‘হাবিব তনবীর’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

ব্যাটা , নামটা কি রে তোর ?
আমি ? চরণ দাস চোর ।

সে বছর ভারি আকাল । সেটা কোন বছর ? আরে যেবার ইন্দ্র ভগবান খুব রাগ করেছিল , জষ্টি- আষাঢ় মাসেও আকাশ থেকে আগুন ঝরছিল , আর ছত্তিশগড়ের গাঁয়ে গাঁয়ে পোখর , মানে পুকুর আর কুয়ো শুকিয়ে যাচ্ছিল , লোকে খাবার জল পাচ্ছিল না তো চাষের জল ! তখন কুমারী , হসদেও , আহিরণ , মনিয়ারী — এইসব নদীতে বাঁধ তৈরি হয় নি , স্টপ ড্যাম তৈরি হয় নি , সেচের জন্য খাল কাটা হয় নি ।
সেই কথাই তো বলছি । তখন ছত্তিশগড়ে প্রতি তিন বছরে পালা করে ‘ দুকাল ‘ হতো , মানে আকাল পড়তো । গরিব মানুষ খেতখামারে কাজ পেতো না । সবাই খাপরার ছাদের ঘরে কাঠের দরজায় তালা ঝুলিয়ে বউ-বাচ্চা নিয়ে গাঁ ছেড়ে পালাতো ।

ওরা যেতো কোথায় ?
আড়কাঠি যেখানে কাজের লোভ দেখিয়ে নিয়ে যেতো । সে দিল্লি , হরিয়ানা , রাজস্থান হতে পারে , অথবা কলকাতা ।

কী কাজ পেতো তারা ?
ইটভাটার কাজ । বাড়ি তৈরির জোগাড়ের কাজ । কুলি-কামিনের কাজ । থাক ওসব কথা ।

তা আকালের মার সেবার একটু বেশি হওয়ায় ঘরে ঘরে হাহাকার । বেড়ে গেল চুরিচামারি । গরু- বাছুর থেকে শুরু করে ধুতি , গামছা , শাড়ি এমনকি শায়া- বেলাউজও বাদ যাচ্ছে না । গরিবদের তো সোনাদানা , টাকা পয়সা নেই । কিন্তু বড়লোকদের রাতের ঘুম কেড়ে নিলো এক ব্যাটা চোর । তার নাম চরণদাস । পুলিশের জালে ছিঁচকে চোরগুলো ধরা পড়লেও পাঁকাল মাছ চরণদাসের নাগাল আর কিছুতেই পায় না পুলিশ । একসময় এক ধনীর বাড়ি থেকে চুরি গেল সোনার থালা । ব্যাস , আর যায় কোথায় ! টনক নড়লো ভরা যৌবনে বিধবা রানির । তিনি ঘোষণা করলেন , কোতোয়াল , হাবিলদাররা চোর ধরে আনতে পারলে পাবে মোটা পুরস্কার ।

এদিকে চরণদাস , চুরি যার ‘ ধর্ম ‘ , সে তার গুরুর কাছে পাঁচটা প্রতিজ্ঞা ( পরণ ) করেছে ।
কোনদিন সোনার থালায় খাবে না ।
কোনো রানিকে বিয়ে করবে না ।
কোনদিন রাজা হবে না ।
কোনদিন হাতির পিঠে চাপবে না ।
কখনও মিথ্যা বলবে না ।
অবশ্যই তার মৃত্যুভয় আছে । কিন্তু তার এক কথা , ‘ পরণ তোড় নহি সকুঁ ‘ ।
আশ্চর্য ব্যাপার তো ! চুরি করবে , আবার সত্যিও বলবে ?

এই কাহিনী নিয়েই তো কিংবদন্তি নাট্যকার , নট ও নির্দেশক হাবিব তনবীর- এর সাড়া জাগানো নাটক
‘ চরণদাস চোর ‘ । প্রখ্যাত হিন্দি সাহিত্যিক বিজয়দান দেথা’ র রচনা অবলম্বনে নির্মিত এই নাটকটি । ছত্তিশগড়ের রায়পুরে নিজের শিকড়ের মাটিতে হাবিব তনবীর গাঁয়ের আদিবাসী ও লোকশিল্পীদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘ নয়া থিয়েটার ‘ । তাঁরাই বিখ্যাত করে তুলেছিলেন ‘ চরণদাস চোর ‘ নাটকটিকে । এরপর ছত্তিশগড়ি লোকনাট্য অভিনীত হতে লাগলো গ্রামে গ্রামে । পরে দেশকালের সীমা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে গেলো সারা বিশ্বে ।

হাবিব অবশ্য এর অনেক আগেই লন্ডন এবং ব্রিস্টল-এ ব্রিটিশ রয়্যাল আকাদেমি অফ ড্রামাটিক আর্টস-এ আধুনিক নাট্যকলার শিক্ষা গ্রহণ করেন । জার্মানিতে বের্টোল্ট ব্রেখটের থিয়েটার ‘ বার্লিনার এনসেম্বল ‘ ভীষণ প্রভাবিত করেছিল হাবিবকে । সমকালীন ভারতীয় নাট্যকলার এই প্রবাদপুরুষ মঞ্চমায়া ত্যাগ করে চিরদিনের মতো চলে যান ৮ জুন , ২০০৯ সালে ।‌

