পয়লা বৈশাখে ময়দানে বারপুজোর সেকাল-একাল, করোনাকালে হারিয়েছে ঐতিহ্য-জৌলুস

বিশেষ প্রতিবেদন: পয়লা বৈশাখ মানে ষোল আনা বাঙালিয়ানা৷ ভোরে কোকিলের ডাক৷ ঘরে ঘরে রবীন্দ্র সংগীত৷ জমিয়ে আড্ডা৷ নতুন পাঞ্জাবি কিংবা তাঁতের শাড়ি৷ দুপুরের মেনুতে মুড়ি ঘন্ট চা-ই চাই৷ সঙ্গে ফুটবল৷ বাঙালির সঙ্গে যার নাড়ির টান৷

মাঠে নেমে হোক কিংবা চার দেওয়ালের গণ্ডিতে, পয়লা বৈশাখে ফুটবল বাঙালির সঙ্গে ছিল, আছে, থাকবে৷ ভ্রমণপিপাসু, খাদ্যরসিকের মতোই ফুটবল পাগলামি বাঙালির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য৷ ফুটবল বঙ্গ জীবনের অঙ্গ৷ বাঙালির রোজনামচা৷

সময়ের হাত ধরে বয়ে গিয়েছে শতাব্দী৷ দেশ-কাল-সময়-রাজনীতি দেখেছে অনেক পরিবর্তন৷ বদলে গিয়েছে রাষ্ট্রের সীমানা, সামাজিক জীবন৷ শুধু বদয়ালনি বাঙালির ফুটবল প্রেম৷ তাই আজও সবুজ গালিচার উপর বাইশ জোড়া পায়ের একটি বলকে নিয়ে সৃষ্ট নানা নান্দনিক ভঙ্গিমা বাঙালি জীবনে হিল্লোল জাগায়৷ তা সে ওল্ড ট্র্যাফোর্ড হোক, সেলটিক পার্ক, ন্যু ক্যাম্প কিংবা ঘরের ধারের যুবভারতী। বাঙালির ফুটবল প্রেম বিশ্বজনীন৷ ফুটবল বাঙালির প্যাশন৷ তাই বাঙালির ময়দানি সংস্কৃতির বাইরেও জায়গা করে নিয়েছে ‘বত্রিশ প্যানেল’৷ বাঙালির গল্প, সাহিত্য, ছড়া, নাটকেও জায়গা করে নিয়েছে ফুটবল৷ বাদ পড়েনি সেলুলয়েড থেকেও৷ এগুলোই বাঙালির ফুটবলপ্রেম জানান দেওয়ার জন্য যথেষ্ট৷ নববর্ষের প্রথমদিনটি এলেই যা আরও বেশি করে ভাবায়৷

বঙ্গ জীবনের এই ফুটবল দর্শন থেকেই একদিন জন্ম হয়েছিল বারপুজোর৷ যেখানে চারদিনের দুর্গাপুজোর থেকে একবেলার বারপুজোর জৌলুস কোনও অংশে কম ছিল না৷ শারদীয়া উৎসবের মতোই বারপুজো কেন্দ্রিক ফুটবল উৎসবও ছিল বাঙালির এক প্রধান ফেস্টিভ্যাল৷ বারপুজোকে ঘিরে ময়দানের ক্লাবগুলিতে ছিল সাজো সাজো রব৷ বিশেষ করে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গেলর বর্ণময় বারপুজো বাঙালির ফুটবল দর্শনকে আলাদা করে চিহ্নিত করেছিল৷

