‘কাতারে কাতারে ফুটবল’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

‘ আমি নিজে ইউরোপের নাগরিক। তা সত্ত্বেও বলতে দ্বিধা নেই, গত তিন হাজার বছর ধরে আমরা ইউরোপীয়রা গোটা বিশ্বে যা করেছি, তার জন‍্য তিন হাজার বছর ধরে ক্ষমা চাওয়া উচিত। তার পরে অন‍্যকে নৈতিকতার পাঠ দেওয়ার চেষ্টা করা উচিত। আমি মনে করি, সর্বকালের সেরা বিশ্বকাপ আয়োজনের জন‍্য তৈরি কাতার। ‘
কথাগুলো কে বলছেন?
বলছেন ফিফা প্রেসিডেন্ট জিয়ান্নি ইনফান্টিনো।
কোথায় বলছেন?
বিশ্ব ফুটবলের সেরা প্রতিযোগিতার বোধনের চব্বিশ ঘন্টা আগে গোটা বিশ্বের সাংবাদিকের সামনে এই বিস্ফোরক বক্তব্য রাখলেন উনি।
কেন তাঁকে বলতে হলো এমন কথা?
কাতারকে নাকি বিশ্বকাপ ফুটবলের দায়িত্ব দেওয়া উচিত হয় নি, এই দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, এমনকি স্টেডিয়ামের ভেতরে ও বাইরে মদ‍্যপান নিষিদ্ধ করা হয়েছে, এমন সব অভিযোগ লাগাতার ক’রে চলেছিলেন ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার ফুটবলপ্রেমীরা এবং সাংবাদিকেরাও। সাংবাদিক সম্মেলনে সেইসব অভিযোগের বারুদঠাসা জবাব দিলেন ফিফা প্রেসিডেন্ট। গোটা বিশ্বের বিরুদ্ধে গিয়ে আয়োজক কাতারের পাশে দাঁড়ালেন।

এই গনগনে আঁচের মধ‍্যেই শুরু হলো বিশ্বকাপ ফুটবল ২০২২- এর উদ্বোধনী ম‍্যাচ।
আয়োজক দেশ কাতার বনাম ইকুয়েডর। এই ম‍্যাচে নাকি গড়াপেটা হবে এমন গুজব ছিল। বার্তা রটি গেল ক্রমে…
গড়াপেটা যে একেবারেই হয় না তা নয়। তাব’লে বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম‍্যাচেই গড়াপেটা? ম‍্যাচ ছেড়ে দেওয়ার জন‍্য কাতার নাকি ইকুয়েডর ফুটবলারদের ৭.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঘুষের প্রস্তাব দিয়েছে। এ তো
মারাত্মক কথা! তাহলে তো ম‍্যাচটা দেখতেই হয়। কিন্তু, কী দেখা গেলো? ম‍্যাচের শুরু থেকেই ক্রমাগত আক্রমণ করতে করতে ১৬ মিনিটে পেনাল্টি পেলো ইকুয়েডর। গোল করলেন ভ‍্যালেন্সিয়া।

দ্বিতীয় গোলও এলো প্রথমার্ধেই। সেই ভ‍্যালেন্সিয়া। তুখোড় বুদ্ধি ও তীব্র গতি এই খেলোয়াড়টির। কাতারও খারাপ খেলে নি। ফলাফল : ইকুয়েডর ২ —- ০ কাতার।
কোথায় গটআপ? কোথায় ঘুষ? কোথায় গড়াপেটা? প্রাণবন্ত ও নির্মল ফুটবল। একেবারে খাঁটি, বিশুদ্ধ। এই হচ্ছে বিশ্বকাপ। দ‍্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ। মনে পড়ে সেই বিখ্যাত উক্তি : ফুটবল বলতে যারা শুধু ফুটবলকেই বোঝে, তারা ফুটবলের কী-ই বা বোঝে!

দ্বিতীয় খেলা ২১শে নভেম্বর ভারতীয় সময় সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টায়। ইরান বনাম ইংল‍্যান্ড। ঘটনাবহুল ম‍্যাচ। ইংল‍্যান্ড ইরানকে ছ’গোল দেবে এটা কোনো বড়ো কথা নয়, কিন্তু ইরান ইংল‍্যান্ডের জালে দু’দুবার বল ঢোকাবে এটা দেখার জন‍্যই বেঁচে থাকা এত ঐশ্বর্যময়। অশান্ত ইরান। মাশা আমিনির মৃত্যুর পর থেকেই ‘ হিজাব দহন ‘ চলছে এই দেশটিতে। এই আন্দোলন এখন প্রায় গণ অভ‍্যুত্থানের চেহারা নিতে চলেছে। বিক্ষোভ ও বিদ্রোহের আগুন জ্বলছে সেখানে। রক্ষণশীল শাসকগোষ্ঠীর পেশিশক্তির হাতে নিহত হচ্ছেন প্রতিবাদীরা। সেই ইরান দু’দুটো গোল করলো ইংরেজদের বিরুদ্ধে। এমনকি দেশে ফিরে শাস্তির মুখে পড়তে হবে জেনেও ফুটবলারদের কেউই দেশের জাতীয় সঙ্গীতে গলা মেলালেন না। এও এক অভিনব প্রতিবাদ। ইরানে এখন যেন স্বাধীনতা যুদ্ধ চলছে। এদিকে আবার এই ম‍্যাচের শুরুতেই বিপক্ষের আক্রমণ রুখতে গিয়ে ইরানের প্রধান গোলরক্ষক নিজের দলেরই এক ফুটবলারের সঙ্গে প্রচন্ড সংঘর্ষে মারাত্মক আহত ও রক্তাক্ত হয়ে মাঠ ছাড়তে বাধ‍্য হলেন। নামতে হলো দ্বিতীয় গোলরক্ষককে। তারপরও ইরানের এই লড়াই অবশ্যই প্রশংসনীয়।

