Tuesday, August 26, 2025
উৎপল সিনহা

মানুষের মৃত্যু হয় । সে তো ব্যক্তির মৃত্যু । কিন্তু মানব থেকে যায় । সময় তো এক পরম্পরা । এক সময়ের হাত থেকে ব্যাটন চলে যায় অন্য সময়ের হাতে । এভাবেই ব্যাটন হস্তান্তরিত হতে থাকে সময়ের হাত ধরে । এ এক অন্তহীন প্রক্রিয়া । তাই কবি জীবনানন্দ লেখেন, ‘ মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায় ‘ ।
আমাদের প্রত্যেকের জীবন একটা সীমিত কালে । সেটা ব্যক্তিকাল । কিন্তু আমরা সকলেই তো মানবজাতির অংশ । তাই ব্যক্তিমানুষের মৃত্যু হলেও মানবপ্রজাতির মৃত্যু হয় না । সঙ্গে এও উল্লেখ্য যে , প্রত্যেক মানুষ একটা মানবকালেরও অংশ ।

আবার মানবপ্রজাতিও অনন্তকাল এই পৃথিবীতে নেই। মানবের জন্মের আগেও ছিল এই মহাবিশ্ব , ফলে মানুষমাত্রেই সেই মহাকালেরও অংশ । তাই ব্যক্তিমানুষের বিচরণ তার ব্যক্তিকাল , মানবকাল আর মহাকালের বিপুল সীমানার ভেতর । এখানে কোথায় যেন গুটিগুটি পায়ে চুপিচুপি এসে দাঁড়ায় আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব । জীবনানন্দ খুব সচেতনভাবেই ‘ সময়গ্রন্থি ‘ শব্দটি ব্যবহার করেছেন । মনে পড়ে কবি প্রণবেন্দু দাশগুপ্তের একটি অসামান্য লাইন , ‘ সুতোয় সুতোয় গাঁথা সবার জন্মের নাড়ি ‘ । এটা যারা জানে না তারা রাত জেগে এপাশ ওপাশ করে ।

এ প্রসঙ্গে অবধারিতভাবে এসে এসে যায় জীবনানন্দের ‘ ঘোড়া ‘ কবিতাটি । যেখানে রয়েছে ‘ নিওলিথ স্তব্ধতা ‘ , ‘ প্যারাফিন লণ্ঠন ‘ প্রভৃতি শব্দবন্ধ । সেই নিওলিথিক যুগ , যার পত্তন সম্ভবত দশ হাজার খ্রীষ্টপূর্বাব্দে এবং সমাপ্তি ২২০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে । নতুন প্রস্তর যুগ এরই অন্য নাম । প্রত্নতাত্বিক একটি সময়কালের সঙ্গে নিজের সমকালকে জুড়ে দিয়েছেন কবি । আসলে সময় তো অন্তহীন । একটি সময়কাল আরেকটি সময়কালের অংশ , তার মানেই অখণ্ড সময়কালের অংশ , ঠিক ব্যক্তিমানুষের জীবনের মতোই।

মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশের এক উল্লেখযোগ্য সময়কাল নিওলিথিক যুগ । আর প্যারাফিন ? জৈব রসায়নে প্যারাফিন হলো সম্পৃক্ত হাইড্রোকার্বন । এরা সাধারণ বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে না। আবার হ্যাজাক , যাকে বলা হয় পেট্রোম্যাক্স , কেউ কেউ এটাকে প্যারাফিন প্রেসার লণ্ঠন বলেন । এ বাতিটি ইদানিং লুপ্তপ্রায় । মনে রাখতে হবে এক অর্থে প্যারাফিন কিন্তু ‘ আসক্তিহীন’ ! কবি কি এড়িয়ে যেতে পারেন আসক্তিহীনতা ?

আমরা যাইনি ম’রে আজো —
তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয় ;
মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায়
কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে ,
প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেন —
এখনো ঘাসের লোভে চরে
পৃথিবীর কিমাকার ডাইনামোর ‘ পরে ।
আস্তাবলের ঘ্রাণ ভেসে আসে
এক ভিড় রাত্রির হাওয়ায় ; …

কবি এসব দৃশ্য দেখছেন একটি পাইস রেস্তোরাঁয় বসে। কার্তিকের জ্যোৎস্নাপ্লাবিত প্রান্তরে ঘাস খাচ্ছে কতগুলো ঘোড়া , ভেসে আসছে আস্তাবলের গন্ধ , যেখানে কলে ঘোড়াদের জন্য খড় কাটা হচ্ছে । রেস্তোরাঁর টেবিলে কতকগুলো কাপ ( চিনামাটির সাদা কাপ ? ) সম্ভবত উল্টোনো । দেখে মনে হয় যেন কয়েকটি বেড়ালছানা গুটিসুটি মেরে ঘুমোচ্ছে । বাইরে যেন এক ভিড় রাত্রির হাওয়া । সেই হাওয়া সব ঘোড়াগুলোকে ছুঁয়ে একসময় নিভিয়ে দেয় আস্তাবলের প্যারাফিন লণ্ঠন।

