লর্ড মাউন্ট ব্যাটন ১৫ অগাস্ট দিনটিকে বেছে নিয়ে ভারতকে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করেন।দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর এই একইদিনেই জাপান মিত্রশক্তির কাছে হার মানে। তাই ১৫ অগাস্ট দিনটিকে বেছে নেন ব্রিটিশ সরকার। তবে ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট দেশ স্বাধীন হলেও তখন ভারতের নিজস্ব কোনও সংবিধান ছিল না। ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচিত হয়। সেইসময় ভারতের সংবিধান রচয়িতারাই সিদ্ধান্ত নেন যে, স্বাধীনভারতের প্রজাতন্ত্র হয়ে ওঠা কোনও একটি বিশেষ দিনে পালন করা উচিত। এরপরেই ২৬ জানুয়ারি দিনটিকে বেছে নেওয়া হয়।এরপর ১৯৫০ সাল থেকে পালন করা শুরু হয় প্রজাতন্ত্র দিবস।
সাল ১৯৫১ । সংসদে গঠিত হলো ভারতের নির্বাচন কমিশন । কিন্ত কাকে এর মাথায় বসানো যায় ? বিস্তর আলোচনার পর ঠিক হলো পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চিফ সেক্রেটারিকে নিয়োগ করা হোক এই পদে । আপাদমস্তক বঙ্গসন্তান এই মানুষটি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অঙ্কে গোল্ড মেডেল পাওয়া স্নাতক এবং1921 ব্যাচের ICS ।
নিয়োগপত্র পাবার একমাস পরেই নেহেরুজী একদিন ডেকে পাঠালেন তাকে । বললেন সামনের বছর মার্চ মাসেই দেশ জুড়ে নির্বাচন করাতে হবে, কোন অবস্থাতেই আর দেরী করা যাবেনা !

১৯৪৭ সালের ২৮ অগাস্ট ভারতের একটি স্থায়ী সংবিধান রচনার জন্য ড্রাফটিং কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন বিআর আম্বেদকর।১৯৪৭ সালের ৪ নভেম্বর একটি খসড়া সংবিধান প্রস্তুত করে গণপরিষদে জমা দেয়। চূড়ান্ত সংবিধান গৃহীত হওয়ার আগে ২ বছর ১১ মাস ১৮ দিন ধরে গণপরিষদ এই খসড়া সংবিধান আলোচনার জন্য ১৬৬ বার অধিবেশন ডাকে। এই সকল অধিবেশনে জনসাধারণের প্রবেশের অধিকার ছিল। ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর স্বাধীন ভারতের সংবিধান গৃহীত হয়। এরপরেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারীর ওই দিনকে সম্মান জানিয়ে ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতের সংবিধান কার্যকর হবে। এবং সেদিন থেকে প্রজাতান্ত্রিক ভারতবর্ষ পরিচিতি পাবে। অবশেষে বহু বিতর্ক পেরিয়ে একাধিক সংশোধনের পর ২৪ জানুয়ারি ১৯৫০ সালের ৩০৮ জন সদস্য চূড়ান্ত সংবিধানের হাতে লেখা দুটি নথিতে স্বাক্ষর করেন। এরপর দেশব্যাপী সংবিধান কার্যকর হতেই ২৬ জানুয়ারিতেই প্রজাতন্ত্র দিবস পালন করা হয়।
কাজটা মোটেই সহজ ছিল না। এ দেশের ৮৫ শতাংশ মানুষের তখন অক্ষর জ্ঞানটুকুও ছিলো না ।
লোকসভা ও বিধানসভা মিলিয়ে প্রথম নির্বাচনে দেশব্যাপী ৪৫০০ আসন ঠিক হয়েছিল, ব্যালট বক্স লেগেছিল ২০ লক্ষ আর ভোট কেন্দ্র হয়েছিল ২ লক্ষ ২৪ হাজার টি । কিভাবে ভোট দিতে হবে এটা মানুষকে বোঝাতে বিভিন্ন ভাষায় ৩ হাজার সিনেমা তৈরি হয়েছিল। আকাশবাণী তিনমাস লাগাতার রেডিওতে বর্ণনা দিয়েছিল পুরো বিষয়ের।
ভোটার লিস্ট তৈরি করতে হিমশিম খেতে হয়েছিল। সেসময় গ্রামের দিকে মহিলারা পরপুরুষকে নিজের নাম বলতে লজ্জা পেত । ফলে লিস্ট তৈরির পর দেখা গেল, তাতে লেখা রামের মা বা শ্যামের বউ ! রেগে গিয়ে উনি ২৮ লক্ষ মহিলার নাম বাদ দিলেন । সমাজতত্ত্ববিদদের মতে এতে করে তিনি সমাজের উপকারই করেছিলেন । কারণ, পরের নির্বাচনে এরা সবাই প্রকৃত নাম দিয়ে নিজেদের গণতন্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিল ।
প্রথম নির্বাচনে তিনি প্রতিটি দলের জন্য পৃথক ব্যালট বাক্সের ব্যাবস্থা করেছিলেন । বাক্সের ওপর প্রার্থীর প্রতীক চিহ্ন সাঁটা থাকতো । বাক্স গুলো যত্ন করে রেখে দেওয়ার ফলে ১৯৫৭ সালের নির্বাচনে বিশাল অঙ্কের খরচ বেঁচে গিয়েছিল। প্রসঙ্গত, সেবারেও তিনি Chief Election Commissioner ছিলেন । সাফল্যের সাথে পরপর দুবার এতবড় দেশে নির্বাচন করানোর জন্য রাষ্ট্রসংঘের তরফে তাঁকে সুদানে নির্বাচন পর্যবেক্ষক করে পাঠানো হয়েছিল ।

এতবড়ো একটা সাফল্যের পরও ১৮৯৮ সালে বর্ধমানে জন্ম এই বঙ্গসন্তানকে দেশ তাকে স্বীকৃতি স্বরূপ দেশের প্রথম পদ্মবিভূষণ দিয়েই দায় সেরেছে !
ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ আফসোস করে বলেছেন,
‘the man who had to make the election possible, a man who is an unsung hero of Indian democracy. It is a pity we know so little about him. He left no memoirs and, it appears, no papers either’. It is sad that a man of such distinct intelligence and integrity has slipped from public memory.”
প্রতি বছর ২৫ জানুয়ারি দিনটি পালন করা হয় জাতীয় ভোটার দিবস হিসাবে। অথচ সারাদিনে একবারও উচ্চারিত হয় না এই বঙ্গসন্তানের নাম। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হওয়ার পর তিনিই প্রথম উপাচার্য পদে বসেন । তার পরের দুইভাইও ছিলেন খ্যাতনামা। মেজভাই ছিলেন বিখ্যাত আইনজীবী ও কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী অশোক সেন । ছোটভাই ডাক্তার অমিয় সেন ছিলেন শান্তিনিকেতনে কবিগুরুর চিকিৎসক, যিনি শেষসময়ে কবির পাশে ছিলেন ।
স্মরণীয় মানুষটি নাম জানেন? তিনি হলেন শ্রদ্ধেয় সুকুমার সেন , দেশের প্রথম চিফ ইলেকশন কমিশনার ।
আজ সাধারণতন্ত্র দিবসে ভারতের গণতন্ত্রের ভিত্তিমূল স্থাপন করা মানুষটিকে আমাদের প্রণাম।

