Friday, November 28, 2025

প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে পদত্যাগ করলে কী হতে পারে শ্রীলঙ্কার ভবিষ্যৎ?

Date:

Share post:

শ্রীলঙ্কায় প্রাসাদ ছেড়ে সদ্য পালিয়ে যাওয়া প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষকে একসময় সিংহলিরা ভালোবেসে ‘টারমিনেটর’ বলতেন। তামিলদের বিদ্রোহকে ধুলায় মিশিয়ে দিয়ে গোতা এই ভালোবাসা পেয়েছিলেন। কিন্তু এক যুগ পর সেই টারমিনেটরকে চোরের মতো লুকিয়ে প্রাসাদ ছেড়ে পালাতে হয়েছে। তার আগে মাহিন্দা ও বাছিলকেও তাড়িয়েছে জনতার চাপ। শ্রীলঙ্কায় বিতর্কের পাশাপাশি নতুন প্রশ্নও উঠেছে—সামনের রাজনৈতিক প্রশাসন কী আদল নেবে? ডলার ও জ্বালানি কোথা থেকে আসবে? কখন আসবে? তাড়ানোর মতো আর তো কোনও টার্গেট নেই।

মধ্যবিত্ত যে এখনও নাগরিক অভ্যুত্থানের সামর্থ্য রাখে, সেটাই কলম্বোর ছাত্রছাত্রী আর আইনজীবী সংগঠনগুলো দেখালো। গত সপ্তাহেও এদের মিছিলে মাত্র কয়েক শ লোক হতো। কিন্তু এরা কেউ মাঠ ছেড়ে যাননি। শেষ পর্যন্ত জনতাকে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে ঢোকাতে পেরেছেন তারা।

প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার মতোই প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমেসিংহকেও হয়তো বিদায় নিতে হবে যে কোনও দিন। তাঁর শক্তির উৎস রাজাপক্ষে। তাদের উৎপাটনে তাঁরও পায়ের তলায় মাটি সরে গিয়েছে। গোতাবায়া খলনায়ক হিসেবে বিদায় নিয়েছেন। রনিল সেই মর্যাদাও পাবেন না। তাঁর বিদায়ে করুণা করে উল্লাসও করা হবে না বলে মনে হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট পদত্যাগ না করা পর্যন্ত প্রধান্ত্রমন্ত্রীকে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব চালিয়ে যেতে হবে অন্তত এক মাস। তবে আপাতত গোতার মতোই রনিলেরও রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ পর্যায়ে।
শনিবার সন্ধ্যা থেকে শ্রীলঙ্কাজুড়ে আলোচনার প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে পরবর্তী প্রশাসনিক নেতৃত্ব। দেশটিতে ক্ষমতার উৎস প্রেসিডেন্ট। সেই পদে কে আসবে এবং তিনি ধ্বংসের কিনারা থেকে দেশকে কীভাবে বাঁচাবেন, সেটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন।

গোতা পলাতক অবস্থা থেকে পদত্যাগপত্র পাঠালে সম্ভাব্য নেতা হিসেবে আসতে পারেন প্রধান বিরোধী দল ‘সঙ্গী জন বালাওয়েগা’র সজিথ প্রেমাদাসা, সাবেক সেনাপ্রধান শরৎ ফনসেকা এবং জেভিপির অনুঢ়া কুমার দেশনায়েকে প্রমুখ। এঁদের বাইরের কেউও প্রেসিডেন্ট হতে পারেন। পার্লামেন্টের স্পিকারের নামও ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে আসছে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও লাগবে কাউকে। তবে সব ক্ষেত্রে জেভিপি ও সঙ্গী জন বালাওয়েগার সমর্থন লাগবে। কারণ, জনতার কাছে এখন শুধুমাত্র এই দুই রাজনৈতিক দলের কিছু প্রভাব রয়েছে। তবে নতুন সরকারের জন্য এদের চেয়েও জরুরি হলো সেই ছাত্র-তরুণদের সম্মতি, যারা গত পাঁচ মাস রাজপথে পড়ে ছিল রাজাপক্ষেদের তাড়াতে। নতুন সরকারকে তাদের চাওয়া-পাওয়া পূরণ করতেই হবে। না হলে তারা আবার রাস্তায় নামবে। এই তারুণ্য চাইছে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার ব্যাপক বিকেন্দ্রীকরণ। তারা রাজাপক্ষেদের পাচারকৃত সম্পদ ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়ে রেখেছে। সর্বোপরি তারা দেশটির এত দিনকার চমক দেখানো উন্নয়ন-রাজনীতির বদলও চাইছে।

গোতাবায়ার পলায়ন এবং রনিল বিক্রমাসিংহের সম্ভাব্য বিদায় চিন ও ভারত—উভয়ের জন্য বিমর্ষ হওয়ার মতোই ঘটনা। প্রথমজনকে চিন অনেক মদত দিয়েছিল এবং দ্বিতীয়জনকে বহুকাল নয়াদিল্লি শক্তি জুগিয়ে যাচ্ছে। এঁরা উভয়ে সিংহলি কুলীন রাজনীতির দুই প্রতিভূ। শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনী অতি পরিণত মানসিকতার পরিচয় দিয়েছে ৯ জুলাই প্রেসিডেন্টকে পালাতে দিয়ে বা লুকিয়ে ফেলে। এর বিকল্প হতো চরম রক্তপাত।