তৃতীয় ম‍্যাচ নেদারল্যান্ডস বনাম সেনেগাল। ব্রাজিলের ‘ জোগো বনিতো ‘ অর্থাৎ সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন ফুটবল, স্পেনের ‘ তিকিতাকা ‘ অর্থাৎ অবিরাম পাস খেলা নিজেদের মধ‍্যে, আর্জেন্টিনার ঝোড়ো প্রতি আক্রমণ বিশ্ব ফুটবলের কৌলিন‍্যকে সমৃদ্ধ করেছে। আর বিশ্ব ফুটবলে হল‍্যান্ড বা নেদারল্যান্ডসের অবদান? অসামান্য। অবিস্মরণীয়।

তিন তিনবার বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেও কাপ জেতা হয় নি ডাচদের। এই সেই দল যাদের সঙ্গে জোহান ক্রুয়েফ, গুলিট, বাস্তেন, রাইকার্ড প্রমুখ অবিস্মরণীয় নামগুলি এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হয়। একসময় এই দলেরই প্রধান কোচ ছিলেন মহামহিম রাইনাস মিশেল, যাঁকে নতশিরে কুর্নিশ করবে ফুটবল বিশ্ব, যতদিন পৃথিবীতে ফুটবল থাকবে। তাঁর সৃষ্ট ‘ টোটাল ফুটবল ‘ বিশ্ব ফুটবলের ধারণাটাই পাল্টে দিয়েছে। আমরা তার আগে দেখেছি ‘ ডায়মন্ড ‘ ও ‘ কাতানেশিয় ‘ সিস্টেম। কিন্তু ‘ টোটাল ফুটবল ‘ এমন রঙিন সব ফুল ফুটিয়ে গেছে যা সহজে ভোলা যায় না। একসঙ্গে গোটা দলটা উঠছে আক্রমণে,আবার, একসঙ্গেই পুরো দলটা দ্রুত নেমে যাচ্ছে রক্ষণে। কারোর কোনো নির্দিষ্ট ‘পজিশন ‘ নেই। সবাই স্ট্রাইকার আবার সবাই ডিফেন্ডার। ভাবা যায় না। এই ‘ কমলা ঝড় ‘ ফুটবল বিশ্বে অন‍্যতম মাইল ফলক তো বটেই, অন‍্যতম শ্রেষ্ঠ লাইট হাউসও অবশ্যই। আধুনিক ফুটবলের এই পাঠ পৃথিবীকে দিয়েছে নেদারল্যান্ডস, যা ফুটবলের আনন্দকে একেবারে তুরীয় মার্গে পৌঁছে দেয়। ফুটবলের এই সৃজন, এই অভিনব উদ্ভাবন ফুটবল বিশ্বকে যেন চিরকালের মতো অমিত ঐশ্বর্যময় করে দিয়ে গেছে। ডাচদের খেলা দেখলেই মনে পড়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার সেই অমোঘ পংক্তি : সকলের চেয়ে বেশি অহংকার নিয়ে একা আছি।

সত‍্যিই তো। একবারও বিশ্বকাপ না জেতা তিন-তিনবারের রানার্স আপ একটি দেশ আধুনিক ফুটবলকে যে উচ্চতায় পৌঁছে দিয়ে গেছে তাকে মাথা নিচু করে কুর্নিশ করতেই হয়।
আর হ‍্যাঁ, সেনেগালকে ২–০ হারিয়ে এবারের বিশ্বকাপ অভিযান শুরু করলো কমলা বাহিনী।

আরও পড়ুন- দুর্ঘটনার কবলে মিঠুনের গাড়ি, নিরাপদে আছে বিজেপি নেতা

Previous articleনির্বাচনের আগেই গুজরাটে সহকর্মীর ছোড়া গুলিতে নিহত আধাসামরিক বাহিনীর ২ জওয়ান
Next articleBreakfast Sports: ব্রেকফাস্ট স্পোর্টস