ঘোরতর ‘সংসারী’ সুমিত্রা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে

প্রয়াত বর্ষীয়ান রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সুমিত্রা সেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর। দীর্ঘ দিন ধরেই বার্ধক্যজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন। এছাড়াও গত বছর ২১ শে ডিসেম্বর তাঁর ব্রঙ্কোনিউমোনিয়া ধরা পড়ে। ভর্তি ছিলেন দক্ষিণ কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে। সোমবারই চিকিৎসকের পরামর্শে বাড়িতে নিয়ে আসা হয় শিল্পীকে।মঙ্গলবার ভোরেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন বর্ষীয়ান এই শিল্পী। ঘোরতর ‘সংসারী’ হয়ে দুই কন্যা মানুষ করেও ‘পেশাদার’ সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন সুমিত্রা সেন। গান গেয়েছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র কিংবা কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। স্বামী, দুই কন্যা, তাদের পড়াশোনা, নিজের চাকরি ইত্যাদির পাশাপাশি নিজেও স্বনামধন্য গায়িকা হিসেবে সঙ্গীতমহলে পরিচিত হয়েছেন। এখানেই ‘অনন্যা’ সুমিত্রা সেন।

আরও পড়ুন:‘তাঁর প্রয়াণে সঙ্গীত জগতের এক অপূরণীয় ক্ষতি হল’ , সঙ্গীতশিল্পী সুমিত্রা সেনের প্রয়াণে শোকপ্রকাশ মুখ্যমন্ত্রীর

১৯৫১ সালে কুমারী সুমিত্রা দাশগুপ্ত নামে দু’টি নজরুলগীতি (‘গোঠের রাখাল বলে দে রে’, ‘বেদনার বেদী তলে’) রেকর্ডিংয়ের মধ্যে দিয়ে শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। নজরুলগীতি ছাড়াও পল্লিগীতি (জিপসিগান, ধামাইলগান, পালাগান, বিয়েরগান), আধুনিকেরও রেকর্ড রয়েছে। এই সব গান ভারতীয় সঙ্গীতের অমূল্য সম্পদ। তখন সুমিত্রার কণ্ঠস্বর এমন ছিল, যার সঙ্গে তুলনা চলে একমাত্র গীতা দত্তের। যদিও জীবনসায়াহ্নে অশীতিপর শিল্পী নিজে মনে করে ছিলেন, ‘‘এই গানগুলোর প্রতি জাস্টিস করতে পারিনি।’’ এই উক্তির মধ্যে হয়তো লুকিয়ে আছে প্রকৃত শিল্পীমনের চিরকালীন অতৃপ্তি। পরে অবশ্য রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসেবেই তাঁর অধিক পরিচিতি।

সারা জীবনে শুধু রবীন্দ্রনাথের গান রেকর্ড করেছেন দেড়শোরও বেশি। শিল্পী হিসেবে ষোলোটি ছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্লে-ব্যাক করেছেন। উত্তমকুমারের অনুরোধে ১৯৬০ সালে ‘শুন বরনারী’ ছবিতে গানের মধ্যে দিয়ে যার শুরু। সন্তোষ সেনগুপ্তের পরিচালনায় ‘শ্যামা’, ‘শাপমোচন’, ‘বাল্মীকি প্রতিভা’, ‘বর্ষামঙ্গল’, ‘বসন্ত’ বা ‘মায়ার খেলা’ (পরিচালনা, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়)-র মতো নৃত্যনাট্য ও গীতিনাট্যে গান তাঁকে স্বকীয় আসনে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। গীতি আলেখ্য ‘যায় দিন শ্রাবণ দিন যায়’-এও তাঁর কণ্ঠ শোনা যায়। কাজ করেছেন উস্তাদ আলি আকবর খান, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, রবীন চট্টোপাধ্যায়, ভি বালসারা, তিমির বরণ, সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বা সতীর্থ এবং সহপাঠী মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মতো বহু সঙ্গীত পরিচালকের সঙ্গে। ‘কোমল গান্ধার’-এর জন্য ঋত্বিক ঘটক ছবির সঙ্গীত পরিচালক জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রকে বলেছিলেন সুমিত্রার কণ্ঠ ব্যবহার করার কথা। পঙ্কজকুমার মল্লিকের পরিচালনায় ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র গানে (মাগো তব বীণে সঙ্গীত)-র মধ্যে দিয়ে তো এখন ইতিহাসে সুমিত্রা। এখনও প্রতি বছর দেবীপক্ষের শুরুতে মহালয়ায় যাঁর কণ্ঠ চাইলেই বাঙালি শুনতে পারেন রেডিয়োতে। জীবনভর অবদানের জন্য পেয়েছেন ‘সঙ্গীত-নাটক অ্যাকাডেমি’ পুরস্কার-সহ নানা স্বীকৃতি।

