‘বাঙালি দুর্গাকে ভোলে নি’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

সেই কাশফুল , সেই শরৎকাল , সেই দুর্গা ।

তফাৎ শুধু কাঠামোয় ।
মহিষাসুরমর্দিনীর বদলে নিশ্চিন্দিপুর গ্রামের প্রাণবন্ত বালিকা । অকাল বোধনের বদলে অকাল বিসর্জন । আর , কী আশ্চর্য , মৃত্যুতেই অমর সেই দুরন্ত কিশোরী ! বেঁচে থাকার চেয়েও ঢের বেশি জীবন্ত মৃত দুর্গা ।

কাশবনে আখ চিবোতে চিবোতে দুর্গার কানে আসে অদ্ভুত এক আওয়াজ । সঙ্গে সঙ্গেই ভাই অপুর হাত ধরে ছুট রেললাইনের দিকে । তারপর দেখা যায় অপু রেলগাড়ি দেখছে । দুর্গা ধারেকাছে নেই । ভীষণ জ্বরে কাবু বিছানায় ধুঁকতে থাকা দিদি ভাইকে বলছে , ‘ আমায় একদিন তুই রেলগাড়ি দেখাবি ? ‘

ফ্রয়েড বলছেন , যে শোকের উদযাপন হয় নি , যে হারানোর ক্ষতি কখনও নিরুপিত হয় নি , মনের আড়ালে তা বিষাদের সুর হয়ে বাজে । জানা যায় , পথের পাঁচালী উপন্যাসে বিভূতিভূষণ প্রথমে দুর্গাকে রাখেন নি । শুধু অপু ছিল । একদিন হঠাৎ ভাগলপুরের রঘুনন্দন হল-এ একটি মেয়েকে দেখেন যার এলোমেলো চুল হাওয়ায় উড়ছে । তার চোখে যেন কি এক অবর্ণনীয় বার্তা , অপূর্ব আহ্বান , আর মধুর বেদনার এক অদেখা জগৎ । সেই মুহূর্তে লেখকের মনে সৃষ্টি হলো দুর্গার । মনে হলো , এই বালিকা ছাড়া তাঁর লেখা ব্যর্থ , নির্জীব ।

আর একটি মেয়ের কথাও এ প্রসঙ্গে আসে । সাহিত্যের ইতিহাসকার সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের বয়ান থেকে জানা যায় বিভূতিভূষণের সবচেয়ে ছোটো বোন , বাড়ির সকলের আদরের মেয়ে , যাকে ‘ দুর্গা ‘ বলে ডাকতেন লেখক , অল্প বয়সে মারা যায় । এই বোনটিকে ভুলতে পারেন নি বিভূতিভূষণ । এই কি সেই প্রকৃতিকন্যা , অপুকে পৃথিবীর পথে অনেকটা এগিয়ে দিয়ে , গ্রামবাংলার অনিঃশেষ সৌন্দর্যের পাঠ দান করে যে নিজেই একদিন অসময়ে হারিয়ে গেলো ?

পৃথিবীর প্রতিটি তুচ্ছাতিতুচ্ছ জিনিসের প্রতি যে বালিকার ছিল তুমুল আকর্ষণ । ভাঙা আয়নায় বনফুলের সাজ , সিঁদুরের কৌটো চুরি , লক্ষ্মীর চুপড়ি থেকে আলতা নেওয়া আর বনভোজনের রান্নায় আগামীতে স্বামীগৃহে যাওয়ার আভাসের পরতে পরতে কিশোরী দুর্গার অতৃপ্ত আকাঙ্খার অতিদ্রুত আনাগোনা । বিভূতিভূষণ লিখেছেন , ‘ দুর্গা আজকাল যেন এই গাছপালা , পথঘাট , এই অতি পরিচিত গ্রামের অন্ধিসন্ধিকে অত্যন্ত বেশি করিয়া আঁকড়াইয়া ধরিতেছে । … তাহার সোনা খোকা ভাইটি … মন হুহু করে … তাহাকে ফেলিয়া সে কতদূর যাইবে ? … তাহার মনে হয় একটা কিছু তাহার জীবনে শীঘ্রই ঘটিবে … ‘ ।

