কেন্দ্রীয় সরকারের দুমুখো নীতি, অন্ধকার ভবিষ্যত দেশের লক্ষাধিক বিএড ডিগ্রিধারীর

এনসিটির বিশেষজ্ঞরা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন যে তারা ভারতের সংবিধান মেনে চলেন এবং সুপ্রিম কোর্টের এই রায়কে স্বাগত জানাচ্ছেন। তাই তারা কোনওরকম হস্তক্ষেপ করবে না।

কামাল হোসেন

২০১৮ সালের জুন মাস নাগাদ খুব ঘটা করে NCTE গেজেট পাস করে বলা হয়েছিল “প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় এবার থেকে DLED এর সঙ্গে পরীক্ষায় বসবে B.ED রাও।” ঠিক যেমন নোট বন্দি ও দু হাজার টাকার নোট চালু ও তুলে নেওয়ার মতো আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল দেশ জুড়ে। এরপরই দেশের সমস্ত রাজ্যের সঙ্গে আমাদের রাজ্যেও বহু যুবক যুবতী প্রাইমারির চাকরি পাওয়ার জন্য ডিএলইএডের পরিবর্তে বিএডে ভর্তি হতে শুরু করে দিল। কারণ তারা জানত ডিএলইএড করলে শুধুমাত্র প্রাইমারি ও আপার প্রাইমারিতে বসা যাবে কিন্তু এই বিএড করলে একেবারে প্রাইমারি থেকে একাদশ দ্বাদশ বিদ্যালয়ের নিয়োগ পরীক্ষায় বসা যাবে।

তাই আশায় বুক বেধে সারা ভারতের বহু যুবক-যুবতী  কষ্ট করে টাকা জোগাড় করে বিএড কলেজে ভর্তি হতে লাগলো। আমাদের পশ্চিমবঙ্গেরও প্রায় দেড় লাখের উপরে বেশি যুবক-যুবতী ২০১৮ সাল থেকে বিএড ডিগ্রি পেয়েছিল। সারা ভারতের প্রায় সমস্ত রাজ্যের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে ২০১৮ পর থেকে এখনও পর্যন্ত প্রায় কোটি ছেলে-মেয়ে বি এড পরীক্ষায় অংশ নেয় এবং বিএড পাশ করার পরে বা চলাকালীন তারা সংশ্লিষ্ট রাজ্যের প্রাইমারি শিক্ষক শিক্ষিকা নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেয়। প্রায় ১০ লাখের মতো পরীক্ষার্থী টেট কোয়ালিফাইড করে।

এমনকি বছরে দুটো কেন্দ্রীয় সরকারের যে সেন্ট্রাল টেট হয় সেখানেও অনেকে এই বিএড ডিগ্রির জন্য অংশগ্রহণ করতে পেরেছিল এবং সফল হয়েছে। আমাদের রাজ্যে ২০১৮-১৯ থেকে বেশকিছু বিএড ডিগ্রিধারী প্রাইমারিতে চাকরি করছে। এবং বর্তমানে ২০১৪ সালের প্রাইমারি নিয়োগ প্রক্রিয়ার জন্য পশ্চিমবঙ্গে পার্সোনালিটি টেস্ট কমপ্লিট হয়ে গেছে এবং সেখানে প্রায় ১৪ হাজার শূন্যপদের মধ্যে সাড়ে আট হাজার বিএড ডিগ্রিধারীরা আছেন এবং ২০১৭ সালের টেট পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হল ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে এবং সেখানেও দেখা যায় প্রায় দশ হাজার শূন্যপদের জন্য সফল হয়ে প্রায় ৯ হাজারের মতো।

সবার দিন বেশ ভালই যাচ্ছিল এবং আনন্দে আত্মহারা হয়েছিল সারা ভারতবর্ষ তথা পশ্চিমবঙ্গের এই প্রাইমারি শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগ পরীক্ষায় টেট উত্তীর্ণ হয়। তাদের টেট সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছিল যা বৈধ থাকবে সারা জীবন। কিন্তু তিনদিন আগে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অনিরুদ্ধ বসুর ডিভিশন বেঞ্চ রাজস্থান হাইকোর্টের রায় বহাল রাখলেন। এবং নির্দেশ দিলেন, শুধুমাত্র ডিএলএডরা প্রাইমারি পরীক্ষায় বসতে পারবেন। কারণ, শিশুদের শিক্ষার জন্য একমাত্র যোগ্য মাপকাঠি তাদেরই আছে। কিন্তু বিএডদের যে যোগ্যতা সেই যোগ্যতার জন্য তারা প্রধানত কিশোর কিশোরীদের জন্য উপযুক্ত অর্থাৎ ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত বিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষিকা নিয়োগ পরীক্ষায় বসতে পারবেন।

