রবি ঠাকুরের ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, “জীবনযাত্রাটা প্রায় মরণযাত্রা হয়ে উঠেছে”। সৌজন্যে যে করোনা, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর এই করোনার উৎস সন্ধানে তাবড় তাবড় দেশ ও নেতৃবর্গ রীতিমত ক্ষেপে উঠেছে। অবশ্যই এসবের নাটের গুরু হয়ে উঠেছে আমেরিকা। প্রেসিডেন্ট বাইডেন গত 26শে মে এ ব্যাপারে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাকে নির্দেশ দিয়েছেন। কোভিড 19-এর শুরুটা কি মানুষের সঙ্গে সংক্রামিত পশুর সংসর্গ। না কি কোনও ল্যাবরেটরিতে দুর্ঘটনার কারণে। জেমস বন্ডদের এখন কাজ হল আসল কারণ ঠিক কোনটা সেটা খুঁজে বের করা।

ল্যাবরেটরিতে দুর্ঘটনা তত্ত্বের উৎস সন্ধানে

2020 র শেষ দিন। 31 ডিসেম্বর। চিনের উহান শহরে অজানা নিউমনিয়াতে মানুষের আক্রান্ত হওয়ার খবর সামনে আনল হু। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তার পর নতুন বছরের সপ্তম দিনে চিনা কর্তৃপক্ষ সেই খবরে সিলমোহর দিল। জানাল অজানা জ্বরের কারণ, নভেল করোনা ভাইরাস।

ফেব্রুয়ারির 3 তারিখ। নেচার পত্রিকায় জানান হল নব আবিষ্কৃত করোনা ভাইরাসের সঙ্গে বাদুরের করোনা ভাইরাস RaTG 13 র 96.2 শতাংশ জিনগত সাদৃশ্য আছে। ঠিক তার দিন তিনেক পর দক্ষিণ চিনের প্রযুক্তি বিশ্ব বিদ্যালয়ের জনৈক গবেষক একটি গবেষণা পত্রে বেফাঁস বলে ফেলল, উহানের একটি গবেষণাগার থেকে সম্ভবত বেরিয়ে পড়েছে করোনা ভাইরাস।



বিখ্যাত লান্সেট পত্রিকা। সেখানে সাতাশ জন গবেষকের একটি দল জোর দিয়ে বললেন, বন্য প্রাণী থেকেই এই ভাইরাস এসেছে। সেটা প্রমাণ করা যে স্থিরনিশ্চয় ভাবে সম্ভব নয়, সেটা বিজ্ঞানীরা লিখলেন নেচার মেডিসিনের পাতায়।


27 মার্চ আমেরিকার সেনা বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগ জানাল, গবেষণাগারে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ছিল না বলেই যে করোনা ভাইরাস ছড়িয়েছে, সে সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়ার নয়। এপ্রিল মাসের শেষ পাদ থেকে এই তত্ত্বে সিলমোহর দেওয়া শুরু করলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং তাঁর স্বরাষ্ট্র সচিব মাইক পম্পিও।

জুলাই মাসের 4 তারিখ। টাইমস পত্রিকার একটি প্রতিবেদন আলোড়ন ফেলে দিল। 2012 তেই না কি চিনের একটি পরিত্যক্ত তামার খনিতে করোনা ভাইরাসের হদিস মিলেছিল। তার পর না কি তা নিয়ে গবেষণায় বসে উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি।

17 নভেম্বর বায়োএসেজ জার্নালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনও বলল, করোনা ভাইরাসের জিনের গঠন দেখে বোঝা যাচ্ছে এটা গবেষণাগারেই তৈরি।

এই দাবি জোরদার হল 2021এ পৌঁছে। জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি ট্রাম্প প্রশাসন আদাজল খেয়ে লেগে পড়ল চিনের গবেষণাগার থেকে করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি তত্ত্বে।
মার্চের শেষে হু-র সাধারণ সচিব বললেন, অমন সম্ভবনা খুবই কম, তা বলে সেটাকে যে পুরদস্তুর উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে, তা কিন্তু নয়।

অবশেষে গত মে মাসের শেষার্ধ। 23 / 24 তারিখ। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বোমাটা ফাটাল।সেখান থেকে জানা গেল 2019 এর নভেম্বর মাসেই উহানের গবেষণাগারের বিজ্ঞানীরা কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তারও আগে, সেই 2012 তে চিনের তামা খনির ছয় শ্রমিকের মধ্যে এই রোগ দেখা যায়। তাঁদের ফুসফুসের অবস্থা ছিল একেবারে করোনা রোগীদের মতো।