জীবনের পালা যে তার দ্রুত সমাপ্ত হয়ে আসছে তার আভাসও হয়তো পেয়ে থাকবে সে । বড়ো দুরন্ত মেয়ে । বনেবাদাড়ে একা একাই ঘুরে বেড়ায় । ঝোপের আড়ালে আবডালে কোথায় কী পাওয়া যায় সবই জানা আছে তার । বনজঙ্গল ঢুঁড়ে সে সংগ্রহ করে আম , জাম , নারকেল , মাকাল ফল , কামরাঙা , আরও কত কি ! বনজঙ্গল তার প্রসাধনেরও জোগান দেয় । ওড়কলমি ফুলের নোলক পরতে সে ভালবাসে । শুকনো নাটা ফল আর খাপরার কুচিতে ভরে ওঠে তার সাধের খেলনার বাক্স । বালিকা দু্র্গার গড়ন রোগাসোগা । গায়ের রঙ একটু চাপা । হাতে কাঁচের চুড়ি , মাথার চুল রুক্ষ , ডাগর ডাগর চোখ , মুখের গড়ন মন্দ নয় ।

যে নীরেন নিশ্চিন্দিপুর ছেড়ে একদিন চলে যায় তাকেই মনে মনে বরণমালা পরায় দুর্গা । তার বিয়েতেও রানু দিদির বিয়ের মতো বাজি-বাজনার রোশনাইয়ের স্বপ্ন দেখে সে । সুদর্শন পোকাকে দুর্গা জানায় তার বাসনার কথা । জানায় তার প্রার্থনা।

একটা মৃত্যু কতটা শোকাবহ হতে পারে ? একটা মৃত্যুর অভিঘাত কতটা সুদূরপ্রসারী হতে পারে ? ইন্দির ঠাকরুন , হরিহর , সর্বজয়া , সকলের মৃত্যু হয়েছে । আর দুর্গার মৃত্যু হয়েছে সবার আগে । দস্যি মেয়ে তার সমস্ত সাধ-আহ্লাদ মুলতুবি রেখে হঠাৎই বিদায় নিয়েছে সংসার থেকে । কিন্তু বাঙালি কিছুতেই ভুলতে পারে নি তাদের আদরের ছোট্ট দুর্গাকে । আবহমান হাহাকার অতিক্রম করে আজও সবচেয়ে বেশি বেঁচে আছে অকাল প্রয়াত কন্যাটি । পথের পাঁচালী উপন্যাসে এবং চলচ্চিত্রে দুর্গার মৃত্যুতে যতটা শোকাভিভূত হয়েছেন বাঙালিরা , বাস্তবে তাঁদের কোনো প্রিয়জনের প্রয়াণেও বোধহয় ততটা বিমূঢ় বোধ করেন না । মৃত্যুটির রচয়িতা বিভূতিভূষণ এখানেই অনন্য ।

বালিকা দুগ্গির বয়সও আর বাড়ে নি । সে আজও কারোর ছোট্ট দিদি , কারোর ছোট্ট বোন , কারোর আদরের ছোট্ট মেয়ে । পথের পাঁচালী , অপরাজিত ও অপুর সংসারের দীর্ঘপথ পেরিয়ে ছোট্ট ভাইটির হাত ধরে কাশবন ভেদ করে আজও সে ছুটতে থাকে রেললাইনের দিকে । বালক ও বালিকার নিশ্চিন্দিপুর গ্রামের বাইরে সেই প্রথম পা রাখা । মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখা বিদ্যুতের অতিকায় খুঁটি , টেলিগ্রাফের তারের অদ্ভুত রিনরিনে শব্দ , আর দারুণ বেগে ছুটে চলা রেলগাড়ি ! শরৎকাল , কাশবন , দেবীর আবাহন , বিসর্জন । বালক অপুর জীবনে অকালে নেমে আসা অনন্ত বিষাদ ।

যাও অপু , অচেনা পৃথিবীকে চিনে এসো । দুগ্গা দুগ্গা । জয় দুর্গা।

আরও পড়ুন- পাকিস্তানকে দুরমুশ করতেই, ভারতীয়  টিমকে সংবর্ধনা দিতে নিমন্ত্রণ পাঠালেন রাজ্যপাল!

 

 

Previous articleএবার সুরুচি বাংলার কৃষ্টি-সংস্কৃতির পীঠস্থান! উদ্বোধন করলেন মুখ্যমন্ত্রী
Next articleBreakfast news : ব্রেকফাস্ট নিউজ