Thursday, May 15, 2025

‘উনিশের শহীদেরা’, উৎপল সিনহার কলম

Date:

Share post:

উৎপল সিনহা

গলা মিলিয়ে গেয়েছি গান —
‘ মা আমার বন্দিনী ‘ ।
ভুলে যাই নি । ভুলে যাবো না
জীবনে কোনদিনই ।।

কিন্তু হায় , আমরা প্রায় ভুলেই গেছি । আমরা কথা রাখি নি ।
ভুলে গেছি শিলচরের রক্তাক্ত ১৯-শে মে । শহীদদের রক্তে রাঙা উনিশে মে ।
মনে রেখেছি সদ্য অতিক্রান্ত রক্তে ভেজা একুশে ফেব্রুয়ারি । কারণ , ভোলা যায় না এই
অবিস্মরণীয় দিনটি । কিন্তু একই কারণে ১৯-শে মে দিনটি কি অবিস্মরণীয় নয় ?
তাহলে ভুলে যাওয়া কেন ?

ইতিহাস যখন কোনো এক বিশেষ ঘটনার প্রতি সপ্রশংস আলোকপাত করে তখন আশ্চর্যরূপে সমগুরুত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ আরেকটি ঘটনা সম্পর্কে কেমন যেন উদাসীন থাকে । ইতিহাসের বিচার বড়ো নির্মম । ইতিহাসের সত্য ও অর্ধসত্য নিয়ে বিতর্কের অন্ত নেই । এর সমাধান সময়ের হাতে । কিন্তু ইতিহাস যদি কোনো বিশেষ ঘটনাকে উপেক্ষা করে তখন ধীরে ধীরে ধুলোর আস্তরণ পড়তে থাকে উপেক্ষিত সেই বিশেষ অধ্যায়ে । ক্রমশ বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতে থাকে ইতিহাসের সেই দুয়োরানি । অথচ সম্মান ও মর্যাদায় দুটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলকের একই পংক্তিতে থাকার কথা ছিল ।
কী হয়েছিল উনিশে মে ?
আসুন , তার আগে জেনে নেওয়া যাক কে কানাইলাল নিয়োগী , কে চণ্ডীচরণ সূত্রধর আর হিতেশ বিশ্বাস-ই বা কে !
সত্যেন্দ্র কুমার দেব , কুমুদ রঞ্জন দাস , সুনীল সরকার , তরণী দেবনাথ , শচীন্দ্র চন্দ্র পাল , বীরেন সূত্রধর , সুকোমল পুরকায়স্থ এবং কমলা ভট্টাচার্য — এঁরাই বা কারা ?

এঁরা সকলেই ভাষাশহীদ । রফিক , জব্বার , বরকতের মতোই মাতৃভাষা রক্ষার লড়াইয়ে এঁরা সকলেই প্রাণ দিয়েছেন । আরও আছেন ভাষাশহীদ । এঁরা হলেন বিজন চক্রবর্তী , জগন্ময় দেব ও দিব্যেন্দু দাস ।

অসমের বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল তৎকালীন আসাম সরকারের অসমীয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ , যেহেতু ওই অঞ্চলের জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল বাংলাভাষী । এই গণআন্দোলনের প্রধান উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি ঘটে ১৯৬১ সালের ১৯-শে মে । সেদিন ১১ জন প্রতিবাদী ভাষাপ্রেমীকে শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে আসাম প্রাদেশিক পুলিশ গুলি ক’রে হত্যা করে ।

বরাক উপত্যকার বাঙালিদের ওপর বলপূর্বক অসমীয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে ১৯৬১ সালে কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ নামে একটি সংগঠনের জন্ম হয় । অসম সরকারের এই অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ১৪ এপ্রিল তারিখে শিলচর , করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে সংকল্প দিবস পালিত হয় ।বরাক উপত্যকায় হয় ভাষা রক্ষার পদযাত্রা । ১৯ মে শিলচর-সহ আসামের বিভিন্ন স্থানে শুরু হয় হরতাল ও পিকেটিং । শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে শুরু হয় সত্যাগ্রহ আন্দোলন । শান্তিপূর্ণ এই হরতাল জোর করে দমন করতে বিকেলে উপস্থিত হয় অসম রাইফেলস । শুরু করে দমনপীড়ন ও গ্রেপ্তার । আগুন জ্বলে ওঠে । লাঠি ও বন্দুকের বাঁট দিয়ে মারা হতে থাকে আন্দোলনকারীদের । শেষে সাত মিনিটের মধ্যে ১৭ রাউন্ড গুলি চালানো হয় প্রতিবাদীদের লক্ষ্য করে । মোট ১১ জন মারা যান সেদিন । ২০ মে শিলচরের জনগণ শহীদদের শবদেহ নিয়ে শোকমিছিল সংগঠিত করেন ।