৩০ এপ্রিল ১৯৮০ সালে দেবব্রত বিশ্বাসের লেখা একটি চিঠির কথা উল্লেখ করতে হয়। দেবব্রত লিখেছেন, ‘‘সুচরিতাসু সুমিত্রা দিদিমণি, এইমাত্র আপনার চারটি গান বেতারে শুনলাম। (১) (‘কথা ভুলে গেছি’), (২) আমি যত বার (এখানে উল্লিখিত গানটি হল: ‘তুমি যত ভার দিয়েছ সে ভার করিয়া দিয়েছ সোজা/আমি যত ভার জমিয়ে ভুলেছি/ সকলই হয়েছে বোঝা।’), (৩) ‘মেঘ বলেছে, যাব যাব’, (৪) ‘আমারে কি (কে) নিবি ভাই’। দারুণ বললে কম বলা হয়। আপনার গানের ভাব ও ভঙ্গি আমার হৃদয়কে তীব্র নাড়া দিয়েছে। মনে হচ্ছিল, যেন আমিই গাইছি— আপনার গানে আমার নিজেকে খুঁজে পেলাম। শরীর খুব খারাপ তাই আমি আর গাইতে পারি না। অন্যান্য রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনলে আমি এতটা বিচলিত হই না। এত লিখলাম বলে কিছু মনে করবেন না। কারণ, আমি না লিখে থাকতে পারলাম না। আপনার আরও উন্নতি হোক। এগিয়ে যেতে থাকুন। আন্তরিক শুভেচ্ছা ও নমস্কারাস্তে আপনাদের জর্জদা।’’ রবীন্দ্রসঙ্গীতের জগতে সুমিত্রার গ্রহণযোগ্যতার দলিল এই চিঠি।
এ তো গেল শুধু সঙ্গীতশিল্পী সুমিত্রা সেনের কথা। এর বাইরেও ছিল তাঁর আরও একটি জগৎ। অধ্যাপক এবং পরিপূর্ণ গীতরসিক বাবার স্নেহচ্ছায়ায় শৈশব, কৈশোর কাটিয়ে বিয়ের পর নানা কাজের মধ্যেও জারি রেখেছিলেন সঙ্গীতচর্চা। স্বামী অনিলকুমার সেনের আন্তরিক সাহায্য সেখানে অবশ্যই ছিল। কিন্তু, শ্বশুরবাড়ির দায়দায়িত্ব সামলানো, দুই কন্যা মানুষ করা এবং সেই সঙ্গে নিজের পেশাগত জগতে স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠার পথ করে নেওয়া মোটেই সহজ ছিল না। ঘরে এবং বাইরে সামঞ্জস্য রেখে চলার উদাহরণ হতে পারেন সুমিত্রা।কন্যাদের পড়াশোনা, গান শেখানো এবং পেশাদার হিসেবে একাধিক দায়বদ্ধতা রক্ষা সমান তালে করে গিয়েছেন তিনি।