
জাগো নারী জাগো বহ্নি-শিখা

জাগো স্বাহা সীমন্তে রক্ত-টিকা ।
নিজে নাচ শিখতে শুরু করার পরেই মাত্র আট বছর বয়সে মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের নাচ শেখাতে শুরু করে সুনীতা। বস্তির হতদরিদ্র শিশুদের জন্য বস্তিরই এক ঘরে আস্ত একটা স্কুলই খুলে দেয় সুনীতা । তখন তার বয়স মাত্র বারো । দলিত পরিবারের সকলের জন্য শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে ‘ নিও লিটারেসি ‘ ক্যাম্পেন শুরু করেছিল মাত্র ১৫ বছর বয়সে । ব্যাস, আর যায় কোথায় ! এইটুকু মেয়ের এত বড় আস্পর্ধা ! অতএব একে এমন শাস্তি দাও যাতে সারাজীবন আর বাইরে মুখ দেখাতে না পারে । তাই আটজন পুরুষ মিলে একদিন ধর্ষণ করলো স্বাধীনচেতা সুনীতাকে , সঙ্গে চললো ভয়ঙ্কর মারধর । মারের চোটে প্রায় বধির হয়ে গেল , কিন্তু এতেই দমে যাওয়ার মেয়ে নয় সে । চোখের জলের বদলে আরও শক্ত হয়ে উঠলো তার চোয়াল। সমাজের দেওয়া কলঙ্কের মুখে চুনকালি মাখিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো সে , আবার নেমে পড়লো রাস্তায় , ঝাঁপিয়ে পড়লো মানুষের কল্যাণে , একাই ।

দিকে দিকে মেলি’ তব
লেলিহান রসনা ,
নেচে চলো উন্মাদিনী
দিগবসনা ,
জাগো হতভাগিনী
ধর্ষিতা নাগিনী ,
বিশ্ব-দাহন তেজে
জাগো দাহিকা ।।

ব্যাঙ্গালোর সেন্ট জোসেফ কলেজ থেকে পরিবেশ বিজ্ঞানে স্নাতক হলেন এবং ম্যাঙ্গালোর থেকে এম এস ডব্ল্যু ( মেডিক্যাল অ্যান্ড সাইকিয়াট্রিক ) করলেন । তারপর নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সমাজের বিভিন্ন স্তরে নারীদের ওপর যৌন শোষণ ও নারীপাচার রুখতে ।

এক্ষেত্রেও তিনি একা । ১৯৯৬ সালে নারীদের পণ্য হওয়া রুখতে ব্যাঙ্গালোরে অনুষ্ঠিত মিস ওয়ার্ল্ড কম্পিটিশনে বাধাদান করার জন্য পুলিশ গ্রেফতার করে তাঁকে । জেল হয় তাঁর । জেল থেকে মুক্তি পেয়ে বাড়ি ফিরে দেখেন বাড়ির দরজাও তাঁর জন্য বন্ধ হয়ে গেছে । তাঁর বাবা-মা কেউই তাঁর এইসব কাজকর্ম পছন্দ করছেন না । এতে নাকি তাঁদের সামাজিক মর্যাদা নষ্ট হচ্ছে ।

ধূ ধূ জ্বলে ওঠো
ধূমায়িত অগ্নি ,
জাগো মাতা , কন্যা , বধূ ,
জায়া , ভগ্নী ।

পরিবার থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে সুনীতা একাই চলে যান হায়দ্রাবাদ । সেখানে কুখ্যাত এক নিষিদ্ধপল্লী থেকে উৎখাত হওয়া যৌনকর্মী ও তাঁদের সন্তানদের জন্য একটি স্কুল ও হাতের কাজ শেখানোর ব্যবস্থা করেন তিনি। একই সঙ্গে পণ করলেন যেভাবে হোক রুখে দাঁড়াতে হবে নারীপাচারের বিরুদ্ধে । লড়তে হবে নারী পাচারকারীদের বিরুদ্ধে । নিজের সামান্য পুঁজিটুকু সম্বল করে তৈরি করলেন তাঁর স্বপ্নের সংস্থা ‘ প্রজ্জ্বলা ‘ । পাচারকারীদের কবল থেকে উদ্ধার করা মেয়েদের আশ্রয় ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করলেন প্রজ্জ্বলার মাধ্যমে।

