Friday, August 22, 2025

‘নৃত্যের তালে তালে’, উৎপল সিনহার কলম

Date:

Share post:

উৎপল সিনহা

” যে কোনো বিদ্যা প্রাণলোকের সৃষ্টি , যেমন নৃত্যবিদ্যা — তার সমৃদ্ধি ও সংবৃদ্ধির সীমা নাই ।‌ আদর্শের কোনো একটি প্রান্তে থেমে তাকে ভারতীয় বা প্রাচ্য বা পাশ্চাত্য নামের দ্বারা চরমভাবে শ্রেণীবদ্ধ করা বিহিত নয় , কারণ সেই অন্তিমতায় মৃত্যু প্রমাণ করে ।

একদিন আমাদের দেশের চিত্তে নৃত্যের প্রবাহ ছিল উদ্বেল । সেই উৎসের পথ কালক্রমে অবরুদ্ধ হয়ে গেছে। অবসাদগ্রস্ত দেশে আনন্দের সেই ভাষা আজ স্তব্ধ । তার শুষ্ক স্রোতঃপথে মাঝেমাঝে যেখানে তার অবশেষ আছে সে পঙ্কিল এবং ধারাবিহীন ।

নৃত্যহারা দেশ অনেক সময় একথা ভুলে যায় যে , নৃত্যকলা ভোগের উপকরণমাত্র নয় । মানবসমাজে নৃত্য সেখানেই বেগবান , গতিশীল , সেইখানেই বিশুদ্ধ যেখানে মানুষের বীর্য আছে । যে দেশে প্রাণের ঐশ্বর্য অপর্যাপ্ত , নৃত্যে সেখানে শৌর্যের বাণী পাওয়া যায় । শ্রাবণমেঘে নৃত্যের রূপ তড়িতলতায় , তার নৃত্যসহচর
বজ্রাগ্নি । পৌরুষের দুর্গতি যেখানে ঘটে , সেখানে নৃত্য অন্তর্ধান করে , কিংবা বিলাস ব্যবসায়ীদের হাতে কুহকে আবিষ্ট হয়ে তেজ হারায় , স্বাস্থ্য হারায় , যেমন বাইজির নাচ । এই পণ্যজীবিনী নৃত্যকলাকে তার দুর্বলতা থেকে উদ্ধার করো । সে মন ভোলাবার জন্যে নয় , মন জাগাবার জন্যে । বসন্তের বাতাস অরণ্যের প্রাণশক্তিকে বিচিত্র সৌন্দর্যে ও সফলতায় সমুৎসুক করে তোলে । তোমার নৃত্যে ম্লানপ্রাণ দেশে সেই আনন্দের বাতাস জাগুক , তার সুপ্ত শক্তি উৎসাহের উদ্দাম ভাষায় সতেজে আত্মপ্রকাশ করতে উদ্যত হয়ে উঠুক , এই আমি কামনা করি । ”

ইতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রবাসী , ভাদ্র , ১৩৪০

কাকে লিখেছেন কবি এসব কথা ? উদয়শঙ্করকে । নৃত্যকলাকে সঙ্গিনী করে পশ্চিম মহাদেশের জয়মাল্য নিয়ে দেশে ফেরার পর উদয়শঙ্করের উদ্দেশে দেশ তথা মাতৃভূমির পক্ষ থেকে লিখিত এই বরণমালা পাঠান কবিগুরু । সঙ্গে এও লেখেন , ” তুমি দেশ-বিদেশের নৃত্যরসিকদের কাছ থেকে প্রভূত সম্মান পেয়েছো , কিন্তু আমি জানি তুমি মনে মনে অনুভব করেছো যে , তোমার সামনে সাধনার পথ এখনো দূরে প্রসারিত , এখনো তোমাকে নতুন প্রেরণা পেতে হবে , উদ্ভাবন করতে হবে নব নব কল্পমূর্তি । আমাদের দেশে
নবনবোন্মেষশালিনী বুদ্ধিকেই প্রতিভা বলে । তোমার প্রতিভা আছে , সেই কারণেই আমরা আশা করতে পারি যে , তোমার সৃষ্টি কোনো অতীত যুগের অনুবৃত্তিতে বা প্রাদেশিক অভ্যস্ত সংস্কারে জড়িত হয়ে থাকবে না । প্রতিভা কোনো সীমাবদ্ধ সিদ্ধিতে সন্তুষ্ট থাকে না , অসন্তোষই তার জয়যাত্রাপথের সারথি । সেই পথে যে-সব তোরণ আছে তা থামবার জন্যে নয় , পেরিয়ে যাবার জন্যে । ”