কী এক অপার রহস্যে যেন আচ্ছাদিত এ কবিতা । এই ঘোড়াগুলো কবেকার ? এরা কি কোনো এক মহীনের? নাকি প্রস্তরযুগের ? আবার সেই একই প্রসঙ্গ । প্রস্তর যুগের সব ঘোড়াগুলো তো মারা গেছে সেই কবে ! কিন্তু তাদের ‘ ঘোড়াত্ব ‘ ? তাদের স্বভাব , তাদের চরিত্র , তাদের বৈশিষ্ট্য ? সে সবের তো মরণ হয় না কালের পর কাল ।

এখানে মনে পড়ে অরুণ মিত্রের কবিতা ‘ রিক্সাওয়ালা’। রিক্সাওয়ালার মৃত্যু হয় , কিন্তু রিক্সা চলতেই থাকে বিরামহীন । একজন মারা গেলে অন্যজন চালায় সেই রিক্সা । দেশে দেশে , কালে কালে , গ্রামেগঞ্জে , নগরে ও প্রান্তরে রিক্সার চাকাগুলো কখনও থামে না । চাকাগুলোয় যেন অমরত্ব লেগে আছে ।

তাই কবির সমকালের হাতে কখন যেন চুপিচুপি এসে হাত রাখে নিওলিথ স্তব্ধতা । এ যেন বর্তমানের আয়নায় অতীতকে দেখা । এখন-তখন- যখন- কখন সব একাকার । কনসাসনেস অফ টাইম এজ অ্যা ইউনিভার্সাল । মহাবিশ্বের ইশারা থেকে উৎসারিত সময়-চেতনা কবির কাছে ছিল একটি সঙ্গতিসাধক অপরিহার্য সত্যের মতো । জীবন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কবি তাঁর অনুভবে ও উপলব্ধিতে বয়ে বেড়িয়েছেন এই অবিনশ্বর সত্য ।

ইউরোপের সুররিয়ালিস্ট আন্দোলন গভীর নাড়া দেয় জীবনানন্দকে । জীবনে বাস্তব যেমন সত্য , ঠিক ততটাই সত্য স্বপ্ন । স্বপ্নহীন জীবন অসম্ভব। কঠোর বাস্তবতাকে যেমন আঁকতে হবে , তার পাশাপাশি অবশ্যই থাকবে অযৌক্তিক উপমা , অদ্ভুত ইমেজ । অতিমাত্রায় বাস্তববাদিতা ও যুক্তিবাদের বিরোধিতা চলছে তখন ইউরোপের শিল্প-সাহিত্যে । যদিও কবি জীবনানন্দ সরাসরি কোনো নির্দিষ্ট ধারার শরিক হন নি কখনও । তবে বিশ্বসাহিত্যের নানা ধারা তাঁকে প্রভাবিত করেছে বরাবরই । তাই তাঁর লেখায় রয়েছে বাস্তব আর স্বপ্নের সার্থক মেলবন্ধনের প্রয়াস , আর সময়কে এক মহাকালের ব্যাপ্তিতে স্থাপন করার আয়োজন ।

আরও পড়ুন- কর্মিসভা থেকে বাড়ি ফেরার পথে দুর্ঘটনায় মৃত্যু বিজেপি কর্মীর! শোক প্রকাশ তৃণমূলের

Related articles

আরজি কর কাণ্ডে ভুয়ো প্রচারের অভিযোগ! নোটিশ চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামীকে

আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক পড়ুয়া অভয়ার মৃত্যুকে ঘিরে ভুয়ো প্রচার মামলায় নোটিশ ধরাল কলকাতা পুলিশ। পুলিশের...

দুর্গাপুজোর আগে রাজ্যে ডেঙ্গি-উদ্বেগ! টানা বৃষ্টিতে বাড়ছে আশঙ্কা 

দুর্গোৎসবের মুখে একদিকে নিম্নচাপের জেরে টানা বৃষ্টি, অন্যদিকে ডেঙ্গি সংক্রমণ রাজ্যবাসীর কপালে ভাঁজ বাড়াচ্ছে। জুলাইয়ের শেষ দিক থেকে...

মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর স্টলে হঠাৎ মুখ্যমন্ত্রী! কিনলেন শাড়ি 

বর্ধমানে প্রশাসনিক সভায় এসে হঠাৎ স্বনির্ভর গোষ্ঠীর স্টলে হাজির মুখ্যমন্ত্রী। শুধু মহিলাদের হাতের কাজই ঘুরে দেখলেন না, কেনাকাটাও...

ধনধান্যে ভরে, মা এসেছে ঘরে: মুখ্যমন্ত্রীর লেখা-সুরে গান এবার দুর্গাপুজোয়

বাংলা ও বাঙালির বড় উৎসব আর পুজোর গান— এক অপূর্ব মেলবন্ধন। এখন দুর্গাপুজোয় মণ্ডপে মণ্ডপে বাজে মুখ্যমন্ত্রীর লেখা...
Exit mobile version