সিংহলি সামরিক আমলাতন্ত্র দূরদর্শী সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে নিজেকে রক্ষা করল এবং ভবিষ্যতের জন্য নিজেদের রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখল। কিন্তু তাদের রাজনৈতিক ভিত্তি যে উগ্র জাতীয়তাবাদ, সেই পাটাতন অনেকখানি সরে গেছে। ৯ জুলাইয়ের আগের এবং পরের শ্রীলঙ্কা অবশ্যই আর আগের মতো থাকবে না। সিংহলি তরুণ-তরুণীরা ইতিমধ্যে এই উপলব্ধির প্রকাশ ঘটিয়েছে—গৃহযুদ্ধকালে তামিলদের প্রতি অবিচার করা হয়েছে।

পালানোর আগের দিন হাস্যকরভাবে পুতিনের সঙ্গে টেলিফোন আলাপ করে হয়তো গোতা নিজের রাজনৈতিক আয়ু আরও কমিয়ে ফেলেছিলেন। তবে আমেরিকাকে এখন সম্ভাব্য সরকারের পেছনে শক্তভাবে দাঁড়াতে হবে। যদি সে রকম কোনও সরকার শ্রীলঙ্কার পরিবর্তনবাদী মানুষ শিগগিরই গঠন করতে পারে।
প্রেসিডেন্টকে তাড়ানোর উল্লাস শেষ হলেই শ্রীলঙ্কার প্রত্যেক নাগরিকের জন্য দুঃখজনক এবং নির্মম এক অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছে গতকালের মতোই আগামীকাল থেকে। তাদের রান্নার জ্বালানি নেই, বিদ্যুতের অভাবে অফিস-আদালত চলছে না, ওষুধ নেই হাসপাতালে, স্কুল–কলেজ বন্ধ, ডলারের অভাবে পণ্য আমদানি করা যাচ্ছে না।

বলা বাহুল্য, বিপুল সহায়তা দরকার দেশটির। ভারত ও চিন নতুন সরকারকে সামান্যই সহানুভূতি দেখাবে এখন। ওয়াশিংটনের সবুজসংকেত পেলে আইএমএফ এবার তার প্যাকেজ নিয়ে হাজির হতে পারে। পাকিস্তানে নতুন সরকারের অর্থমন্ত্রী ইতিমধ্যে আইএমএফের সঙ্গে সফলভাবে চুক্তি হয়ে দেশটিকে দম নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। গোতার নির্বাসনও শ্রীলঙ্কার জন্য সেই রাস্তাই হয়তো সুগম করবে। তবে এ–ও সত্য যে আইএমএফের অর্থনৈতিক সংস্কার প্রস্তাবে নাগরিক জীবনের জন্য কষ্টকর এক অধ্যায়ের অনিবার্যতা আছে—কিন্তু আজ থেকে ঘুম ভাঙার পর শ্রীলঙ্কার কাউকে ব্যর্থ পরিবারতন্ত্রের ঔদ্ধত্য অন্তত আর দেখতে হবে না।

 

 

spot_img

Related articles

সুকুমার সৃষ্টিসমূহের উপর কেন্দ্রীয় প্রচারের স্পটলাইট, হুঁকোমুখো হ্যাংলা- কুমড়োপটাশদের নিয়ে প্রকাশিত পোস্টকার্ড

বাস্তবে তারা থাক বা না থাক, কিন্তু সুকুমার সাহিত্যে তাদের অবাধ বিচরণ। 'ট্যাঁশ গরু' কিংবা 'কুমড়োপটাশ'দের চেনে না...

হাওড়ার গুলি-কাণ্ডের সিসি ক্যামেরা ফুটেজ প্রকাশ্যে, দুষ্কৃতীর সন্ধানে চলছে তল্লাশি

প্রকাশ্যে হাওড়ার গুলি-কাণ্ডের সিসি ক্যামেরা ফুটেজ (CC Camera Footage)। হাওড়ার (Howrah) বালিতে তৃণমূলের (TMC) পঞ্চায়েত প্রধান দেবব্রত মণ্ডল...

ঘরের মাঠেই শুরু হরমনপ্রীতদের টি২০ বিশ্বকাপের প্রস্তুতি, প্রতিপক্ষ কারা?

বিশ্বকাপ জয়ের রেশ কাটিয়ে মাঠে  নামছে ভারতীয় মহিলা(India women) দল। একদিনের বিশ্বকাপ জয়ে পর এবার মিশন টি২০-র খেতাব।...

নিজেদের সঙ্গে মিলিয়ে মেয়ের নাম রাখলেন সিদ্ধার্থ-কিয়ারা, শেয়ার করলেন প্রথম ঝলক

চলতি বছরই বাবা-মা হয়েছেন সিদ্ধার্থ মালহোত্রা (Siddharth Malhotra) ও কিয়ারা আডবানি (Kiara Advani)। মেয়ের জন্মের পর থেকেই তাকে...