‘মৃত্যুতেই অমর মোলয়েজ’, উৎপল সিনহার কলম

0
2
উৎপল সিনহা

‘ আগুনের হাত ধরে

শহীদ মোলয়েজ

বিশ্বময় স্বাধীন পাখি
করছে পারাপার । ‘

কি লিখেছিলেন কবি বেঞ্জামিন ? দেশের নৃশংস অপশাসকদের রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়া এই অবিস্মরণীয় কবি ফাঁসির আগের কয়েকদিন কীভাবে কাটিয়েছিলেন ? ১৯৫৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার আলেকজান্দ্রায় জন্ম বেঞ্জামিন মোলয়েজের । মৃত্যু প্রিটোরিয়ায় ১৮ অক্টোবর ১৯৮৫-তে । মাত্র ৩০ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে প্রায় ৩০০ বছরের কাজ কীভাবে করে গেলেন ক্ষণজন্মা মোলয়েজ ?

‘ যে বয়সে পুরুষ ভালোবাসে নারীকে , সে বয়সে তুমি ভালোবেসেছিলে তোমার মাতৃভূমি , দক্ষিণ আফ্রিকাকে ; যে বয়সে পুরুষ প্রার্থনা করে প্রেয়সীর বরমাল্য , সে বয়সে তোমার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়েছে ফাঁসির রজ্জুতে । যে বয়সে পুরুষের গ্রীবা আকাঙ্ক্ষা করে রমণীয় কোমল বাহুর ব্যগ্র-মুগ্ধ আলিঙ্গন ; সে বয়সে তোমাকে আলিঙ্গন করেছে মৃত্যুর হিমশীতল বাহু । ‘

কালো আফ্রিকার শ্বেত-শত্রুদের বিরুদ্ধে ঘৃণাগ্নি নিক্ষেপ করে হাসতে হাসতে মোলয়েজ এগিয়ে যান মৃত্যুর দিকে । মনে পড়ে , ‘ একটাই জীবন , জন্মভূমি , তোমাকে দিলাম । ‘ শৃঙ্খলিত মাতৃভূমির জয়গান গেয়ে অকালে কালের হাত ধরলেন দুরন্ত বিদ্রোহী ।

মোলয়েজ একাধারে কবি , কারখানার শ্রমিক , রাজনৈতিক কর্মী এবং তৎকালীন নিষিদ্ধ আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের অনুসারী । ১৯৮২ সালে একজন পুলিশ সদস্যকে হত্যার অভিযোগে পি ডব্লিউ বোথার বর্ণবাদী শাসকদল তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং মৃত্যুদণ্ডের সাজা ঘোষণা করে । আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের বিবৃতি অনুযায়ী জানা যায় এই হত্যাকাণ্ডে মোলয়েজ জড়িত ছিলেন না । তবু , সারা বিশ্বের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে ১৮ অক্টোবর ( ১৯৮৫ ) প্রিটোরিয়া কেন্দ্রীয় কারাগারে কবিকে ফাঁসিতে ঝোলায় বর্ণবাদী ঘৃণ্য বোথা সরকার । এরপর দক্ষিণ আফ্রিকার সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের আগুন ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে । পথে নেমে পড়ে উত্তেজিত মানুষজন । সারা বিশ্বে ধ্বনিত হতে থাকে অমর শহীদ মোলয়েজ স্লোগান । আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিন্দার ঝড় ওঠে বোথা সরকারের বিরুদ্ধে । ফাঁসি বরণ করার আগে মোলয়েজ লিখলেন ,
‘ আমি যা তাই হতে পেরে আমি গর্বিত …
অত্যাচারের ঝড় আসবে
আমার রক্তের বর্ষণে
জীবন দিতে পেরে আমি গর্বিত ।
আমার একাকী জীবন । ‘

