আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যায় (Jadavpur University)। র্যাগিং নামের ব্যধি আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ফেলেছে বিশ্ববিদ্যালয়কে। দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীরে এখন কলঙ্কের ছাপ। বাংলার বুকে এমন ব্যধি নি:সন্দেহে বেদনাদায়ক। একটি মৃত্যু ঘুমন্ত সকলকে যেন জল ছিটিয়ে জাগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এই যে জেগে ঘুমনো, এটা আমরা এখন স্বভাবে পরিণত করে ফেলেছি। বিস্তর জ্ঞান বিতরণ। তর্জনী তুলছি, কিন্তু ভুলে গিয়েছি বাকি তিনটে আঙুল নিজেদের দিকে তাক করা।

সমস্যার মূলে না গিয়ে প্রতি সন্ধ্যায় টিভির পর্দা আলো করে কত সব যুক্তি! কাগজে-কাগজে ভাষণের ছয়লাপ। বাংলার বিবেক সাজার আপ্রাণ চেষ্টা। কিন্তু একটু তলিয়ে ভাবব না? ভাবনার ঘরটা বাঙালির এত ফাঁপা হয়ে গিয়েছে যে এখন কিছু ঘটলেই আগে লক্ষ্য ; রাজনীতির রঙ লাগাও। বাঙালি তলিয়ে দেখার অভ্যাসটাও প্যান্ডোরা বক্সে বন্দি করে ফেলেছে।

কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ঐতিহ্য তৈরি হয় চতুর্মাত্রিক যোগসূত্রে। ১. শিক্ষক, ২. শিক্ষাকর্মী, ৩. পড়ুয়া ও ৪. অভিভাবক। কেন্দ্রবিন্দুতে নি:সন্দেহে শিক্ষকরা।

