টিকটক, লাইকি বিগোতে অশ্লীলতা নিয়ন্ত্রণে সরকারের নজরদারি; গ্রুপের অ্যাডমিন চিহ্নিত

খায়রুল আলম, ঢাকা

অনলাইন বা ভার্চুয়াল মাধ্যমে প্রযুক্তি ব্যবহারে যে অপরাধ হচ্ছে তা বন্ধ করতে কঠোর হচ্ছে হাসিনা সরকার । এই ধরনের অপরাধে সারাদেশে তোলপাড় চলছে। উন্নয়নের সঙ্গে পাল্টে যাওয়া অপরাধের ধরনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে হাতিয়ার বানিয়ে চলছে এই ধরণের অপরাধ। টিকটক-লাইকির সঙ্গে ইমো, বিগো, মাইস্পেস, ফেসবুক, ইউটিউব, স্ট্রিমকার, হাইফাইভ, বাদু ইত্যাদি অ্যাপে কঠোর নজরদারির সিদ্ধান্ত নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। একই সঙ্গে অপরাধীদের তালিকা তৈরিও চলছে জোরকদমে ।

জানা গিয়েছে, টিকটক-লাইকি সিন্ডিকেটের অন্তত ৪০টি গ্রুপের সন্ধান পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এই ৪০টি গ্রুপে কাজ করছে ৫ শতাধিক তরুণ-তরুণী। এসব গ্রুপের সদস্যরা নারী পাচার, কিশোর গ্যাং, যৌন হয়রানি, যৌন নিপীড়ন, তোলাবাজি, ছিনতাই-রাহাজানি থেকে শুরু করে হত্যাকাণ্ডের মতো বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। রাজধানী ঢাকা ছাড়াও দেশের বিভিন্নস্থানে তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে এসব অপরাধ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে অশ্লীল ভিডিও, কুরুচিপূর্ণ ও অসামাজিক অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করছে সিআইডি, র‌্যাব, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ সদস্যরা ।

টিকটক ও লাইকির মাধ্যমে তরুণ-তরুণীদের আকৃষ্ট করে প্রলোভনের টোপে ফেলে পাচার করার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার বিষয়টি সরকারের উচ্চ পর্যায়ে মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে । নারী পাচারের ঘটনাগুলির বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বিশেষ অভিযান চালাচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে। ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অশ্লীল ভিডিও তৈরিতে জড়িত লাইকি ও টিকটকের সিন্ডিকেটের এইসব গ্রুপের সন্ধান পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

তরুণ-তরুণীদের অশ্লীল ও উদ্ভট ভঙ্গিমার দৃশ্য ধারণ করে বানানো হচ্ছে টিকটক-লাইকির কনটেন্ট। পরে অ্যাপ ব্যবহার করে এসব প্রচার করা হচ্ছে। এসব লাইকি ও টিকটক তৈরির ক্ষেত্রে প্রতিটি গ্রুপের একজন অ্যাডমিন থাকে। সেই অ্যাডমিনের প্রতিটি গ্রুপে ১০ থেকে ১৫ জন তরুণ-তরুণী জড়িত। এ পর্যন্ত যে ৪০টি গ্রুপের সন্ধান পাওয়া গেছে তাতে পাঁচ শতাধিক তরুণ-তরুণী জড়িত থাকার তথ্য মিলেছে। লাইকি ও টিকটকের এসব অশ্লীল ভিডিও দেখে তরুণ-তরুণীসহ শিশুরা বিপথে যাচ্ছে।

এ অবস্থায় ওই সব টিকটক ও লাইকি নির্মাণকারী এবং এসব প্ল্যাটফর্মে অভিনয়কারীদের শনাক্ত করতে মাঠে নেমেছে পুলিশ ও র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)সহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জেই লাইকি ও টিকটক গ্রুপের সংখ্যা বেশি। সম্প্রতি তা প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে। গাজীপুরে টিকটক-লাইকি বানানোর জন্য একদল তরুণী ভাড়ায় পাওয়া যায়। তারা নিয়মিত এসব অশ্লীল ভিডিওতে কাজ করে। প্রতিটি কনটেন্টের জন্য তারা এক থেকে দুই হাজার টাকা নিয়ে থাকে। টিকটক-লাইকি তৈরির জন্য তরুণীদের আলাদা গ্রুপ রয়েছে। অল্প টাকা দিয়ে তাদের অভিনয় করানো যায় বলে ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গিয়েছে ।

