‘আলোকিত ডিরোজিও’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

মাত্র ২২ বছরের জীবন । অথচ কি সুদূরপ্রসারী অভিঘাত সেই স্বল্প আয়ুষ্কালের ! দীর্ঘকালের জমাট অন্ধকার ভেদ করে প্রকৃতির বুকে সহসাই যেমন দেখা দেয় কান্তিময় আশ্চর্য আলো , আর সে আলোয় ভেসে যায় আদিগন্ত চরাচর , তেমনই এক অপরূপ আলোর নাম ডিরোজিও ।

হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও । জন্ম কলকাতায় , ১৮০৯ সালের ১৮ এপ্রিল । আর , অকাল মৃত্যুও কলকাতাতেই , ১৮৩১ সালের ২৬ ডিসেম্বর । সেই হিসেবে এখন , এই এপ্রিল ডিরোজিওর জন্মমাস ।
পেশায় শিক্ষক ডিরোজিও ছিলেন কবি ও নৃত্যশিল্পী । তিনি স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন একজন যুক্তিবাদী ও চিন্তাবিদ হিসেবে । মৃত্যুর দীর্ঘকাল পরেও ছাত্রদের মধ্যে যাঁর উত্তরাধিকার বেঁচে ছিল , যাঁরা ইয়ং বেঙ্গল নামে পরিচিত ছিলেন এবং যাঁদের মধ্যে অনেকেই পরবর্তীকালে সমাজসংস্কার , আইন এবং সাংবাদিকতায় বিশিষ্ট স্থান দখল করেছিলেন ।
নব্যবঙ্গ দল গঠন তাঁকে ভারতের জাতীয়তাবাদের ইতিহাসে অমর করে রেখেছে । সাহিত্য , ইতিহাস , বিজ্ঞান ও দর্শনকে কেন্দ্র করে চিন্তক ডিরোজিওর ভাবনা ও আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল বহুধাবিস্তৃত । ছাত্রদের কাছে তাঁর আকর্ষণ ছিল দুর্বার । ছাত্রমহলে প্রবল জনপ্রিয় ছিলেন তিনি ।

আজ যখন আমাদের গোটা দেশটাই কুসংস্কারের আরাধনায় সদাব্যস্ত , যখন বিজ্ঞানের সাধনা থেকে মুখ ফিরিয়ে আছেন দেশের অধিকাংশ মানুষ , যখন অবিজ্ঞানে মজে আছে প্রায় গোটা জাতিটাই , যখন মনুষ্যত্বকে শাসন করছে ধর্ম ও জাতিভেদ , যখন প্রতি মুহূর্তে জীর্ণ লোকাচারে অবশ ও অচল একটা জাতি প্রায় দিশেহারা , এমন অবক্ষয়ের সময়ে ডিরোজিও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন কালের অনিবার্য নিয়মেই , আর , ডিরোজিও চর্চাও অনিবার্য হয়ে ওঠে ইতিহাসের অমোঘ আহ্বানে ।

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে হিন্দু কলেজের তরুণ অধ্যাপক ডিরোজিও তৎকালীন রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার কাণ্ডারী হিসেবে বাংলার সংস্কার আন্দোলনের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন । এই আন্দোলনের ফলে তাঁর অনুসারীদের মধ্যে অন্ধবিশ্বাস ত্যাগ করে যুক্তিবাদী ও সত্যানুসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে যা তৎকালীন ধর্ম ও সমাজ ব্যবস্থার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল ।