আজকের কথা নয়, বহু আগে থেকেই রটনা ছিল বললে ভুল হবে, সকলেই জানতেন, যাদবপুরে র্যাগিং হয়। যারা আশির দশক দেখেছেন, শুনেছেন, আজ প্রৌঢ়, তাদের জিজ্ঞাসা করুন। তাঁরাও বলবেন। ফলে হঠাৎ এটা শুরু হয়েছে, এমনটা তো নয়। তাহলে সেদিনের বা আজকের যারা শিক্ষক, তাঁরা কী করছিলেন? চার দশক পেরিয়ে যাওয়ার পরেও যখন র্যাগিং ব্যধির শব্দ থেকে যাদবপুর বেরতে পারেনি, তাহলে শিক্ষকরা কী করছিলেন? রাজ্যের এবং রাজ্যের বাইরের এক ঝাঁক সেরা পড়ুয়াদের পড়ালেন, ভাল নম্বর পেল, ভাল চাকরি পেল, ১ কোটি ২৫ লাখের প্যাকেজ পেয়ে কেউ কেউ খবরের কাগজে হেডিং হলো, শিক্ষকরা প্রচারে এলেন, যাদবপুরের র্যাঙ্ক বাড়ল… ব্যাস… কর্তব্য শেষ? ছেলে-মেয়েগুলো পড়াশোনার বাইরে কী করছে একবারও তাকিয়ে দেখলেন না? না, না ওদের দেখার জন্য বাড়িতে ধাওয়া করতে বলছি না, বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে ওরা কী করছে সেটাও তাকিয়ে দেখলেন না! জানতেন না? শোনেননি কিছু? কোনও অভিযোগ কানে আসেনি? দেখেও না দেখার ভান করে গেলেন? মনে মনে ভাবলেন, কী দরকার? পরের ছেলে গোল্লায় যাক সে তো পরমানন্দ! তাই না? ভুলে গিয়েছিলেন মার্টিন নিম্যোলারের (Martin Niemöller) কবিতাটা? ওরা যখন পাশের বাড়ির লোকটাকে মারতে এসেছিল, আমি কিছু বলিনি। কারণ, আমাকে তো মারেনি!.. যেদিন আমায় মারতে এল, সেদিন একজনও ছিল না প্রতিবাদ করার। আপনারাই তো পড়াশোনার পীঠস্থানে সংস্কৃতি তৈরি করবেন। পরিবর্তে নীরব-নিরুচ্চারিত দর্শকের ভূমিকায় অভিনয় করে গেলেন? জানেন তো, সিনেমায় দু’ধরনের ভিলেন দেখা যায়। এক ধরণের হলো, যারা মারামারি, খুন, জখম, তোলাবাজি করে। যাদের দেখলে, শুনলে ঠিকঠাক মাপা যায়। বুঝতে অসুবিধা হয় না চরিত্রটা। আর এক ধরনের হলো নিষ্পাপ মুখ নিয়ে থাকা সেই সব চরিত্র যাদের মগজে বুদ্ধি খেলা করে আর সেই বুদ্ধি বলে আপনি বাঁচলে বাপের নাম। তাঁরা প্রয়াত তপন সিনহার ‘আতঙ্ক’ ছবির ওই ডায়ালগটা আত্মস্থ করে ব্যবহারিক করেছেন… মাস্টারমশায় আপনি কিন্তু কিচ্ছু দেখেননি। শ্রদ্ধেয় মাস্টারমশায়রা, এবার কী দেখছেন? আপনার বাড়ির ছেলেটা বা মেয়েটিকে বারান্দা থেকে পড়ে যাওয়া রক্তাক্ত ছেলেটির সঙ্গে একবারও বসিয়েছিলেন? দয়া করে একবার বসান। দেখুন না আপনার শিরদাঁড়ায় হিমশীতল স্রোত বয়ে যায় কিনা!
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পিরামিডের শীর্ষে থাকেন, তাহলে পরের স্তরে শিক্ষাকর্মীরা। ওঁরা তো আধার। ওঁদের চোখ দিয়েই অনেকক্ষেত্রে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়কে দেখেন শিক্ষকরা। কারণ তাঁরা আনাচ-কানাচে থাকেন, কাজের সূত্রেই। কোনটা মিথেন গ্যাস আর কোনটা সালফিউরিক অ্যাসিড সেটা গন্ধেই বুঝতে পারেন। হস্টেলের দায়িত্বে থাকা ডিন অফ স্টুডেন্ট। আপনি কী করছিলেন? আপনি জানতেন না হস্টেলে হস্টেলে ইন্ট্রোডাকশনের নামে কী চলে? কারা পাণ্ডা? কী করা হয়? বিশ্ববিদ্যালয়ের গায়ে যাদের বাড়ি, তাঁরা বলছেন, পড়ুয়াদের অসভ্যতায় তাঁরা ছাদে পর্যন্ত উঠতে পারেন না। আর আপনাদের চোখ কিংবা কান কোনও কিছুকেই স্পর্শ করল না? কলেজের রেজিস্ট্রার। ঘটনার পর টানা চারদিন ফোন বন্ধ করে রাখলেন কোন আক্কেলে? পঞ্চম দিনে কলেজে এসে কান্নার নাটক করাটা কি একান্তই দরকার ছিল? বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন, এ মৃত্যুর দায় আপনাদের নয়? কলেজের হস্টেলে যা যা হয়ে এসেছে বা এখনও হয়ে চলেছে, তা বন্ধ করতে কোন পদক্ষেপটা করেছেন? কবার উপাচার্যর কাছে দরবার করেছেন? ইউজিসির গাইড লাইন তো পরের বিষয়। হস্টেলের বারান্দার ফুলের টবে গাঁজা চাষ, ওপেন থিয়েটারে ওপেন ড্রিঙ্কসের জলসা, দিনে-দুপুরে ছেলে-,মেয়েদের অন্ধকার খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা, কিছুই কী চোখে পড়েনি? আপনারা দেখেও না দেখার ভান করেছেন, ভেবেছেন বড় কোনও ঘটনা তো ঘটেনি, তাহলে কী দরকার। কিংবা পড়ুয়াদের কাছে জনপ্রিয়তা হারানোর ভয়ে রোজ ছেলে-মেয়েগুলোকে একটু একটু করে অধ:পতিত করেছেন।ওদের ভাবতে শিখিয়েছেন এটাই রীতি, নীতি, ঐতিহ্য, সঠিক। কিন্তু যেদিন লাগামছাড়া হয়ে গেল, সেদিন কী দেখলেন? শিক্ষক আর কর্মচারীদের মুখে কুলুপ। বলবেন কী? বললেই তো বুমেরাং হয়ে ফিরবে। তাই নীরবতা। কিন্তু এই নীরবতার শাস্তি কী?

