Saturday, August 23, 2025

নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ, উৎপল সিনহার কলম

Date:

Share post:

উৎপল সিনহা

” মানুষ বুড়ো হয়ে যায় বলে স্বপ্নের পেছনে ছোটা বন্ধ করে দেয় এটা ঠিক নয় , বরং তারা স্বপ্নের পেছনে ছোটা বন্ধ করে দেয় বলেই বুড়ো হয়ে যায় । ” ( লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা )

একশো বছরের নিঃসঙ্গতার কথক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ নোবেল পুরস্কার গ্রহণের পর তাঁর ভাষণে বলেন , ” এই পুরস্কার আসলে লাতিন আমেরিকার সব কবির , ভিখারিদের , বাজনদারদের , দার্শনিকদের ,
যুদ্ধবাজদের আর লম্পটদের জন্য ” ।

দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে আশ্চর্য সব কথা বলে গেলেন ম্যাজিক রিয়ালিজমের অন্যতম গুরু । এখানে হুবহু তুলে ধরা যাক সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত কিছু অংশ :

নিজেকে নিয়ে রসিকতা করার সময় মাঝেমাঝে আমার মনে হয়েছে যে আমার কোনো সাহিত্য শিক্ষা নেই । কল্পনা ও অভিজ্ঞতা মিশিয়ে আমি লিখি । আমার লেখালিখির গুরু হলেন ফকনার , হেমিংওয়ে প্রমুখ ।
এঁরা তো পরদেশী লেখক । কলম্বিয়ার শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে নিদারুণভাবে কমই জানি আমি । কলম্বিয়া অবশ্যই আমাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে , তবে তা কিন্তু এখানকার সাহিত্য নয় । কোনো বইপত্র নয় ‌। আমার মনে হয় যা আমার চোখ খুলে দিয়েছে তা হলো সঙ্গীত , বিশেষ করে লোকগীতি । আজ থেকে তিরিশ বছর আগে ম্যাগডালেনা উপত্যকার বাইরে এক কোনায় চর্চা হতো এর । আর আমার মনোযোগ ছিল মূলত গানগুলোর ফর্মের দিকে , এগুলো কিভাবে একটা কাহিনী বয়ান করে , একটা গল্প বলে চলে … খুব সাধারণ ও স্বতস্ফূর্ত এর কারুকাজ । তারপর যখন লোকগীতি বানিজ্যিকভাবে আসা শুরু হলো , দেখা গেলো ভাব আর ছন্দই প্রধান হয়ে উঠলো । এই লোকগীতিই যেন আমার দাদু গাইতেন , আমার মনে আছে । পরে যখন আমি স্প্যানিশ রোমান্সেরো-এর ব্যালাড লেখা শুরু করলাম , দেখলাম যে এদের মধ্যে অভূতপূর্ব নান্দনিক মিল রয়েছে । রোমান্সেরো-এর মধ্যে আমি আমার লোকগীতিকে আবিষ্কার করলাম ।

সঙ্গীতই আমাকে সব থেকে বেশি প্রশান্ত করে ।‌ মাঝেমাঝে মানুষ খুব অন্তরঙ্গ হয়ে ওঠে , এমনকি গোপন কথা নিয়ে আলোচনা করার সময় মানুষ যেমন পরস্পরের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে , তার চেয়েও বেশি আপন হয়ে ওঠে যখন তারা সঙ্গীত নিয়ে আলোচনা করে । সকালবেলা মোৎসার্ট শোনাই ভালো । ড্যানিয়েল স্যাটোস , মিগুলিয়েটো ভ্যালডেস প্রমুখ সঙ্গীতজ্ঞদের তাত্বিকেরা ভালো চোখে না দেখলেও আমি কিন্তু তাঁদের থেকে প্রচুর নিয়েছি । আমি কোনো জিনিসের মধ্যে বিভেদ তৈরি পছন্দ করি না ।

প্রতিটি জিনিসেরই একটা মূল্য আছে । সঙ্গীত থেকে আমার পাওয়ার শেষ নেই । প্রতিদিন আমি অন্তত দু’ঘন্টা গান শুনি । আমার মানসিক অবস্থা ঠিক রাখে সঙ্গীত । আমার মানস ভ্রমণের প্রধান সহায়ক সঙ্গীত।
লোকে বলে যেখানে বই থাকে সেটাই ঘর । আমার মনে হয় যেখানে গানের রেকর্ড আছে সেটাই আমার ঘর। আমার পাঁচ হাজারের বেশি রেকর্ড আছে ।

এবার কবিতার কথা । মূলত আমার লিটারারি ব্যাকগ্রাউন্ড হলো কবিতা , কিন্তু তা হলো বাজে কবিতা । এই বাজে কবিতাগুলোই আমার কাছে ভালো কবিতা হিসেবে আসতো । স্কুলের পাঠ্য বইয়ের কবিতা পড়েও আমি প্রভাবিত হয়েছি । তবে বিশ্বসাহিত্য বুঝতে হলে কলম্বিয়ার কবিতার কাছে আসতে হবে ।‌ স্প্যানিশ সাহিত্যও আমি প্রচুর পড়েছি। বিভিন্ন ধরনের লেখা । কোনো বাছবিচার করি নি । আমি জানি না আমি কিভাবে উপন্যাস লেখায় জড়িয়ে গেলাম । কবিতাই আমাকে বেশি আন্দোলিত করতো । আমি মনে করতে পারছি না ঠিক কখন আমি উপলব্ধি করলাম যে , আমি যা বলতে চাই তা উপন্যাসেই সম্ভব । সম্ভবত কাফকার মেটামরফসিস ছিল আমার কাছে একটা বিবর্তনের মতো। এটা পড়ার পর প্রায় ৬ বছর আমি কিছু লিখতে পারি নি ।