কলকাতার এক সচ্ছল পর্তুগিজ পরিবারে ডিরোজিওর জন্ম হয়েছিল । বাবা ফ্রান্সিস , মা সোফিয়া । মাত্র ৬ বছর বয়সে মাতৃহারা হন ডিরোজিও । আর , মাত্র সতেরো বছর বয়সে তিনি হিন্দু কলেজে যোগ দেন ইতিহাস ও ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে । কৈশোর থেকেই যুক্তিবাদী ডিরোজিও ছিলেন নিরীশ্বরবাদী । খ্রীষ্টান সুলভ আচরণ তিনি ত্যাগ করেছিলেন । তিনি যুক্তিবাদের অস্ত্রে প্রতিবাদ সংগঠিত করেছিলেন হিন্দু সমাজের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে । কোনো বিষয়ে মত স্থির করার আগে তার পক্ষে ও বিপক্ষে যত যুক্তি আছে সেগুলো জেনে বুঝে বিচার করতে হবে । এই শিক্ষাই ডিরোজিওর স্বল্পায়ু জীবনের সবচেয়ে বড় কীর্তি । আবেগ বর্জিত ও পক্ষপাতমুক্ত হয়ে নিজস্ব বোধবুদ্ধির ওপর পূর্ণ আস্হা রেখে যে কোনো বিষয়ের বিচার করতে হবে । বিচারের যুদ্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র বিতর্ক , এই ছিল তাঁর দর্শন । মনের জড়তাকে চিহ্নিত করতে হবে । অন্ধত্ব পরিহার করতে হবে । মুক্তচিন্তার অনুসারী হতে হবে । ঠিক-ভুল পরখ করার চর্চা সর্বদা অব্যাহত রাখতে হবে ।

হিন্দু কলেজকে ঘিরে ডিরোজিওর অবস্থান শুধু হিন্দু সমাজ নয় , সেই সময় আলোড়ন তুলেছিল কলকাতা কেন্দ্রীক সমস্ত ধর্মের সমাজে । তাঁর ছাত্রদের বলা হতো
‘ ডিরোজিয়ানস ‘ । তাঁর সংগঠন ইয়ং বেঙ্গল তো ছিলই , সাহিত্য ও বিতর্ক আলোচনার জন্য ১৮২৮ সালে তিনি তাঁর ছাত্রদের নিয়ে একটি সংগঠন ‘ অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন ‘ গড়ে তোলেন এবং সংগঠনের তরফ থেকে ‘ পার্থেনন ‘ নামে একটি পত্রিকাও বের করা হয় । সংঘর্ষের সূত্রপাত হয় এর পর থেকেই । পত্রিকার মাধ্যমে ডিরোজিও সমাজের তিনটি অন্ধকার দিক তুলে ধরেন :
এক , নারীশিক্ষা ও নারীস্বাধীনতা ছাড়া সমাজের অন্ধকার দূর করা অসম্ভব ।

দুই , সমস্ত ধর্মই অযৌক্তিক ।

তিন , বৃটিশ শাসনের কুফল ভোগ করছে দেশ ।
ফলে যা হবার তা হলো । তাঁর এই অনধিকার প্রবেশ ও চর্চাকে হিন্দু সমাজ ও বৃটিশ খ্রীষ্টান সমাজ কেউই মেনে নিতে পারলো না । সমাজের সব স্তর থেকে তুমুল আক্রমণ আসতে লাগলো ডিরোজিও ও তাঁর অনুগামীদের প্রতি ।

এর পরেই তিনি হিন্দু কলেজ থেকে বহিস্কৃত হন এবং প্রবল অর্থকষ্টে পড়েন । এই অবস্থাতেও তিনি সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্যে আন্দোলন গড়ে তোলা ও জাতীয়তাবোধের বিকাশ ঘটানোর লক্ষ্যে ‘ হেসপেরাস ‘ ও ‘ ক্যালকাটা লিটারেরি গেজেট ‘ নামে দুটি পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ শুরু করেন । তাঁর লেখা কবিতা ,
‘ ভারতবর্ষ , আমার স্বদেশের প্রতি ‘ , কবিতাটি পড়লে তাঁর গভীর দেশপ্রেমের পরিচয় পাওয়া যায় ‌।

আরও পড়ুন- রাজ্যে চোখরাঙাচ্ছে কো.ভিড! পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃ.ত্যুও

১৮৩১ , ২৬ ডিসেম্বর , কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মাত্র ২২ বছর বয়সে মারা যান ডিরোজিও । গির্জা ও খ্রীষ্টধর্ম সম্পর্কে তাঁর বিরুদ্ধ মতের কারণে পার্কস্ট্রিটের গোরস্থানে তাঁকে সমাহিত করতে বাধা দেওয়া হয় । গোরস্থানের ঠিক বাইরে তাঁকে সমাহিত করা হয় ।
হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও অন্ধকার ভারতবর্ষে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী আন্দোলনের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে এক অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করে গেছেন আজ থেকে দুশো বছর আগে , একথা ভাবলেই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে ।