‘রঙ তামাশা’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

ফেসবুকে একজন কৌতুক ক’রে লিখেছেন টেলিভিশনের প্রথম যুগের কথা ।
” তখন সাদাকালো ছবি । অ্যান্টেনা সরিয়ে নড়িয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ছবি অ্যাডজাস্ট করতে হয় । ছবি ভীষণ কাঁপে , নড়ে , সরে যায় , জ্বলে ওঠে , নিভেও যায় । ব্রাইটনেস বাড়ানো কমানোর ওপর নির্ভর করে টিভি দেখার অনেকটাই । সেই সময়কার এক সন্ধ্যায় দেখা হচ্ছে ইংল্যান্ড বনাম নাইজেরিয়ার ফুটবল ম্যাচ ।‌বাইরে ঝোড়ো হাওয়া । খুব নড়ছে অ্যান্টেনা।‌ বারবার ম্যাচের উন্মাদনায় বিঘ্ন ঘটছে ।‌ ব্রাইটনেস বাড়ালেই টিভির পর্দা থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে ইংল্যান্ড দল । আবার ব্রাইটনেস কমালে পর্দা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে নাইজেরিয়ার ফুটবলাররা । এসব সহ্য ক’রেও আমাদের খেলা দেখার উৎসাহে কোনো ভাঁটা দেখা যেতো না । ”

একেবারেই নির্ভেজাল এই রসিকতার মধ্যেও কিন্তু কেউ খুঁজে পেতে পারেন লুকোনো বর্ণবৈষম্যের কটু গন্ধ । গায়ের রঙ নিয়ে সর্বদা গর্বিত শ্বেতাঙ্গ ইংরেজরা এ নিয়ে সম্ভবত কোনো অভিযোগ করবেন না। কিন্তু কালো মানুষেরা ? তাঁরা কি খুব সহজে গ্রহণ করবেন এই আপাতনির্মল রঙ্গ ? তাঁরা কি কখনো ভুলে যাবেন ‘ জন হেনরি ‘ গানে, ‘ কালো নিগারের দেখো দুঃসাহস ‘ ! ভোলা যায় ? বিদ্রুপের চাবুকের দাগ বড়ো মারাত্মক । কালো নিগারের স্পর্ধার কথা উঠলেই মনে পড়ে চিকলেট চিবোতে চিবোতে অবলীলায় শ্বেতাঙ্গ বোলারদের গ্যালারির বাইরে আছড়ে ফেলছেন কালো ভিভ রিচার্ডস । ওহ্ , কি সীমাহীন ঔদ্ধত্য ! ভিভের ব্যাটের তাণ্ডব দেখে জুড়িয়ে যেতো কালোদের প্রাণ । ভিভের প্রত্যেকটা শটে যেন লুকিয়ে থাকতো হাজার বছরের চাপা যন্ত্রণা আর যুগযুগান্তরের সঞ্চিত অপমান ।

সাদা চামড়া , কালো চামড়া । পৃথিবীটা যেন দু’ভাগে বিভক্ত অনাদিকাল থেকে । সাদা ও কালো । তাদের লড়াইও চলছে অবিরাম । এখন কিছুটা স্তিমিত , কিছুটা থিতিয়ে আছে মানেই যে লড়াই থেমে গেছে তা কিন্তু মোটেই নয় । দক্ষিণ আফ্রিকায় মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে ট্রেন থেকে ধাক্কা মেরে নামিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে নেলসন ম্যান্ডেলার সুদীর্ঘ কারাবাস যেন একই উপন্যাসের এক একটি পৃষ্ঠা । বেঞ্জামিন মোলায়েজের আত্মদানের স্মৃতি প্রতি মুহূর্তে সজাগ । যতই কালো হোক , মেঘলা দিনে কৃষ্ণকলির কালো হরিণ চোখ দেখে মুগ্ধ হয়ে যান কবি রবি ঠাকুর । কিন্তু তা থেকে যায় গীতবিতানের পৃষ্ঠায় গানের বাণী হ’য়ে । বাস্তবে কালোদের নিস্তার নেই কোথাও । শুধুমাত্র কালো হয়ে জন্মানোর অপরাধে হাজার যুগের ভোগান্তি । তবে দুষ্টু লোকেরা বলে , শ্বেতাঙ্গদের আবার ইতিহাস কি ? কীসের ঐতিহ্য , কীসেরই বা পরম্পরা ? ওই তো , ছলে-বলে-কৌশলে কাঙালের ধন কেড়ে নেওয়া , সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের নির্লজ্জ প্রর্দশনী , অর্থ , সম্পদ আর অস্ত্রের তীব্র ঝনঝনানি আর আদিঅন্তহীন প্রতারণা ।

ইতিহাস তো কালোদের । মনুষ্যত্বে পরিপূর্ণ কালো মানুষের হাতেই তো গড়া পৃথিবীর ইমারত । লড়াই আন্দোলনের রক্তাক্ত ইতিহাস। অসম লড়াইয়ে প্রাণের তোয়াক্কা না করে মরণপণ সংগ্রামের অবিস্মরণীয় ইতিহাস । হ্যাঁ , আমরা গর্বিত কালো মানুষ ,আমরা বিশ্বজয়ী কালো মানুষ । আমাদের সমস্বরে কেঁপে ওঠে দুনিয়া ।

অথচ আজও , ‘ গণিকাও কালো হলে ভেংচি কেটে তাড়িয়ে দেয় ‘ । অথচ কে না জানে , কালো মানুষের কালো চামড়ার চেয়েও কালো অপরিমেয় নিকষ কালো বেদনা । এই বেদনা নিয়েই পাড়ি দিতে হবে এখনও দীর্ঘ পথ । ‘ কেননা এ অন্ধকারে শেষ যুদ্ধ বাকি ‘ ।

‘ ব্ল্যাক পাওয়ার ‘ একটি রাজনৈতিক স্লোগান । কালো মানুষদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা ছিল এর অন্যতম উদ্দেশ্য । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকে এই আন্দোলন প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে কালো মানুষদের সম্মিলিত প্রতিবাদে । তাও মূলধারার নাগরিক অধিকার আন্দোলন থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করার জন্য এবং কালো বিচ্ছিন্নতাবাদকে সমর্থন করার জন্য আন্দোলনটি সমালোচিত হয়েছে ।‌অথচ কালোদের নিয়ে হাজার বছরের রঙ-তামাশার কথা কিন্তু বেমালুম চেপে যাওয়া হয় এসব সমালোচনার সময় !

ডোবায় ভেসে থাকা ব্যাঙের মাথায় ঢিল ছুঁড়ে অনেক কচিকাঁচা বিস্তর আনন্দ পায় , কিন্তু ব্যাঙের জীবন দুর্বিসহ হয়ে ওঠে । ঠিক তেমনি কালোদের নিয়ে শ্বেতাঙ্গদের বহু যুগের রঙ-তামাশায় শ্বেতাঙ্গদের বিস্তর আমোদ হলেও কালোদের ওষ্ঠাগত প্রাণের কথা কেউ ভাবে নি ।

‘ একি শুধু হাসিখেলা , প্রমোদের মেলা , শুধু মিছে কথা ছলনা ?
এ যে বুকফাটা দুখে গুমরিছে বুকে গভীর মরমবেদনা । ‘
কালো কি শুধু অন্ধকারের প্রতিনিধি ? কালো কি শুধুই রাত্রির রঙ ? উৎসারিত আলোর উৎস নয় ? সকল দ্বন্দ্ব বিরোধ মাঝে জাগ্রত ভালোর রঙ নয় ?

হ্যাঁ , কালো কর্তৃত্বের প্রতীকী রঙ । ব্যক্তিত্বের রঙ । সমস্ত রঙের উৎস । সমস্ত আলোর উৎস । সমস্ত সৌন্দর্যের প্রেরণারঙ কালো । কালো সহিষ্ণুতা ও কমনীয়তার রঙ ।

উদ্ভাবনী ক্ষমতা তথা সৃজনের রঙ । ভালোবাসার রঙ । ঘুরে দাঁড়ানোর রঙ । পড়ে গিয়েও বারবার উঠে দাঁড়ানোর রঙ । কালো বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার রঙ । লড়াই , আন্দোলন , সংগ্রাম ও চেতনার মূল রঙ কালো । কালো জীবনযুদ্ধে হারতে হারতেও শেষপর্যন্ত জিতে যাওয়ার রঙ ।

আরও পড়ুন- রাখঢাক ছেড়ে এবার রামধনু জোটে শিলমোহর সুকান্তর