‘নৃত্যের তালে তালে’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

” যে কোনো বিদ্যা প্রাণলোকের সৃষ্টি , যেমন নৃত্যবিদ্যা — তার সমৃদ্ধি ও সংবৃদ্ধির সীমা নাই ।‌ আদর্শের কোনো একটি প্রান্তে থেমে তাকে ভারতীয় বা প্রাচ্য বা পাশ্চাত্য নামের দ্বারা চরমভাবে শ্রেণীবদ্ধ করা বিহিত নয় , কারণ সেই অন্তিমতায় মৃত্যু প্রমাণ করে ।

একদিন আমাদের দেশের চিত্তে নৃত্যের প্রবাহ ছিল উদ্বেল । সেই উৎসের পথ কালক্রমে অবরুদ্ধ হয়ে গেছে। অবসাদগ্রস্ত দেশে আনন্দের সেই ভাষা আজ স্তব্ধ । তার শুষ্ক স্রোতঃপথে মাঝেমাঝে যেখানে তার অবশেষ আছে সে পঙ্কিল এবং ধারাবিহীন ।

নৃত্যহারা দেশ অনেক সময় একথা ভুলে যায় যে , নৃত্যকলা ভোগের উপকরণমাত্র নয় । মানবসমাজে নৃত্য সেখানেই বেগবান , গতিশীল , সেইখানেই বিশুদ্ধ যেখানে মানুষের বীর্য আছে । যে দেশে প্রাণের ঐশ্বর্য অপর্যাপ্ত , নৃত্যে সেখানে শৌর্যের বাণী পাওয়া যায় । শ্রাবণমেঘে নৃত্যের রূপ তড়িতলতায় , তার নৃত্যসহচর
বজ্রাগ্নি । পৌরুষের দুর্গতি যেখানে ঘটে , সেখানে নৃত্য অন্তর্ধান করে , কিংবা বিলাস ব্যবসায়ীদের হাতে কুহকে আবিষ্ট হয়ে তেজ হারায় , স্বাস্থ্য হারায় , যেমন বাইজির নাচ । এই পণ্যজীবিনী নৃত্যকলাকে তার দুর্বলতা থেকে উদ্ধার করো । সে মন ভোলাবার জন্যে নয় , মন জাগাবার জন্যে । বসন্তের বাতাস অরণ্যের প্রাণশক্তিকে বিচিত্র সৌন্দর্যে ও সফলতায় সমুৎসুক করে তোলে । তোমার নৃত্যে ম্লানপ্রাণ দেশে সেই আনন্দের বাতাস জাগুক , তার সুপ্ত শক্তি উৎসাহের উদ্দাম ভাষায় সতেজে আত্মপ্রকাশ করতে উদ্যত হয়ে উঠুক , এই আমি কামনা করি । ”

ইতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রবাসী , ভাদ্র , ১৩৪০

কাকে লিখেছেন কবি এসব কথা ? উদয়শঙ্করকে । নৃত্যকলাকে সঙ্গিনী করে পশ্চিম মহাদেশের জয়মাল্য নিয়ে দেশে ফেরার পর উদয়শঙ্করের উদ্দেশে দেশ তথা মাতৃভূমির পক্ষ থেকে লিখিত এই বরণমালা পাঠান কবিগুরু । সঙ্গে এও লেখেন , ” তুমি দেশ-বিদেশের নৃত্যরসিকদের কাছ থেকে প্রভূত সম্মান পেয়েছো , কিন্তু আমি জানি তুমি মনে মনে অনুভব করেছো যে , তোমার সামনে সাধনার পথ এখনো দূরে প্রসারিত , এখনো তোমাকে নতুন প্রেরণা পেতে হবে , উদ্ভাবন করতে হবে নব নব কল্পমূর্তি । আমাদের দেশে
নবনবোন্মেষশালিনী বুদ্ধিকেই প্রতিভা বলে । তোমার প্রতিভা আছে , সেই কারণেই আমরা আশা করতে পারি যে , তোমার সৃষ্টি কোনো অতীত যুগের অনুবৃত্তিতে বা প্রাদেশিক অভ্যস্ত সংস্কারে জড়িত হয়ে থাকবে না । প্রতিভা কোনো সীমাবদ্ধ সিদ্ধিতে সন্তুষ্ট থাকে না , অসন্তোষই তার জয়যাত্রাপথের সারথি । সেই পথে যে-সব তোরণ আছে তা থামবার জন্যে নয় , পেরিয়ে যাবার জন্যে । ”

ভারতের নিজস্ব শাস্ত্রীয় এবং লোকনৃত্যের সাথে ইউরোপীয় নাট্যকৌশল একত্রিত ক’রে উদয়শঙ্কর নতুন এক নৃত্য ঘরানার উদ্ভাবন করেন । এই শৈলী সারা বিশ্বে সমাদৃত হয়। নতুন নত্যশৈলীর নাম ‘ হাই ড্যান্স ‘ রাখার পর এর বাংলা নামকরণ করা হয় , যা সৃজনশীল নৃত্য নামে পরিচিত। উদয়শঙ্করকে আধুনিক ভারতীয় নৃত্যের জনক বলা হয় । অথচ তাঁর নৃত্যের কোনো পটভূমি ছিল না । সারা পৃথিবীর লোকজ এবং আধুনিক নৃত্যকলার নানা কৌশল একত্রিত করে নৃত্যের ফিউশন শৈলী তৈরি করার জন্যই উদয়শঙ্কর সর্বাধিক প্রসিদ্ধ।