আমার দাদুও গভীর কোনো বিষয় এমনি নির্বিকারভাবে বলে যেতেন । আমি তখন ভাবতে শুরু করলাম মানবসভ্যতার শুরুর পর থেকে আজ পর্যন্ত জগতে কী কী ঘটে গেছে ।‌ তখন আমি লেখাপড়া ছেড়ে দিলাম।‌ কিছুদিন পর গল্প লেখা শুরু করলাম । তারপর বোগোটা ছেড়ে দিলাম দাঙ্গার জন্য । উপকূল ছেড়ে চললাম অন্যত্র। সংবাদপত্রে চাকরি জোটালাম । ফেলে আসা সেই উপকূলকে আমি বিশদে ব্যাখ্যা করতে চাই না ।‌ তারপর ক্রমাগত লিখতে লাগলাম যেন একটা জ্বরের ঘোরের মধ্যে লিখে চলেছি ।

‘ লিফস্টর্ম ‘ বইটি আমার খুব পছন্দের । এর লেখকের প্রতি আমার সমবেদনা আছে ।‌ আশ্চর্য ব্যাপার । একটা ২২-২৩ বছরের ছেলে যে সে আর জীবনে কিছুই লিখবে না। সে মনে করে এটাই তার একমাত্র পরিবর্তন । তার যা কিছু মনে আছে সমস্তই সে ভুলে যেতে চায় । শিল্প-সাহিত্যের নানা ধরনের কৌশল যা সে শিখেছে বা বড়ো লেখকদের মধ্যে যা যা সে দেখেছে তার সমস্ত কিছু সে ভুলে যেতে চায় । ক্রমে ক্রমে আমি উপলব্ধি করি যে , কাফকার বাস্তবতা আর আমার ফেলে আসা উপকূলের বাস্তবতা এক নয় ।

আমেরিকান ঔপন্যাসিকদের আমি যথাযথভাবে চিনতে শিখলাম । আমেরিকান বাস্তবতার তীব্র রূপান্তর আর প্রকাশ ছিল ফকনারের লেখায় । তাঁদের কাছ থেকে আমি একটা বীক্ষণ শক্তি পেয়েছি ।‌ বেশ্যাপাড়া , শহর , সঙ্গীত ( বিশেষত লোকগীতি ) আর দৈনন্দিন জীবন মিলেমিশে একাকার মাথার মধ্যে , ভাবনায় । কঠোর বাস্তবতাকে উন্মোচিত করা নয় , একটু অন্যভাবে উপস্থাপন করতে চেয়েছি । সংকেত নির্ভর লেখা লিখতে চেয়েছি । ( মার্কেজ : অটাম )

একসময় এক মিনিটের জন্য একটা কফির কাপ হাতে এক কোনায় বসলে আমি এমন একটা পৃথিবী খুঁজে পেতাম যা খুবই আলাদা । কিন্তু যখন উপকূল ছেড়ে আমাকে চলে যেতে হলো তখন বুঝলাম বাস্তবতা কাকে বলে । বই – পড়া পৃথিবী আর বাস্তব দুনিয়ার একটা সম্পর্ক সেদিন খুঁজে পেলাম ।

আরও পড়ুন- বাংলার রাজনীতি মানেই দুর্নীতি! কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে কমিশনে নালিশ তৃণমূলের

spot_img

Related articles

সঠিক পরিকল্পনাই ডায়মন্ডহারবারের সাফল্যের চাবিকাঠি, মনে করছেন আকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়

মাত্র তিন বছরের ক্লাব। কিন্তু কী অসাধারণ সাফল্য। কলকাতা লিগ, আইলিগ থ্রি থেকে আইলিগ টু জিতে এবার আইলিগের...

অসংগঠিত শ্রমিক-ক্ষেত্রে পথ দেখাচ্ছে বাংলা: সাহায্য পেলেন ৭২০ শ্রমিক

একের পর এক নতুন প্রকল্প, অসংগঠিত শ্রমিকদের দাবিদাওয়া নিয়ে লাগাতার আলোচনা, তাঁদের পরিবারের প্রতি নজর রাখার ব্যাপারে তৎপর...

প্রাপ্য চায় বাংলা, উপহার না: মোদিকে জবাব তৃণমূলের

বাংলার মানুষ উপহার চায় না, প্রাপ্য চায়। উপহার দিয়ে বাংলার মানুষকে অপমান করবেন না। বাংলায় বরাদ্দ নিয়ে শুক্রবার...

অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ব্যর্থ শাহ, শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা মোদির: কটাক্ষ তৃণমূলের

অনুপ্রবেশ ইস্যুকে বার বার জাগিয়ে তুলে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার আদতে নিজেদের ভুল নিজেরাই চোখ আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।...