জন্মেছিলেন ১ সেপ্টেম্বর ,ছত্তিশগড়ের রায়পুরে , ১৯২৩ সালে । তাঁর অনেক পরিচয় । উর্দু ও হিন্দি নাট্যকার , নির্দেশক , চলচ্চিত্রাভিনেতা , রেডিও প্রযোজক , কবি ও সাংস্কৃতিক সংগঠক । তিনি নির্মাণ করে গেছেন এক স্বতন্ত্র নাট্যভাষা , লোকগান ও লোকনৃত্যকে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত করেছেন থিয়েটারের সঙ্গে । তিনি বলতেন , নাটক দেখে যদি দর্শক নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরে যান তাহলে সেই নাটক ব্যর্থ । লোক আঙ্গিক ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সহজাত নৈপুণ্যকে নিপুণভাবে কাজে লাগিয়ে ভারতীয় নাটকের ইতিহাসে এক নতুন শৈলীর পত্তন করেন হাবিব ।

তিনি বলতেন , প্রশ্ন তুলবে নাটক । দর্শকদের ভাবাতেই হবে ।
গাঁও কা নাম শসুরাল মোর নাম দামাদ , কামদেওকা আপনা বসন্ত রিতু কা সপনা ইত্যাদি তাঁর জনপ্রিয় নাটক । তাঁর জীবদ্দশায় তিনি সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার , জওহরলাল নেহরু ফেলোশিপ , কালিদাস সম্মান , পদ্মশ্রী ও পদ্মভূষণ সহ বেশ কয়েকটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন । ‘ চরণদাস চোর ‘ নাটকের জন্য ১৯৮২ সালে এডিনবার্গ আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসবে তাঁকে ফ্রিংজ ফার্স্টস অ্যাওয়ার্ডে সম্মানিত করা হয় । আগ্রা বাজার , শতরঞ্জ কে মোহরে , লালা সেহরত রায় , মিট্টি কি গাড়ি , উত্তর রাম চরিত , বাহাদুর কালারিন , ব্রোকেন ব্রিজ , পোঙ্গা পণ্ডিত , দেখ রহে হ্যায় ন্যায় , হিরমা কি অমর কহানি ইত্যাদি তাঁর সৃষ্ট নাটক ।  আগ্রা বাজার নাটকটি মঞ্চস্থ করার পরেই তাঁর পরিচিতি বাড়ে । খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে । এই নাটকে হাবিব কবিতা ও সঙ্গীতকে ব্যবহার করেন নাটকের অন্তর্নিহিত শক্তি হিসেবে , বাইরের অলঙ্কার হিসেবে নয় । ঔপনিবেশিক ভাবনা থেকে সরে এসে নিজস্ব লোকসংস্কৃতির পরিমণ্ডলে নাটক নির্মাণের ভাবনা তাঁর ছিলই । জার্মানি গিয়ে ব্রেখটের নাটকগুলি দেখে তাঁর এই ভাবনা আরও জোর পায় এবং তখনই আদিবাসী ও লোকশিল্পীদের নাটকের আঙিনায় নিয়ে আসার স্বপ্ন দেখা শুরু করেন । অভিজ্ঞতাহীন ও অপ্রশিক্ষিত মেহনতি মানুষদের নিয়ে গঠিত তাঁর ‘ নয়া থিয়েটার ‘ ভারতীয় নাট্যকলার ইতিহাসে এক সুদূরপ্রসারী বাঁকবদল । মঞ্চে কখনো ৫২ জন , কখনও বা ৭২ জন কুশীলবদের সক্রিয় বিচরণ বড়ো সহজ ব্যাপার নয় । হাবিবের হাতে গড়া নাট্যকর্মীরা যা বারবার করে দেখিয়েছেন । তাঁর নাটকে যুগের চাহিদা ক্ষণে ক্ষণে মূর্ত হয়ে ওঠে । তাঁর অসামান্য পরিমিতিবোধ দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে ।

আরও পড়ুন- রাজনীতির পাড়ে হাঁক-ডাক মদনের! সাগর দত্ত হাসপাতাল নিয়ে বিস্ফো.রক অভিযোগ

Previous articleতাঁর বুদ্ধিতেই রক্ষা পেয়েছে কাঞ্চনজঙ্গা! ‘এমন ছেলের জন্য গর্ব হয়’, মুরসালিমের বাড়িতে গিয়ে বললেন রাজ্যের মন্ত্রী
Next articleসমুদ্র ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মেলবন্ধন ঘটিয়েছে পর্যটকদের অত্যন্ত প্রিয় ‘সান সিটি’ !