ভারতের নিজস্ব শাস্ত্রীয় এবং লোকনৃত্যের সাথে ইউরোপীয় নাট্যকৌশল একত্রিত ক’রে উদয়শঙ্কর নতুন এক নৃত্য ঘরানার উদ্ভাবন করেন । এই শৈলী সারা বিশ্বে সমাদৃত হয়। নতুন নত্যশৈলীর নাম ‘ হাই ড্যান্স ‘ রাখার পর এর বাংলা নামকরণ করা হয় , যা সৃজনশীল নৃত্য নামে পরিচিত। উদয়শঙ্করকে আধুনিক ভারতীয় নৃত্যের জনক বলা হয় । অথচ তাঁর নৃত্যের কোনো পটভূমি ছিল না । সারা পৃথিবীর লোকজ এবং আধুনিক নৃত্যকলার নানা কৌশল একত্রিত করে নৃত্যের ফিউশন শৈলী তৈরি করার জন্যই উদয়শঙ্কর সর্বাধিক প্রসিদ্ধ।

আরও পড়ুন- দিতে হবে যোগ্যতার প্রমাণ! রাজ্যের সমস্ত শিক্ষকদের নথি জমা দেওয়ার নির্দেশ শিক্ষা দফতরের

উদয়শঙ্কর ( ৮ ডিসেম্বর , ১৯০০ — ২৬ সেপ্টেম্বর , ১৯৭৭ ) ছিলেন একাধারে নৃত্যশিল্পী , নৃত্য পরিকল্পক ও নির্দেশক এবং অভিনেতা । তাঁর জন্ম রাজস্থানের উদয়পুরে এবং মৃত্যু হয় কলকাতায় । তাঁর পুরো নাম উদয়শঙ্কর চৌধুরী । তাঁর বাবা পণ্ডিত শ্যাম শঙ্কর ছিলেন শিল্পবোদ্ধা প্রাজ্ঞজন ।‌ তাঁর কাছে নৃত্যকলা ছিল একাধারে শিল্প , পূজা ও উপাসনা । উদয় সহজাতভাবে চিত্রকলা ও নৃত্যকলার প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত ছিলেন । ১৯১৮ সালে উদয়কে প্রথমে মুম্বাইয়ের জে জে স্কুল অফ আর্টস এবং পরে গান্ধর্ব মহাবিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয় । এরপর উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য তিনি লন্ডনের রয়েল কলেজ অফ আর্টস-এ যান । এখানে তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের চিত্রকলা ও নৃত্যকলার বিষয়ে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জন করেন । এরপর এ বিষয়ে আরও অধ্যয়নের জন্য তিনি রোমে যান ।

উপজাতীয় নৃত্যধারাকে সারা বিশ্বে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে উদয়শঙ্করের অবদান অপরিসীম । ভারতে আধুনিক নৃত্যের এই পথিকৃৎ তাঁর বর্ণময় জীবনে অজস্র পুরস্কার পেয়েছেন । সঙ্গীত নাটক আকাদেমি , সঙ্গীত নাটক আকাদেমি ফেলোশিপ , পদ্মবিভূষণ , দেশিকোত্তম ছাড়াও সারা বিশ্বের বহু দেশে তিনি পুরস্কৃত হয়েছেন । ভারতীয় নৃত্যধারাকে বিশ্বের দরবারে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করার জন্যই সম্ভবত তাঁর সারা জীবনের নৃত্যসাধনা ।

