‘অদ্বৈত কচ্ছপ’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

অদ্বৈত কচ্ছপের কথা মনে পড়ে ? যার মৃত্যুর পরে এক মর্মস্পর্শী শোকগাথায় অদ্বৈতকে ‘ প্রপিতামহ ‘ বলেছিলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় , মনে নেই ? কলকাতার আলিপুর চিড়িয়াখানার সেই অতি দীর্ঘায়ু কচ্ছপ ! অদ্বৈত।

ধীর , স্থির , প্রাজ্ঞ এবং জগতসংসার সম্পর্কে যেন নির্লিপ্ত । আশ্চর্য সেই প্রাচীন প্রাণীটি । অসংখ্য দর্শনার্থী রোজ ভিড় করে অদ্বৈতকে দেখার জন্য । তারা অবাক হয় , মজা করে , কেউ কেউ অতি উৎসাহে ঢিলও ছোঁড়ে প্রপিতামহের লোলচর্মের ওপরে প্রকৃতিদত্ত বর্মের গায়ে । আঘাত লাগে , ব্যথা পায় । তবু অদ্বৈত নির্বিকার , ভ্রুক্ষেপহীন । ইতিহাসের কত যে উত্থানপতনের সাক্ষী সে ! স্বচক্ষে দেখেছে কত ভূমিকম্প , বন্যা , মারি ও মড়ক , দেখেছে মন্বন্তরের গ্রাম নগর , দেখেছে কত যে যুগসন্ধিক্ষণ !

অদ্বৈত শব্দের অর্থ এক বা একমাত্র , যার কোনো দ্বিতীয় নেই । সিসিলি থেকে আনা আরও চার কচ্ছপের সঙ্গে ‘ অ্যালডাবরা জায়ান্ট টরটয়েজ ‘ ( পুরুষ আলদাবরা দৈত্য কচ্ছপ ) প্রজাতির কচ্ছপটি প্রথমে ছিল ব্যারাকপুরে , রবার্ট ক্লাইভের বাগানবাড়িতে । ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধ জেতার পরে ক্লাইভকে উপহার দেওয়া হয় কচ্ছপগুলি । অদ্বৈতকে আলিপুর চিড়িয়াখানায় আনা হয় ১৮৭৫-৭৬ সালে । সেখানে ২৩১ বছর কাটিয়ে ২০০৬ সালের ২২ মার্চ মারা যায় অদ্বৈত । বয়স হয়েছিল ২৫৫ বছর ৩ মাস । ( ১৭৫০ — ২০০৬ সাল ) । ২৫০ কেজি ( ৫৫১ পাউন্ড ) ওজনের অদ্বৈত ছিল এক একাকী প্রাণী , যার বংশের কোনো রেকর্ড নেই । এর খাদ্য ছিল গমের ভুসি , গাজর , লেটুস , ভেজানো ছোলা , রুটি , ঘাস ও লবন । ২০০৫ সালের শেষের দিকে এই অতি প্রাচীন কচ্ছপের খোলা বা খোসা ফেটে যায় এবং ফাটলের নিচে মাংসে একটি ক্ষত তৈরি হয় ।

প্রসঙ্গত , অদ্বৈতের অন্যতম মালিক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন প্রভাবশালী সদস্য রবার্ট ক্লাইভ , যিনি আফিমে আসক্ত হয়েছিলেন এবং ১৭৭৪ সালে আত্মহত্যা করেন । তারপর থেকে কচ্ছপটির মালিকানা বদল হয় একাধিকবার । কিন্তু অদ্বৈত এরপরেও বহাল তবিয়তে আরও দু’শো বছরের বেশি বেঁচেছিল । শতাব্দীপ্রাচীন অদ্বৈত কচ্ছপ কিন্তু সন্তানের জন্ম দিতে পারে নি । তার কোনো উত্তরাধিকার রইলো না পৃথিবীতে ।