এই ঘটনার পর অসম সরকার বরাক উপত্যকায় বাংলাকে সরকারী ভাষা হিসেবে ঘোষণা করতে বাধ্য হয় । শহীদের রক্ত হয় নি ব্যর্থ । কিন্তু রক্তের মূল্যে , প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত এই অধিকারকে কতটুকু মূল্য দিয়েছি আমরা ? কতটুকু স্বীকৃতি ? দিতে পেরেছি কি এর প্রাপ্য মর্যাদা ? শহীদবৃন্দ ও তাঁদের পরিবারগুলিকে প্রাপ্য সম্মান আমরা দিতে পেরেছি কি ?

আরও পড়ুন- ঘন কুয়াশায় বিপত্তি! কুলপিতে হুগলি নদীতে ডুবছে বাংলাদেশী বার্জ

আশ্চর্য লাগে এই ভেবে যে বরাক উপত্যকার ভাষা শহীদদের কেউ তেমন মনে রাখে নি । বাংলা ভাষা রক্ষার জন্যই প্রতিবাদ , প্রতিরোধ , জমায়েত , আত্মবলিদান , তবু ১৯ মে ১৯৬১ কেন যে একুশে ফেব্রুয়ারির মতো চিহ্নিত , স্বীকৃত ও সম্মানিত নয় , কেন আপামর বাঙালির স্মরণ , মনন ও চিন্তনে তেমন সাড়া জাগায় না বাংলা ভাষার জন্যই এই মহান আত্মত্যাগ , তা বড়োই বেদনাদায়ক ।

এই অবজ্ঞা , এই উপেক্ষাই কি প্রাপ্য শহীদদের ? জাতি হিসেবে বাঙালি যদি আত্মবিস্মৃতই হয় তাহলে ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি মনে রাখে কেন , ঘটা করে পালনই বা করে কেন ? এটা কি দ্বিচারিতা নয় ? বাঙালির বৃহত্তর অংশের ভণ্ডামি নয় ?

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনে নিহত মানুষেরা কি বাংলা ভাষার জন্যই প্রাণ বিসর্জন দেন নি ? তাঁরা কি বাঙালি ছিলেন না ?

পাশাপাশি লক্ষ্য করে দেখার বিষয় এই যে , শহুরে শিক্ষিত বাঙালির নিজেদের মাতৃভাষা নিয়ে এখন যে হীনম্মন্যতাবোধ দেখা যাচ্ছে তার চেয়ে লজ্জাজনক উদাহরণ ভাষা-পৃথিবীতে আর নেই । আসলে কলকাতা বা ঢাকার বাঙালিদের ইংরেজি ও হিন্দি ভাষার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার মুরোদ নেই । এঁরা ইউরোপপন্থী বাংলা প্রসার আন্দোলন ও আগ্ৰাসী হিন্দি ও ইংরেজি সাম্রাজ্যবাদের দোসর । এপার বাংলায় যাঁরা ভদ্রলোক ও বুদ্ধিজীবী তাঁরা বেশ ভালো বোঝেন শাসকের ভাষা । আগে ফরাসি , পরে ইংরেজি ও এখন হিন্দিপ্রেম , তাই বাংলাভাষার প্রতি এঁদের কোনো দায় নেই । ঔপনিবেশিকতার উচ্ছিষ্ট ভক্ষণে এঁরা সারাক্ষণ ব্যস্ত ও রীতিমতো পরিতৃপ্ত । এঁদের চিন্তা চেতনা আচ্ছন্ন করে রয়েছে ঔপনিবেশিকতার মৃতবৎ অবশেষ ।
তবে হ্যাঁ , আশার কথা এই যে এঁদের সঙ্গে বৃহত্তর গ্রামবাংলার কোনো সম্পর্ক নেই । ছিলোও না কোনোদিন । আবহমান বাংলার মাটি ও জল থেকে কখনও বিচ্ছিন্ন হবে না গ্রামবাংলার মানুষ । তাঁদের মুখে মুখে বেঁচে থাকবে বাংলা ভাষা । বেঁচে থাকবে বাংলা গান , বাংলা ছড়া ও কবিতা , লোকগীতি , পল্লিগীতি , মঙ্গলকাব্য , আর অপার সৌন্দর্যে ভরা রূপসী বাংলার মাটি ও মানুষের পরাণকথা ।