আরও পড়ুন- দিতে হবে যোগ্যতার প্রমাণ! রাজ্যের সমস্ত শিক্ষকদের নথি জমা দেওয়ার নির্দেশ শিক্ষা দফতরের

উদয়শঙ্কর ( ৮ ডিসেম্বর , ১৯০০ — ২৬ সেপ্টেম্বর , ১৯৭৭ ) ছিলেন একাধারে নৃত্যশিল্পী , নৃত্য পরিকল্পক ও নির্দেশক এবং অভিনেতা । তাঁর জন্ম রাজস্থানের উদয়পুরে এবং মৃত্যু হয় কলকাতায় । তাঁর পুরো নাম উদয়শঙ্কর চৌধুরী । তাঁর বাবা পণ্ডিত শ্যাম শঙ্কর ছিলেন শিল্পবোদ্ধা প্রাজ্ঞজন ।‌ তাঁর কাছে নৃত্যকলা ছিল একাধারে শিল্প , পূজা ও উপাসনা । উদয় সহজাতভাবে চিত্রকলা ও নৃত্যকলার প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত ছিলেন । ১৯১৮ সালে উদয়কে প্রথমে মুম্বাইয়ের জে জে স্কুল অফ আর্টস এবং পরে গান্ধর্ব মহাবিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয় । এরপর উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য তিনি লন্ডনের রয়েল কলেজ অফ আর্টস-এ যান । এখানে তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের চিত্রকলা ও নৃত্যকলার বিষয়ে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জন করেন । এরপর এ বিষয়ে আরও অধ্যয়নের জন্য তিনি রোমে যান ।

উপজাতীয় নৃত্যধারাকে সারা বিশ্বে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে উদয়শঙ্করের অবদান অপরিসীম । ভারতে আধুনিক নৃত্যের এই পথিকৃৎ তাঁর বর্ণময় জীবনে অজস্র পুরস্কার পেয়েছেন । সঙ্গীত নাটক আকাদেমি , সঙ্গীত নাটক আকাদেমি ফেলোশিপ , পদ্মবিভূষণ , দেশিকোত্তম ছাড়াও সারা বিশ্বের বহু দেশে তিনি পুরস্কৃত হয়েছেন । ভারতীয় নৃত্যধারাকে বিশ্বের দরবারে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করার জন্যই সম্ভবত তাঁর সারা জীবনের নৃত্যসাধনা ।

ভারতীয় নৃত্যকলার নবজাগরণের অন্যতম কাণ্ডারী এই মহাশিল্পীর নাম ভারতে শাস্ত্রীয় নৃত্যের পুনরুজ্জীবন ঘটানোর ক্ষেত্রেও একইভাবে উচ্চারিত হয় । শাস্ত্রীয় নৃত্যের কোনো স্কুলে কোনো আনুষ্ঠানিক তালিম ছিল না এই মহান নৃত্যশিল্পীর । তাঁর নাচ ছিল সৃজনশীল । থিম, ফর্ম, শৈলী ইত্যাদি নিয়ে তিনি সর্বদা চিন্তা করতেন । তাঁর পর্যবেক্ষণ ছিল গভীর এবং ঐতিহ্য ও পরম্পরা বজায় রেখেই তিনি সবসময় অভিনবত্ব আনার চেষ্টা করতেন নৃত্য উপস্থাপনায় । নৃত্যে অভিনবত্ব আনার ক্ষেত্রে তাঁর বিস্ময়কর সাফল্য তাঁর সৃজনশীলতার জনপ্রিয় দর্শনকেই প্রতিষ্ঠিত করে । প্যারিসে তাঁর একক , যুগল এবং ব্যালেগুলির জন্য তিনি সৃজনশীল সঙ্গীত নিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন । তাঁর নৃত্যে শুধুমাত্র ভারতীয় সঙ্গীতের ব্যবহার তাঁর অন্যতম উদ্ভাবন , যা সারা পৃথিবীতে উচ্চ প্রশংসিত । নৃত্যের উপস্থাপনা , তা একক , যুগল অথবা সমবেত যা-ই হোক না কেন তা নিখুঁত করে তোলাই একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত , এই ছিল শিল্পী উদয়শঙ্করের সাধনার মূল কথা ।

আরও পড়ুন- দিলীপ-অভিজিতের পর এবার সুকান্তকে শোকজ নির্বাচন কমিশনের

Previous articleBreakfast news : ব্রেকফাস্ট নিউজ
Next articleজুন মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে বন্ধ হতে চলেছে গুগল পে!