অন্যান্য পুজোর মতোই বারপুজোও সংস্কারাচ্ছ্ন্ন৷ বিশ্বাসও বলা চলে৷ সাবেকিয়ানা ছেড়ে বাঙালি যতই আধুনিক হোক, পয়লা বৈশাখের কিছু মিথ এখনও বঙ্গ জীবনকে আষ্টেপিষ্টে ধরে রেখেছে৷ আপামোর বাঙালির বিশ্বাস, নববর্ষের প্রথমদিনটি যদি ভাল কাটে তাহলে সারা বছর ভাল কাটবে৷ সম্ভবত এই বিশ্বাস থেকেই একদিন জন্ম হয়েছিল বারপুজোর৷ নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত পয়লা বৈশাখের পর শুরু হতো ময়দানের ফুটবল মরশুম৷ তার আগে হয়ে যেত দলবদলের পর্ব৷ তাই বাঙলা বছরের প্রথমদিনটিতে সকলকে সাক্ষী রেখে পুজা অর্চনার মধ্য দিয়ে হতো ধুমধাম করে হতো বারপুজো৷ কালীঘাট থেকে পুরোহিত এসে রীতি মেনে করতেন সেই বারপুজো৷ বারের চারপাশে থাকতো কিছু অতন্দ্র প্রহরী৷ যারা পুজো শেষ না হাওয়া পর্যন্ত বারটিকে পাহারা দিতেন৷ পাছে কেউ বার ডিঙিয়ে না যায়! আসলে বার ডিঙোলে নাকি ক্লাবের পক্ষে তা অমঙ্গল! গোটা গ্যালারি ভরে যেত বারপুজো দেখতে৷

আজও বারপুজো হয়৷ কিন্তু ফুটবলের কক্ষপথে বাঙালির সেই আবেগ এখন অনেকটাই ম্লান৷ আগের মতো ঐতিহ্য আছে, কিন্তু নেই সেই জৌলুস৷ কর্পোরেট ছোঁয়ায় ষোলো আনা বাঙালিয়ানা থেকে বারপুজো এখন অনেকটাই ‘বাংলিশ’৷ তবুও ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সেকালের সেবেকিয়ানা কোথাও যেন বলে যায়, ‘জয় হো বাঙালি, ‘জয় হো পয়লা বৈশাখা’, ‘জয় হো ফুটবল’, ‘জয় হো বারপুজো…৷’

আবার করোনা মহামারির দৌলতে গত বছর বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনে বার পুজোর রীতিতে ছেদ পড়েছিল। মারণ ভাইরাসের জেরে নববর্ষে বন্ধ ঐতিহ্যের বার পুজো। লকডাউন চলায় ছিলেন না কোনও কর্মকর্তা, ফুটবল অনুরাগী কিংবা ফুটবলাররা। ক্লাবগুলোর মূল ফটকের সামনের রাস্তা খাঁ খাঁ করেছে। ছিল না কাঁসর-ঘন্টার আওয়াজ, ফুলের গন্ধ, সানাইয়ের সুর, মানুষের কোলাহল।

বাংলা নববর্ষে চিরাচরিত বারপুজো এবং সাজঘরে কালীমাতার পুজো নিঃশব্দে হয়েছিল মোহনবাগান ক্লাবে।রাজ্য সরকার নির্ধারিত সামাজিক দূরত্বের বিধি মান্য করে। ক্লাবের সদস্য, সমর্থক এবং পদাধিকারীরা কেউই মাঠে উপস্থিত ছিলেন না।

চারদিকে ছড়িয়ে ছিল শুধুই নিস্তব্ধতা…. শুধু রয়েছে শুকনো কিছু ঝরা পাতা আর সেই বোবা ঝরা পাতার বাতাস…নববর্ষের সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, মনের খুশি, মুখের হাসি সবই ছিল কোয়ারেন্টাইনে। বিষাদের সুর, আর এক অসম্ভব শূন্যতায় ময়দানের মন ছিল বড়ই খারাপ…!

ময়দানের ক্লাব কর্তারা ভেবে ছিলেন এবার ফের পুরোনো ঐতিহ্য মেনে বড় করে হবে বারপুজো। কিন্তু পয়লা বৈশাখের আগের করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ছে গোটা দেশজুড়ে। একইসঙ্গে রাজ্যজুড়ে চলছে ভোট। দুইয়ে মিলিয়ে এবারও বারপুজোর সেই জৌলুস ফের ফিকে হতে চলেছে।


 

Previous articleযারা ভোটে হেরে গিয়েছে, তারাই শীতলকুচি নিয়ে পড়ে আছে : দিলীপ
Next articleশঙ্খ ঘোষ করোনা আক্রান্ত, অবস্থা স্থিতিশীল, বাড়িতেই চলছে চিকিৎসা