আর এই খবর বিদ্যুৎ গতিতে ছড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের সমস্ত বি এড ডিগ্রিধারীদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। ভেঙে পড়েছেন ভারতের লক্ষ লক্ষ বিএড ডিগ্রিধারীরা। আরও বেশি করে শোকে ভারাক্রান্ত হয়েছেন সেই সমস্ত বিএড ডিগ্রিধারীরা, যারা বিভিন্ন রাজ্য তথা পশ্চিমবঙ্গের প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় টেট কোয়ালিফাইড করেছেন।

পশ্চিমবঙ্গে প্রাইমারি টেটের ২০১৪ সালের রেজাল্ট একেবারে কিছুদিনের মধ্যে প্রকাশ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু তা হতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। কারণ, সমস্ত বিএডদের বাদ দিতে হবে ইন্টারভিউয়ের পরে আপাতত তৈরি হওয়া প্যানেল থেকে এবং সমস্ত ডিএলএড ডিগ্রিধারীদের ডেকে তাদের আবার পার্সোনাল টেস্ট নেওয়া হবে। এবং একই ঘটনা ঘটবে ২০১৭ সালে যারা পাস করে বসে আছেল ইন্টারভিউয়ের অপেক্ষায়, তাদের ক্ষেত্রেও। তবে অনেকে খুব আশায় বুক বেঁধেছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের ভুলনীতির জন্য এই লক্ষ লক্ষ বেকার যুবক-যুবতীদের ভবিষ্যৎ নষ্টের পথে। তাই কেন্দ্রীয় সরকার বা এনসিটি সুপ্রিম কোর্টে নতুন ভাবে রিভিউ করাতে পারেন অথবা অধ্যাদেশ প্রণয়ন করে এই রায়টিকে খারিজ করে দিতে পারে। কিন্তু গত দুদিন আগে এনসিটির বিশেষজ্ঞরা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন যে তারা ভারতের সংবিধান মেনে চলেন এবং সুপ্রিম কোর্টের এই রায়কে স্বাগত জানাচ্ছেন। তাই তারা কোনওরকম হস্তক্ষেপ করবে না।

মাননীয় বিচারপতিদের পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, কোথাও তারা নির্দেশ দেননি যে এই রায়ের আগে যে সমস্ত বিএড ডিগ্রিধারীরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চাকরি করছেন তাদের চাকরি চলে যাবে। তাই নিশ্চিতভাবে যারা বিএড ডিগ্রি নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষক-শিক্ষিকা পরীক্ষায় সফল হয়ে বহাল তবিয়তে আছেন তাদের চিন্তার কোন কারণ নেই। এখানেই একজন শিক্ষক হিসাবে আমার একটি প্রশ্ন, আপামর ভারতবাসীর কাছে এবং প্রধানত বিজেপির কাছে বিশেষ করে বঙ্গ বিজেপি নেতৃত্বের কাছে, এই বিষয়টি নিয়ে তাদের মধ্যে কোনও আন্দোলন নেই কেন বা এই নিয়ে তাদের কোনও বলছেন না কেন। যেখানে সারা ভারতের লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়েদের জীবন নিয়ে ছেলেখেলা করলো বিজেপি শাসিত কেন্দ্রীয় সরকারের NCTE।

অথচ রাজ্যে কেন নিয়োগ হচ্ছে না বা রাজ্য নাকি নিয়োগের দুর্নীতিতে একেবারে ফেঁসে গেছে এই নিয়ে তারা গলা ফাটাচ্ছিলেন। তাহলে এটা তো বলতে হয় যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই দুই প্রাইমারি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে বসে আছেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের ২০১৮ সালের নীতির জন্য আজকের চাকরির পরীক্ষার্থীদের চাকরি পাওয়ার দিনক্ষণ বেশ কিছুদিন পিছিয়ে গেল। রাজ্যের বিজেপি নেতৃত্ব এই নিয়ে কেন মুখ খুলছেন না। সেই সঙ্গে বলতে চাই রাজ্যের অপর বিরোধী দলগুলোই বা কেন  এখন বিজেপির সুরে সুর মিলিয়ে চুপ হয়ে আছেন? এবং চাকরি হচ্ছে না বা চাকরিতে নাকি দুর্নীতির গন্ধ আছে, এই ভেবে যারা রাস্তায় বসে আছেন দীর্ঘদিন ধরে তাদেরকে খুব সহানুভূতির সঙ্গে আমি এই অনুরোধ করছি, তারা যেন এইটার বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। অথবা যে লক্ষাধিক পরীক্ষার্থী বিএড ডিগ্রী করেও প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় কোয়ালিফাইড করে আছেন, তারা কেন কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামছেন না বা তারা কেন প্রতিবাদে মুখরিত হচ্ছেন না। এই প্রশ্নটা কিন্তু শিক্ষিত  সমাজের বুকে রয়ে গেল।

 

Previous articleডার্বি অতীত, এএফসি কাপে মাছিন্দ্রা এফসিকে হারিয়ে পরবর্তী রাউন্ডে যাওয়াই লক্ষ‍্য বাগান কোচের
Next articleঅ.শান্তি থামছে না! স্বাধীনতা দিবসের আগে নুহতে উঠল কারফিউ, চালু ইন্টারনেট পরিষেবা