সবচেয়ে দীর্ঘজীবী প্রাণীদের অন্যতম কচ্ছপ । আলডাব্রা কচ্ছপগুলি পৃথকভাবে এবং পালের মধ্যে পাওয়া যায় , যাদের বেশিরভাগ খোলা তৃণভূমিতে জড়ো হয় । এরা সকালে বেশি সক্রিয় থাকে , যখন তারা চারণে থাকে এবং ব্রাউজিং করে । এরা মাটি খুঁড়তে পারে এবং ছায়াঘেরা গাছের নিচে বা ছোট গুহায় লুকিয়ে থাকে অথবা দিনের গরমে ঠাণ্ডা থাকার জন্য পুকুরে বা অন্য জলাশয়ে ডুবে থাকে । এদের প্রজননের সময় ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত । স্ত্রী কচ্ছপ ৩০ সেন্টিমিটার গভীর গর্তে ৯ থেকে ২৫ টি শক্ত খোসাযুক্ত ডিম পাড়ে জুলাই- সেপ্টেম্বর নাগাদ ।‌

অদ্বৈত কচ্ছপের মৃত্যুর সময় তার দেহে পুরোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায় । পরিখার মধ্যে থাকলেও বিরল প্রজাতির এই অতিকায় প্রাণীটি কোনোভাবে আঘাত পেয়ে জখম হয়েছিল মনে করা হয় । দর্শকদের ছোঁড়া নুড়ি পাথরের আঘাতেই সম্ভবত আহত ও বিক্ষত হয়েছিল অদ্বৈত । সেই ক্ষত আর সারে নি । যদিও নিজের জিন পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চারিত করে যেতে পারে নি বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন এই স্থলজ প্রাণীটি , তবুও সুদীর্ঘকাল পৃথিবীর নানা পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করে এক বিশাল ইতিহাসের অংশ হয়ে রয়ে গেছে অদ্বৈত । সরীসৃপ প্রজাতির প্রাণী কচ্ছপেরাও তো আজ বিপন্ন । দূষণ , খাদ্যাভাব , জলাশয়ের অভাব , মানুষের আক্রমণ , অরণ্যনিধন ইত্যাদি কচ্ছপদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে দুর্বিষহ করে তুলেছে ।
শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন ,
” এত যদি ব্যূহচক্র
তীর তীরন্দাজ , তবে কেন
শরীর দিয়েছ শুধু ,
বর্মখানি ভুলে গেছ দিতে ! ”

প্রকৃতি কচ্ছপকে কিন্তু বর্ম দিয়েছে । আত্মরক্ষার প্রধান অবলম্বন কচ্ছপদের শরীরের উপরিভাগের শক্ত খোসা বা খোল । আর দিয়েছে সুদীর্ঘ আয়ুষ্কাল । অদ্বৈতকে দিয়েছে একাধিক শতাব্দীকে একসাথে দেখার সৌভাগ্য । ইতিহাসকে স্বচক্ষে দেখার বিরল সুযোগ । তবুও আমাদের আক্ষেপ আরও বেশ কয়েকটি বছর অনায়াসে বাচঁতে পারতো অদ্বৈত । চিড়িয়াখানার দর্শকেরা মজা করতে গিয়ে ভুলে গেলো ২৫০ বছরের প্রাচীন বর্ম বা খোসা হাড় ও চামড়ার মতোই বয়সের সঙ্গে সঙ্গে জীর্ণ থেকে জীর্ণতর হয় , তখন তুচ্ছ ইটের আঘাত বোমার আঘাতের মতো বিদীর্ণ করে বর্ম , ঠেলে দেয় মৃত্যুর দিকে ।
ক্ষমা করো ‘প্রপিতামহ’ অদ্বৈত ।

আরও পড়ুন- কবজ সিস্টেম ছিল না কেন? রেলমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করে তো.প দাগলেন অভিষেক

Previous articleকবজ সিস্টেম ছিল না কেন? রেলমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করে তো.প দাগলেন অভিষেক
Next articleBreakfast news : ব্রেকফাস্ট নিউজ