‘অন্ধ কানাই পথের পরে’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

ভিক্ষা ব্যবসা ছিল ও আছে । ভিক্ষা ব্যবসায়ী আছে । আছে আদি ভিক্ষাচক্র । সুবিশাল এই ভিক্ষাচক্রে ঘটে কত যে উত্থানপতন , ভাঙাগড়া , হিংসা , খুন , জখম , ধর্ষণ ও আত্মহনন । আবার বহুরূপী এই প্রাচীন বৃত্তিতে প্রেমও আসে মহাসমারোহে । শ্রাবণের পুঞ্জীভূত মেঘের মতো কখনও বা ঘনিয়ে ওঠে পূর্বরাগ , তারপর হয়তো বা গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে গাঢ় অভিমান , তিক্ত ও লবনাক্ত বিরহবেদন । অন্তিমে কখনও বা বিষাদ আঁধারে একলা পড়ে থাকে চিরবিচ্ছেদজর্জর মজ্জা।

এই যে তীব্র দহনজ্বালা ও আত্মধিক্কারের পাথর ছড়ানো রক্তমাখা সুদীর্ঘ অন্ধকার পথে জীবনভর চলার বাধ্যতা , এ কি সাধ করে কেউ বেছে নেয় ? আসলে সবটাই পেটের তাগিদ , পাপী পেট কা সওয়াল । আর , কে না জানে যে , একবার এই বাঁকা পথে ঢুকে পড়লে বেরোবার সব রাস্তা চিরতরে বন্ধ । এইভাবেই টলতে টলতে ঝলসে ঝলসে চলতে চলতে বিমর্ষতার ঘোর অন্ধকারে অন্তর বিদীর্ণ করে একদিন হঠাৎই বিদ্যুৎ চমকের মতো বেরিয়ে আসে সম্যক উপলব্ধির অনবদ্য আনন্দগান । তুড়ি মেরে ভিখারী গেয়ে ওঠে , ‘ একদা মনেতে বাসনা আছিল বুদ্ধিতে হবো পার … ‘ । গানে গানে মূর্ত হয়ে ওঠে দগ্ধ রহস্যাচ্ছন্ন ভিক্ষুকজীবন ।

মহামহিম নাট্যকার ব্রেটোল্ড ব্রেখটের ‘ দ্য থ্রি পেনি অপেরা ‘ অবলম্বনে ‘ তিন পয়সার পালা ‘ নাটকটি প্রযোজনা করেন আমাদের দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নট , নাট্যকার ও নির্দেশক মহামান্য অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় । অসম্ভব জনপ্রিয় এই নাটকটি বাংলা নাট্য-ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক ।

প্রাচীনকাল থেকেই মানবসমাজে ভিক্ষাবৃত্তি চলে আসছে । ভিক্ষা একটি সামাজিক সমস্যা ও অপরাধ । পৃথিবীর অনেক দেশেই তাদের প্রচলিত আইনে ভিক্ষা নিষিদ্ধ । সামাজিক জীবনে আমরা দেখতে পাই যারা ভিক্ষা করে তারা অসম্মানজনক , অবহেলিত ও তুচ্ছ জীবন যাপন করে । এটি একটি ঘৃণ্য সামাজিক সমস্যা । বিভিন্ন দেশের সরকার ভিক্ষাবৃত্তি নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পরেও এই বৃত্তি রমরম করেই চলছে , থামার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না । ভিক্ষুকদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও অনেকেই তাতে রাজি নয় । এমন পরিশ্রমহীন নিরাপদ পেশা তথা ব্যবসার আরাম ও স্বাচ্ছন্দ্য কেইবা সাধ করে ছাড়তে চায় ?

শারীরিক বৈকল্য যাকে পঙ্গু করে দিয়েছে এবং দেশের সরকার যার চিকিৎসা ও অন্নসংস্থানের দায় এড়িয়ে গেছে , সে যদি বাধ্য হয়ে জীবনধারণের জন্য ভিক্ষার পথ বেছে নেয় সেটা মেনে নেওয়া যায় । কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা কী দেখতে পাই ? কেউ অন্ধ সেজে , কেউ বোবাকালা ও পঙ্গু সেজে , কেউ কুষ্ঠরোগীর ছদ্মবেশে দিনের পর দিন মানুষকে বোকা বানিয়ে , ধোঁকা দিয়ে ভিক্ষা করতে থাকে । এরা বেশিরভাগই ভুয়ো । এদের বেশিরভাগই সম্পূর্ণ সুস্থ । আসলে প্রায় বিনা পরিশ্রমে মোটা আয়ের লোভ এরা সামলাতে পারে না । শহরে অনেক দালাল দেখা যায় যারা এই ভিখারীদের পরিচালনা করে । কেউ বা ভিখারীদের মহাজন । তারা বিভিন্ন জায়গা থেকে অসুস্থ বৃদ্ধবৃদ্ধা , হারিয়ে যাওয়া ছোট ছোট বাচ্চা , এমনকি অতি দরিদ্র বাবা-মায়ের কাছ থেকে তাদের সন্তানদের ক্রয় করে অথবা ভাড়ায় এনে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োগ করে । এই সমস্ত টাউট বাটপারদের জন্যই ভিক্ষাব্যবসা দিনেদিনে ফুলেফেঁপে উঠছে । এ এক বিচিত্র জটিল পেশা ।

কোনোরকম লেনদেন ছাড়া শুধুমাত্র অপরের দয়াদাক্ষিণ্য ও অনুগ্রহে অর্থ আদায়ের এই ফন্দি আদিকাল থেকেই চলে আসছে । বিনাশ্রমের এই নিয়মিত আয় বহু সুস্থসবল মানুষকেও আত্মমর্যাদাহীন অলস জীবনের দিকে ঠেলে দিয়েছে ।

এও ঠিক যে , অনেকেই প্রকৃত অর্থেই সর্বস্বান্ত হয়ে ভিক্ষায় নেমেছেন । কেউ বা নেমেছেন খুব সহজেই আয় করা যায় ব’লে । এছাড়াও রয়েছে ‘ বেগিং মাফিয়া ‘ , যারা বিভিন্ন উপায়ে নানা অপকর্ম করা ছাড়াও ভিক্ষুকদের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য গোপনে কাজ করে চলেছে ।

ভিক্ষুকেরা পথচারীদের যেমন বিব্রত করে , তেমনি বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডেও অংশগ্রহণ করে অনেকসময় জেনে অথবা না জেনে । ভিক্ষুকদের উৎসাহিত করার ক্ষেত্রে পুণ্যলাভপ্রার্থী সাধারণ মানুষের অবদানও কম নয় । পুণ্য অর্জনের লোভেই যে জনগণের দান খয়রাত , সেটা ভিক্ষুকেরা ভালোই জানে । মন্দির , মসজিদ , গির্জা ইত্যাদির আশেপাশে ভিক্ষুকদের দলেদলে দেখা যায় । দেখা যায় বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান উৎসবের দিনগুলিতে ভিক্ষাপাত্র হাতে অসংখ্য ভিক্ষুকদের সমাবেশ , কারণ , উৎসবের দিনে , পালাপার্বণের সময় মানুষের মন প্রসন্ন থাকে । তখন গরীব দুঃখীদেরকে কিছু দান করার ঔদার্য জাগে মানুষের মনে ।

আরও পড়ুন- রাজ্যপাল আনন্দ বোস কেন বিজেপির ক্যাডার নয়? ধনকড়ের অভাব অনুভূতি শুভেন্দুর

তবে হ্যাঁ , বিভিন্ন দেশের সরকারগুলির যদি প্রকৃত সদিচ্ছা থাকে , তাহলে ভিক্ষুকদের পুনর্বাসন ও ভিক্ষাবৃত্তি নির্মূল করার উদ্যোগ সফল হয়ে উঠতে পারে । তবে তার জন্য চাই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ।

 

 

Previous articleBreakfast news : ব্রেকফাস্ট নিউজ
Next articleBreakfast Sports: ব্রেকফাস্ট স্পোর্টস