দেশের অন্যতম সেরা পড়ুয়া যাদবপুরে। তারাই এই র্যাগিংকে প্রশ্রয় দিয়েছে, নিজেরা জড়িয়েছে। কেন এই বদভ্যাস? নিজেদের অবদমিত চাহিদা পূরণের অস্ত্র র্যাগিং? আমরাই ক্ষমতাশালী প্রমাণের হাতিয়ার? ইন্ট্রোডাকশন তো আসলে সোশ্যালাইজেশন। তাহলে সেটা শারীরিক আর মানসিক অত্যাচারের পর্যায়ে পৌঁঁছয় কীভাবে? কোন কারণে একটা ছেলেকে নোংরা ভাষায় গালাগালি দিয়ে জামা-কাপড় খুলিয়ে শারীরিক নিগ্রহ, নির্যাতন, যৌনাচারে বাধ্য করা হচ্ছিল? বিকৃত যৌনাচার মেটানোর বোড়ে কি এই কলেজে ঢোকা নতুন ছেলে-মেয়েরা? ছেলেটি তিন তলা থেকে পড়ে রক্তাক্ত। আর আপনারা নিজেদের বাঁচাতে টানা আধ ঘন্টা ধরে মিটিং করে গেলেন? কোন বিবেক আর মানবিকতার পাঠশালায় আপনারা ভাই পড়েছিলেন? যারা যারা সেদিন গায়ে সুতোটি না থাকা ছেলেটিকে রক্তাক্ত দেখেও হাসপাতালে না পাঠিয়ে বাঁচার যুক্তি খুঁজেছিলেন, তাদের ভাই বা বোন যদি ওই অবস্থায় পড়ে থাকতেন, তাহলে পারতেন ওভাবে মিটিং করতে? আপনারা ভাই পড়াশোনায় রাজ্যে সেরা বলে যা করবেন, তাই মেনে নিতে হবে? সেটার পক্ষে ঠেকে-আড্ডায় যুক্তি দিয়ে আল্ট্রা লেফটিস্ট, বুদ্ধিজীবী সাজবেন, তা কী করে হয়? হোক কলরব করে আপনারা নাকি রাজ্যে বিপ্লব করে ফেলেছিলেন! কই বাচ্চা ছেলেটি মারা যাওয়ার পরও তো পারতেন গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের নিয়ে রাস্তায় নামতে। আওয়াজ তুলতে তো পারতেন… র্যাগিং নয়, এসো বন্ধুত্ব করি। বাম, অতিবাম, মধ্যপন্থী সুবিধাবাদী, যেমনই সংগঠন করুন না কেন, কারওর বুকে পাটা হল না এ কথা বলার? এটার একটাই অর্থ, একটি মৃত্যু হয়ত আগামী কিছুদিনের জন্য যাদপবপুরে র্যাগিংয়ে ব্রেক লাগাবে। কিন্তু বীজ রয়ে যাচ্ছে, সুযোগ পেলেই ফের তা স্ফূলিঙ্গের আকার নেবে।

এবং শ্রদ্ধেয় অভিভাবকরা। আপনারা জানতেন না তা তো নয়। র্যাগিং হয়েছে, আপনাদের ছেলেমেয়েরাই আক্রান্ত হয়েছেন। আপনারা চুপ করে ছিলেন। দাঁতে দাঁত চেপে। ভেবেছিলেন বুঝি আমার ছেলেটা বা মেয়েটা পেরিয়ে যাক। তারপর গোল্লায় যাক সবকিছু। কিন্তু কখন কি ঘটে যায়, কিচ্ছু বলা যায় না। আর একটু আগে যদি সতর্ক হতেন, তাহলে আজকের পরিস্থিতি বোধহয় তৈরি হতো না। যদি অভিযুক্তদের বাবা-মা একটু খবর নিতেন, হস্টেলে ছেলে-মেয়ে কী করছে, তাহলে বোধহয় আজকের দিনটা দেখতে হতো না। জানার চেষ্টাও করেননি ওরা কোন বদভ্যাসে জড়িয়েছে! ধূমপান ব্যাক ডেটেড। পুলিশ বলছে গাঁজা-চরসও চলত। আর মদ্যপানের সোশ্যালাইজেশন হয়েছিল হস্টেল জুড়ে। ওপেন থিয়েটারের ছবিটা দেখেছেন? লজ্জা করেনি আপনাদের? কোথায় সন্তানদের সবক শেখাতে হয়, সেটা কি শুধু বইয়ের পাতাতেই থাকবে? কেউ একটা উড়ো চিঠি লিখেও কর্তৃপক্ষকে জানালেন না! থানায় একটা অভিযোগও জানালেন না? যিনি সন্তান হারালেন, তিনি তো বার বার মরেও বেঁচে রয়েছেন। কিন্তু যারা এখনও হাত গুটিয়ে তাঁরা ভাল থাকবেন তো!

এই নীরবতাই র্যাগিংয়ের প্যাসিভ বন্ধু। তাই আপাতত র্যাগিংয়ে বিরতি এলেও, এটা সাময়িক। চতুর্মাত্রিক দিক থেকে সমূলে উৎপাটনের উদ্যোগ না হলে, র্যাগিং ফিরবে যাদবপুরে। স্বমহিমায় ফিরবে। এর থেকে হয়তো আরও ভয়ঙ্করভাবে। শুধু সময়ের অপেক্ষা। এটাই কিন্তু ভবিতব্য। মিলিয়ে নেবেন।