সমাজের মূলস্রোতে ফেরাতে লাগলেন তাঁদের । একইসঙ্গে এইডস আক্রান্তদের পাশেও দাঁড়ায় সুনীতার প্রজ্জ্বলা । বিভিন্ন বয়সের প্রায় ১২০০০ নারীকে পাচারকারীদের কবল থেকে উদ্ধার করেছেন সুনীতা । এখন তিনি নারী পাচারকারীদের ‘ ত্রাস ‘ । তাঁর বিখ্যাত স্লোগান , যা বিশ্ব জুড়ে ইতিমধ্যেই সমাদৃত :
” Real men don’t Buy Sex”
পতিতোদ্ধারিণী স্বর্গ- স্খলিতা
জাহ্নবী সমবেগে জাগো
পদ-দলিতা ,
মেঘে আনো বালা
বজ্রের জ্বালা ,
চির-বিজয়িনী
জাগো জয়ন্তিকা ।।

আজ প্রজ্জ্বলা পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ অ্যান্টি ট্র্যাফিকিং সেন্টার । ১৪ টি সমাজ সচেতক ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি করেছেন সুনীতা । পেয়েছেন পদ্মশ্রী ও আরও বেশ কয়েকটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার । এখনও পর্যন্ত ১৪ বার শারীরিক নিগ্রহের শিকার হয়েছেন তিনি । তাঁকে খুন করার চেষ্টাও হয়েছে বেশ কয়েকবার । কিন্তু তিনি তাঁর কাজে অবিচল , বেপরোয়া , অদম্য , অপরাজিতা ।

১৯৭২ সালে বেঙ্গালুরুতে জন্মগ্রহণ করেন সুনীতা কৃষ্ণণ । নিজের মাত্র সাড়ে চার ফুট উচ্চতা নিয়ে সর্বদা কুণ্ঠিত থাকতেন শৈশবে । তাঁকে অভয় দিতেন তাঁর বাবা। বলতেন মানুষের দৈহিক উচ্চতা কোনো ব্যাপার নয় । কাজটাই আসল । বাইরেটা দেখে মানুষকে বিচার করতে নেই । মনের দিক থেকে বড়ো হওয়ার চেষ্টা করতে হয় । বাবার বলা এই কথাগুলো প্রবলভাবে গেঁথে যায় ছোট থেকেই ডাকাবুকো এই মেয়েটির ।

সুনীতার স্বামী রাজেশ সবসময়ই সুনীতাকে উৎসাহ জোগান । তিনি পেশায় চলচ্চিত্র পরিচালক । প্রজ্জ্বলা তৈরি করার ক্ষেত্রে রাজেশের বিশাল অবদান রয়েছে । সুনীতা স্বীকার করেন , ‘ আমার সবচেয়ে বড়ো চিয়ার লিডার রাজেশ ‘ । সঙ্গে এও বলেন যে , ‘ আমার আসল পুরস্কার কিন্তু ওই ছোট ছোট মেয়েগুলোর হাসি । ওরা যখন ধর্ষণের আতঙ্ক , ক্ষত আর সমস্ত অপমান ভুলে অন্ধকার জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে আবার নতুন করে বাঁচার আশ্বাস ও প্রেরণা পায় , তখন মনে হয় এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি বোধহয় আর কিছুই হতে পারে না ‘ ।

আরও পড়ুন- আজও রাজ্যে ঝড়-বৃষ্টির পূর্বাভাস! সোমবার থেকে ‘হাওয়া বদলের’ ইঙ্গিত আলিপুরের