র‌্যাব সূত্রে জানা গিয়েছে, টিকটক অ্যাপ ব্যবহার করে তৈরি হচ্ছে টিকটক হৃদয়, অপু, সজীব, নয়ন বন্ড, সুজন ফাইটারের মতো অপরাধীরা। এসব কিশোর গ্যাং যৌন হয়রানি, যৌন নিপীড়ন, তোলাবাজি, ছিনতাই-রাহাজানি থেকে শুরু করে হত্যাকাণ্ডের মতো বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। অনলাইনভিত্তিক এসব গ্যাং কালচার রোধে সাইবার নজরদারি করা হচ্ছে। পৃথিবীর কোন কোন দেশে টিকটক-লাইকির মতো অ্যাপ বন্ধ করেছে এবং করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, সেগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইসিটি মন্ত্রণালয়ে আলাপ আলোচনা ও বৈঠক হয়েছে।

টিকটক অপু (ইয়াসিন আরাফাত অপু) গত বছরের ২ আগস্ট ঢাকার উত্তরায় কয়েক বন্ধুসহ সড়ক বন্ধ করে দিয়ে টিকটক তৈরির জন্য ভিডিও করে আলোচনায় এসে তোলপাড় সৃষ্টি করে। সেখানে একজনের গাড়ি আটকে যায়। পরে তার সঙ্গে অপুর মারামারির ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে উত্তরা পূর্ব থানায় সেই গাড়িচালকের করা মামলায় গ্রেফতার হয় অপুকে। তার তৈরি করা সেই টিকটক ভিডিওতে দেখা যায় রঙিন চুল ঝাঁকিয়ে অপু বলছে ‘নামটা শুধু মনে রেখো, অপু বাই…।’ এটুকু বলে আরেকটা হাসি দেয়। এভাবেই ছোট্ট ভিডিওর মাধ্যমে তৈরি হয়ে যায় টিকটক আইটেম।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, টিকটক নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করছে। টিকটক অ্যাপ বন্ধের কাজটা করবে আইসিটি মন্ত্রণালয়। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তা বন্ধ করতে কোনও নির্দেশ এখনও দেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্তও হয়নি। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে যাদের চিহ্নিত করা গেছে, তাদের আইনের আওতায় আনার কাজ চলছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের এক কর্তা বলেছেন, লাইকি-টিকটক সুস্থ কোনও বিনোদন হতে পারে না। এগুলো বন্ধ করার সময় এসেছে। যারা এগুলো চালাচ্ছে, তাদের আমরা খুঁজে বের করছি। আমরা তদন্তে নেমে এরই মধ্যে আট জনকে গ্রেফতার করেছি। র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের প্রধান খন্দকার আল মঈন বলেছেন, টিকটক-লাইকির নামে যারা অশ্লীল ভিডিও তৈরি করছে, তাদের বিষয়ে তথ্য নেওয়ার জন্য দেশের সব ব্যাটালিয়নকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এসবের সঙ্গে জড়িতদের তালিকা করা হচ্ছে। তথ্যদাতাদের নাম-পরিচয় গোপন রাখা হবে বলে জানিয়ে সাধারণ মানুষকে সাহায্য করার আবেদন জানানো হয়েছে ।

Previous articleগ্রেফতার তদন্তের অংশ হলেও তদন্ত শেষে গ্রেফতারি বেআইনি, হাইকোর্টে তোপ লুথরার
Next articleআফগানিস্তানের বিরুদ্ধে তিন পয়েন্টের লক্ষ‍্যে নামছে ইগর স্টিমাচের দল