ভারতীয় নৃত্যকলার নবজাগরণের অন্যতম কাণ্ডারী এই মহাশিল্পীর নাম ভারতে শাস্ত্রীয় নৃত্যের পুনরুজ্জীবন ঘটানোর ক্ষেত্রেও একইভাবে উচ্চারিত হয় । শাস্ত্রীয় নৃত্যের কোনো স্কুলে কোনো আনুষ্ঠানিক তালিম ছিল না এই মহান নৃত্যশিল্পীর । তাঁর নাচ ছিল সৃজনশীল । থিম, ফর্ম, শৈলী ইত্যাদি নিয়ে তিনি সর্বদা চিন্তা করতেন । তাঁর পর্যবেক্ষণ ছিল গভীর এবং ঐতিহ্য ও পরম্পরা বজায় রেখেই তিনি সবসময় অভিনবত্ব আনার চেষ্টা করতেন নৃত্য উপস্থাপনায় । নৃত্যে অভিনবত্ব আনার ক্ষেত্রে তাঁর বিস্ময়কর সাফল্য তাঁর সৃজনশীলতার জনপ্রিয় দর্শনকেই প্রতিষ্ঠিত করে । প্যারিসে তাঁর একক , যুগল এবং ব্যালেগুলির জন্য তিনি সৃজনশীল সঙ্গীত নিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন । তাঁর নৃত্যে শুধুমাত্র ভারতীয় সঙ্গীতের ব্যবহার তাঁর অন্যতম উদ্ভাবন , যা সারা পৃথিবীতে উচ্চ প্রশংসিত । নৃত্যের উপস্থাপনা , তা একক , যুগল অথবা সমবেত যা-ই হোক না কেন তা নিখুঁত করে তোলাই একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত , এই ছিল শিল্পী উদয়শঙ্করের সাধনার মূল কথা ।

আরও পড়ুন- দিলীপ-অভিজিতের পর এবার সুকান্তকে শোকজ নির্বাচন কমিশনের

spot_img

Related articles

সোনা জয়ী অভিনবকে শুভেচ্ছা মুখ্যমন্ত্রীর

এশিয়ান শুটিং চ্যাম্পিয়নশিপ জুনিয়র (Asian Shooting Championship) এয়ার রাইফেল বিভাগে বাংলার অভিনব সাউয়ের (Abhinaba Shaw)। তাঁর এই সাফল্যই...

পুজোর আগে রাজ্য পুলিশের শীর্ষস্তরে রদবদল! পরিবর্তন হল ৬ জেলার এসপি-ডিসি

পুজোর মুখে রাজ্য পুলিশের শীর্ষ পদে বড়সড় রদবদল করল নবান্ন। বৃহস্পতিবার এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, একাধিক জেলায় পুলিশ...

‘নোরা ফাতেহি’ হতে হবে! স্ত্রীকে জোর করে শরীরচর্চা করিয়ে গর্ভপাত শিক্ষকের

যোগীরাজ্যে স্কুলশিক্ষকের ফ্যান্টাসির চূড়ান্ত নমুনা! স্ত্রীকে হতে হবে রোগা ছিপছিপে চেহারার। আর সেই চেহারা বানাতে গিয়েই স্বামীর নির্মম...

গান-কবিতায় সংসদে সরব তৃণমূল! বয়কট রাজ্যসভার চা-চক্র

বৃহস্পতিবার অধিবেশনের শেষ দিনে সংসদ উত্তাল হল বাংলা গান, কবিতা, বিক্ষোভ, প্রতিবাদে। সংসদের অন্দরে যেমন কালাকানুন, এসআইআর, ভাষাসন্ত্রাসের...