বরাক উপত্যকার ভাষা শহীদদের উপেক্ষা তথা বিস্মরণ একটা নির্দিষ্ট সময়ের , একটা নির্দিষ্ট কালের অধঃপতনের চিহ্নমাত্র । শহুরে জগাখিচুড়ি বাঙালি সংস্কৃতির সার্বিক অবক্ষয়ের দহনকাল একদিন অবশ্যই সমাপ্ত হবে । এখন হয়তো আরও পঞ্চাশ বছর ধরে মনে হবে বাংলা ভাষার জন্য‌‌‌ প্রাণ দিয়ে অপরাধ করেছিলেন বরাক উপত্যকার ভাষা শহীদবৃন্দ । তারপর একদিন বিস্মরণের ধুলোর আস্তরণ সরিয়ে এপার বাংলার ভাষা শহীদদের প্রকৃত সম্মান জানাবেন গ্ৰামবাংলার সরলসাদা খেটে খাওয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণ।
সেদিন সব অবজ্ঞা , সব উপেক্ষা , সব বঞ্চনা ও অবহেলার অবসান হবে ।

এপার বাংলার ভাষা শহীদেরা ফুলে ও মালায় সজ্জিত হয়ে বীরের সম্মানে অলংকৃত হয়ে হাসিমুখে এসে দাঁড়াবেন লাখো মানুষের হৃদয়ের আলোয় উদ্ভাসিত রূপসী বাংলার সুনীল আকাশের তলায় ১৯-শে মে-র অবিস্মরণীয় গৌরবগাথা বুকে জড়িয়ে । সেলাম জানাবে মহাকাল ।

আরও পড়ুন- রাস্তায় জঞ্জাল ছুড়লেই মোটা অঙ্কের জরিমানা! বড় সিদ্ধান্ত কলকাতা পুরসভার

spot_img

Related articles

বাজার থেকে প্রত্যাহারের নির্দেশ! রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোলের পরীক্ষায় ডাহা ফেল ৫১ জীবনদায়ী ওষুধ

রাজ্যের বাজারে ফের মিলল জাল ও নিম্নমানের ওষুধের হদিশ। রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোলের সাম্প্রতিক নমুনা পরীক্ষায় গুণমান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ...

অ্যাক্রোপলিস মলে মাতৃত্বের জাদুতে মাতোয়ারা শহর, বিশেষ দিনে সম্মানিত হলেন মা ও সন্তানরা

“মা” শব্দটি শুধু একটিমাত্র ডাক নয়—এ এক অনুভব, এক শক্তি। সেই মাতৃত্বের জাদুকেই সম্মান জানিয়ে মাতৃ দিবস উপলক্ষে...

চেন্নাইকে টেক্কা বাংলার! মৃত্যুর মুখ থেকে রুক্মিণীকে ফিরিয়ে আনল হাওড়ার হাসপাতাল

‘উন্নত চিকিৎসা মানেই দক্ষিণ ভারত’— এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নতুন উদাহরণ তৈরি করল হাওড়ার নারায়ণা হাসপাতাল। বাইকের ধাক্কায়...

মরণোত্তর অঙ্গদানে অনন্য দৃষ্টান্ত! চার জনকে নতুন জীবন দিলেন জয়েশ 

মৃত্যুর পরেও চারটি প্রাণে জীবনপ্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়ে গেলেন দমদমের কাশিপুরের যুবক জয়েশ লক্ষ্মীশঙ্কর জয়সওয়াল। মাত্র ২৫ বছর বয়সে...