খনি এবং ভাইরাস
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সংবাদ অনুযায়ী, চিনের তামা খনির শ্রমিকদের যখন নিউমোনিয়া হয় তখন তাঁদের ফুসফুসে কোভিড রোগীদের মতো প্যাচ দেখা যায়। উহানের গবেষণাগারের বিজ্ঞানীরা তখন ওই খনিতে বসবাস করে এরকম 276 টি বাদুরের কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে। তাঁরা একটি নতুন ভাইরাসের সন্ধান পান। নাম দেওয়া হয় RaBTCov/4991। 2016 তে তাঁদের সেই নব আবিষ্কৃত ভাইরাসটির কথা বিশ্বকে জানান তাঁরা। এঁরাই 2020 তে RaTG13 ভাইরাসের খোঁজ পেয়েছেন বলে জানান। আরও তিনটি তথ্য তাঁরা দেন। (1) RaBTCov/4991 আর RaTG13 একই ভাইরাস। (2) এই ভাইরাসের সঙ্গে করোনা ভাইরাসের প্রায় পুরোপুরি জিনগত মিল আছে। (3) এই ভাইরাসের কারণে 2012 তে খনি শ্রমিকদের মৃত্যু হয়নি।
কিন্তু উহানের গবেষণাগারের প্রতিবেদনে এত আমতা আমতা করে এসব কথা বলা হয় যে সেকথা একটা জল্পনা উস্কে দেয়। উহানের প্রতিবেদন ও পর্যবেক্ষণ নিয়ে এক দল সংশয় প্রকাশ করেন। তাঁরা বলেন, এই গোটা গবেষণায় স্বচ্ছতার অভাব স্পষ্ট। অন্যদিকে আর এক দল বলতে থাকেন, নির্ঘাত চিনা গবেষকরা RaBTCov/4991 আর RaTG13 কে মিলিয়ে মিশিয়ে, সেইসঙ্গে বাদুর থেকে পাওয়া আরও কিছু ভাইরাস যোগ করে নতুন কোনও টিকা আবিষ্কারের কাজ করছিল। আর তখনই দুর্ঘটনা বশত সেই ভাইরাস গবেষণাগার থেকে বেরিয়ে এসে এরকম বিপত্তি ঘটায়। হু-এর 120 পাতার প্রতিবেদনে ছবিটা স্পষ্ট না হওয়ায় জল্পনা ক্রমে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে।
তারই ফলস্বরূপ বাইডেন যখন বিশ্ব স্বাস্থ্য পরিষদের বৈঠকে জোর গলায় গবেষণাগারের বিভ্রাটে করোনা ছড়ানোর তত্ত্বে জোর দেন তখন চিন ছাড়া আর কেউ সেই দাবির বিরোধিতা করতে এগিয়ে আসেনি। উলটে আরও তেরোটি দেশ আমেরিকার বক্তব্য সমর্থন করে আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলো বিষয়টা খতিয়ে দেখা হোক বলে গলা চড়ায়।
চিনের উল্টো সুর
উহান গবেষণাগার থেকে ভাইরাস বেরিয়ে সারা পৃথিবীতে অতিমারি ছড়িয়েছে, এরকম গুল কেবল আমেরিকাই ছাড়তে পারে। এটাই চিনের সুস্পষ্ট বক্তব্য। উলটে এই অতিমারির দায় আমেরিকার ঘাড়ে চাপায়। সে দেশের দাবি, করোনা ভাইরাস এসেছে আমেরিকার মেরিল্যান্ডের একটি সেনা ঘাঁটি থেকে। নাম, ফোর্ট ডেট্রিক। সেখানেই প্রথম করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা গিয়েছিল।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের এ নিয়ে গোয়েন্দা-তদন্তের নির্দেশেও বেজায় চটেছে চিনের পররাষ্ট্র মন্ত্রক। সেই মন্ত্রকের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান সাফ জানিয়েছেন। চিনের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে আমেরিকা আসলে বুঝিয়ে দিল, তারা বিজ্ঞানের ধার ধারে না, মানুষের জীবন মৃত্যুর পরোয়া করে না। তাই তাদের এসব কার্যকলাপ ভাইরাসের সঙ্গে লড়ার পরিবর্তে উলটো ফল দেবে।
ভারতের অবস্থান
বিবেকানন্দের দুটো ভবিষ্যৎ বাণী ফলে গিয়েছে।
(1) মার্ক্সের মত ছিল, প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হবে শিল্পোন্নত জার্মানিতে। বিবেকানন্দের অনুমান, বিপ্লবের প্রথম কেন্দ্র কৃষি অর্থনীতির দেশ রাশিয়া। বিবেক –বাণী মেনে 1917 তে রুশ বিপ্লব। তার ঢের আগে বিবেকানন্দের মহাপ্রয়াণ ঘটেছে। 1902 তেই।
(2) স্বামীজির ধারণা ছিল, রাশিয়ার পর বিপ্লব হবে চিনে। তাই-ই হয়েছে। মাওয়ের নেতৃত্বে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব।
বিবেকানন্দের তিন নম্বর অনুমান, চিন এশিয়ার বৃহত্তম শক্তি হয়ে ভারতকেও দাবিয়ে রাখবে।
সম্ভবত সে কথা মনে রেখে এবং চিন- ভারত যুদ্ধের দগদগে ঘায়ের কথা স্মরণে রেখেই ভারত করোনা ইস্যুতে আমেরিকার পাশে। মদীয় দেশের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, করোনার উৎস খোঁজার ব্যাপারে হু যে তদন্ত করেছে, সেটা প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ঠিক আছে। তবে সেখানেই না থেমে এ বিষয়ে আরও পর্যায়ক্রমিক তদন্ত হওয়া দরকার।
রবি ঠাকুরের ভাষা একটু এদিক ওদিক করে নিয়ে মোদীর ভারত যেন বলতে চাইছে,
আমার পথে পথে পাথর ছড়ান,
তাই তো তোমার বাণী বাজে
করোনা- ঝরানো।