুমেরাং হওয়ার আশঙ্কা শতকরা একশো ভাগ৷