এই কবিতাটি সারা বিশ্বের বর্ণবৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান বার্তা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে । ফাঁসির দিনকয়েক আগে তাঁর মায়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল বেঞ্জামিন মোলয়েজের । তাঁর চোখে হাত রেখে মা বলেছিলেন , ‘ কেঁদো না প্রিয় সন্তান , তোমার জন্য তো কাঁদছে সারা পৃথিবী , তুমি কেঁদো না । ‘
‘ শান্তি ‘ কবিতায় বেঞ্জামিন লিখেছেন ,
‘ শান্তি তুমি কোথায় ,
তোমাকে খুঁজি ল্যাটিন আফ্রিকা- আমেরিকায় ।
তুমি কত দূর ? ভীষণ প্রয়োজন তোমাকে আফ্রিকায় এ সময়ে ! ‘

দক্ষিণ আফ্রিকার কালো জনপদে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সহিংস প্রতিরোধ এবং বর্ণবাদী সরকারের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিদ্রোহীদের অন্যতম নির্ভীক কাণ্ডারী ছিলেন কবি মোলয়েজ । কৃষ্ণাঙ্গ সংখ্যাগরিষ্ঠ , যাঁরা দীর্ঘকাল ধরে শ্বেতাঙ্গ শক্তির চাপে চরম অবহেলিত ও বঞ্চিত অবস্থায় দিনাতিপাত করতেন এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে পরিগণিত হতেন , তাঁরা তো দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া কোনঠাসা অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর মরিয়া চেষ্টা করবেনই । আত্মনিয়ন্ত্রণ তথা আত্মরক্ষার অধিকার রক্ষার প্রয়াস তো মানবজাতির পবিত্রতম কর্তব্য । সেই মহান কর্তব্য পালন করতে গিয়েই ফাঁসির মুখোমুখি হতে দ্বিধা করেন নি কবি । আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস পুলিশ হত্যার দায় স্বীকার করলেও এই হত্যায় মোলয়েজের জড়িত থাকার অভিযোগ কখনোই স্বীকার করে নি । তবু ফাঁসি কার্যকর করেছিল কট্টরপন্থী বোথা সরকার । গোটা দেশের বিভিন্ন স্থানে ফাঁসির বিরুদ্ধে এবং কালো মানুষদের সমর্থনে গণ আন্দোলনগুলো হিংসাত্মক চেহারা নিয়েছিল কবির মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার সঙ্গেসঙ্গেই । চূড়ান্ত বলপ্রয়োগ করেও এই বিক্ষোভের আগুন নেভাতে পারছিল না নির্মম বোথা সরকার । উগ্র কৃষ্ণাঙ্গ বিক্ষোভকারীরা খোদ জোহানেসবার্গের ডাউনটাউনে ভয়াবহ সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল প্রশাসনের সঙ্গে । রক্তের বন্যা বয়ে যায় সেখানে ।
‘ A Strom of oppression will be followed by the rain of my blood , I am proud to give my life , my solitary life . ‘

মায়ের সঙ্গে মাত্র কুড়ি মিনিটের শেষ সাক্ষাতে বেঞ্জামিন বলেন , মা আমাকে তুমি বিশ্বাস করো মা , আমি খুন করি নি । আমি আন্দোলনে ছিলাম , কে খুন করেছে আমি জানি । কিন্তু আমার মৃত্যুদণ্ডের জন্য আমার কোনো দুঃখ নেই । সবাইকে বোলো আমাদের আন্দোলন সংগ্রাম যেন চলতে থাকে ।‌

আরও পড়ুন- আবার চোখ রাঙাচ্ছে ঘূর্ণাবর্ত! কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গে আবহাওয়া পরিবর্তনের সম্ভাবনা

আর তাঁর মা বলেন , আমি অবাক হয়ে দেখলাম আমার সন্তানের মানসিক দৃঢ়তা । মাতৃভূমির জন্য এবং কালো মানুষদের মুক্তির লড়াইয়ে মৃত্যুবরণের জন্য সে রীতিমতো তৈরি ।