৬২৭ বছরের প্রাচীন মাহেশের রথযাত্রা ঘিরে উৎসবের মেজাজ শ্রীরামপুরে

হুগলির শ্রীরামপুরের মাহেশের রথযাত্রা উৎসব ৬২৭ বছরের প্রাচীন।এই রথযাত্রা উৎসবকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যেই সাজো সাজো রব শ্রীরামপুর জুড়ে।নতুন করে সেজে উঠছে রথ।আর এই রথে চেপেই মাসির বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেবেন প্রভু জগন্নাথ,বলরাম ও সুভদ্রা।রবিবার থেকেই শুরু প্রভুর অঙ্গরাগ।নতুন রূপে সেজে উঠবেন জগন্নাথ দেব।

আগামী ২০ জুন মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হবে ভারতবর্ষের দ্বিতীয় বৃহত্তম মাহেশের জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা ।ইতিমধ্যে জগন্নাথ দেবের মন্দির সংলগ্ন স্নান পীড়ি ময়দানে বসছে বিশাল মেলা। প্রতিবছর রথের সময় এক মাস ব্যাপী রথের মেলা অনুষ্ঠিত হয়।

ইতিহাস বলছে, আজ থেকে ৬২৭ বছর আগে বাংলাদেশ থেকে এক সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী ধ্রুবানন্দ স্বামী পুরীধামে গিয়েছিলেন প্রভু জগন্নাথ দেবের দর্শনের আশায়। বহু কষ্ট বহু পথ অতিক্রম করে একদিন তিনি পৌঁছান নীলাচল অর্থাৎ পুরীধামে। সেখানে গিয়ে প্রভু জগন্নাথ দেবকে দেখে তার মনে বাসনা হয় যে তিনি নিজের হাতে প্রভু জগন্নাথ দেবকে ভোগ নিবেদন করবেন। তার এই কথা শুনে তৎকালীন পুরীর জগন্নাথ দেবের সেবাইতরা প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হন। তারা ধ্রুবানন্দ স্বামীকে যার পর নাই অপমান করেন। ক্ষোভে দুঃখে ধ্রুবানন্দ স্বামী প্রভুকে বলেন তিনি আর এই জীবন রাখবেন না, তিনি সিদ্ধান্ত নেন নিজেকে আত্মহতি দেবেন।

তারপর সেই দিন রাতেই প্রভু জগন্নাথ দেব ধ্রুবানন্দ স্বামীকে স্বপ্নে দেখা দেন, এবং বলেন ভক্ত তুমি দুঃখ করো না তুমি এখান থেকে সোজা মাহেশ ধামে যাও সেখানে গিয়ে দেখতে পাবে গঙ্গার ধারে একটা নিম কাঠ ভেসে আসবে। তুমি সেই নিম কাঠ  দিয়ে জগন্নাথ বলরাম এবং শুভদ্রার মূর্তি তৈরি করে সাধন ভজন করলে আমি প্রীত হব। মহা আনন্দে ধ্রুবানন্দ প্রভু জগন্নাথের আদেশ মতো পদব্রজে হাজির হন মাহেশে।সেখানে গঙ্গার তীরে একটি কুটির বানিয়ে প্রভুর নাম গান করতে থাকেন।একদিন দুর্যোগের রাতে তিনি দেখতে পান মাহেশের গঙ্গার ঘাটে একটি বিশাল নিম কাঠ ভেসে এসেছে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে ধ্রুবানন্দ স্বামী গঙ্গায় ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই নিমকাঠ বা দারু ব্রহ্মকে তুলে নিয়ে আসেন গঙ্গার কিনারায় ,এবং সেখানেই তিনি জগন্নাথ বলরাম এবং শুভদ্রার মূর্তি তৈরি করেন। সেই পর্ন কুটিরে ভজনা করতে থাকেন।

এরপর বহু বছর কেটে গেছে যখন ধ্রুবানন্দ বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছেন সেই সময় একদিন নবদ্বীপ ধাম থেকে চৈতন্যদেব পুরীধামে মহাপ্রভু দর্শনের জন্য বের হন। পথে তিনি মাহেশে আসেন। সঙ্গে ছিলেন তার ভক্তবৃন্দ। সেই সময় ধ্রুবানন্দ স্বামী চৈতন্যদেবকে বলেন যে আমার বয়স হয়ে গেছে। আমার আর প্রভুর সেবা করার মতো ক্ষমতা নেই। আপনি একটা ব্যবস্থা করে দিন। তখন চৈতন্যদেব তার এক পার্শ্বচর কমলাকর পিপ্লাইকে ভার দেন মাহেশের জগন্নাথ দেবের পুজো অর্চনার । তারপর থেকে কমলাকর পিপ্লাইয়ের বংশধরেরা এখনও পর্যন্ত প্রভুর সেবাইতের কাজ করছেন।

পরবর্তীকালে তৎকালীন জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় মাহেশের গঙ্গার ধার থেকে নতুন মন্দির নির্মাণ করা হয় জিটি রোডের উপর। মাহেশের  রথযাত্রা উপলক্ষে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মানুষের ঢল নামে মাহেশে। প্রভু জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা উপলক্ষে দূর দূরান্তের মানুষ এস উপনীত হন  যুগ যুগ ধরে মাহেশের রথের সময় বহু মহাপুরুষের পদধূলিতে ধন্য হয়েছে মহেশ। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, মা সারদা,ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,বঙ্কিমচন্দ্র থেকে শুরু করে আরও বহু মনীষীর পদধূলি পড়েছে এখানে।

জগন্নাথ দেব ট্রাস্টি বোর্ডের সম্পাদক পিয়াল অধিকারী জানান, রথের দিন প্রভু জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রাকে মূল মন্দিরের গর্ভ গৃহ থেকে মন্দিরের চাতালে নিয়ে আসা হয়। সকাল থেকে বিশেষ পুজো অর্চনা হয় প্রভুর। হাজার হাজার ভক্ত এসে প্রভুর চরণে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করে আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন। তারপর বিকেল চারটে নাগাদ জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা কে নিয়ে মাহেশের রথযাত্রা শুরু হয়।

এই রথেরও একটা ইতিহাস আছে। আগে ছিল কাঠের রথ। বেশ কয়েকবার আগুনে পুড়ে নষ্ট হয়েছে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে নষ্ট হওয়ার ফলে পরবর্তীকালে মার্টিন বার্ন কোম্পানি বর্তমানের লোহার রথটি তৈরি করে দেন। এবং এর সঙ্গে সামনের রথের যে দুটি বিশাল আকার তামার ঘোড়া আছে সেগুলি ইংল্যান্ডের ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি থেকে তৈরি হয়ে এসেছিল।

পিয়ালবাবু বলেন, সোজা রথের দিন দেড় কিলোমিটার দূরবর্তী মাসির বাড়িতে যান জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা। মাসির বাড়িতে তারা সাত দিন কাটান এবং সাত দিন পরে উল্টো রথের দিন তিনি আবার মন্দিরে ফিরে আসেন।আর মাহেশ হচ্ছে নব নীলাচল।এই নাম স্বয়ং দিয়েছেন প্রভু শ্রী চৈতন্যদেব।তাই এই রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে উৎসবে মেতে ওঠে হুগলি জেলার মানুষ।

Previous articleফুটবলের পর ক্রিকেটেও চমক মোহনবাগানের, পি সেন ট্রফির জন‍্য রিঙ্কুকে প্রস্তাব বাগানের
Next article৫০ জনের টিম গঠন করে রাজ্যজুড়ে পঞ্চায়েতের প্রচার: বৈঠকে সিদ্ধান্ত তৃণমূলে