‘হাইপেশিয়া’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

হাইপেশিয়া খুন হয়েছিলেন । ভয়ঙ্করভাবে হত্যা করা হয় তাঁকে।

তাঁর অপরাধ ?

তিনি নারী , তিনি বিদুষী , তিনি গণিতবিদ । খুব সম্ভবত বিশ্বের প্রথম নারী গণিতবিদ । তার ওপর তিনি জ্যোতির্বিদ্যা ও দর্শন নিয়ে গবেষণা করেন। সমাজ ও পরিপার্শ্বকে নতুন করে গড়তে চান । প্রচলিত ব্যবস্থায় আস্থা নেই তাঁর ।

এগুলো অপরাধ নয় ? তিনি প্রশ্ন করেন পুরুষতন্ত্রকে। তিনি প্রশ্ন তোলেন ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে । অপরাধের আর কিছু বাকি রইল ? এমন আলোকিত নারীকে কি বাঁচিয়ে রাখা যায় ? ধর্ম , সমাজ ও রাষ্ট্রের পক্ষে এমন বিপজ্জনক নারীকে কি বাঁচিয়ে রাখা যায় ?

ডাইনি অপবাদ দিয়ে দাউদাউ আগুনে পৈশাচিক উল্লাসে বিভৎসভাবে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল জোন অফ আর্ক-কে। হাইপেশিয়াকেও মেরে ফেলা হয় প্রায় একইভাবে ৪১৫ খ্রীষ্টাব্দে । অশিক্ষা ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন একদল ধর্মীয় সন্ত্রাসী তাঁকে ডাইনি অপবাদ দিয়ে খুন করে ।

হাইপেশিয়া সেদিন ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে একাই বেরিয়েছিলেন আলেকজান্দ্রিয়ার রাস্তায় । কিছুক্ষণের মধ্যেই একদল উগ্র মৌলবাদী তাঁকে ঘিরে ধরে টেনে হিঁচড়ে গাড়ির বাইরে বের করে আনে । তারপর ঝিনুকের ধারালো খোলস দিয়ে হাইপেশিয়ার শরীরের চামড়া ও মাংস ছিঁড়ে ফেলতে থাকে তারা । রক্তে ভেসে যায় আলেকজান্দ্রিয়ার মাটি । এরপর তাঁর দেহটি খণ্ড-বিখণ্ড করে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয় । এভাবেই শেষ হয়ে যায় এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের জীবন । বিজ্ঞান শিক্ষার জগতে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার , যে অন্ধকার কাটতে সময় লেগেছিল আরও বহুযুগ ।

বিদুষী বিজ্ঞানী , গণিতজ্ঞ ও নারী স্বাধীনতার অন্যতম দিশারী হাইপেশিয়া জন্মেছিলেন ৩৭০ খ্রীষ্টাব্দে , আলেকজান্দ্রিয়ায় । মাদাম কুরীর পূর্ববর্তী সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নারী বিজ্ঞানী হিসেবে হাইপেশিয়ার নাম আলোচিত হয় । তবে কেবল নারী বিজ্ঞানী বা নারী গণিতবিদ হিসেবে তাঁর মূল্যায়ণ করা হলে সেই মূল্যায়ণে ঘাটতি থেকে যায় ।

সত্যি কথা বলতে , ইউক্লিডের পর আলেকজান্দ্রিয়াতে নারী পুরুষ নির্বিশেষে এত বড় গণিতজ্ঞের জন্ম হয় নি । ঐতিহাসিকদের মতে , হাইপেশিয়া ছিলেন মুক্তবুদ্ধি চর্চাকারী ইতিহাসের শেষ ‘ প্যাগান সায়েন্টিস্ট ‘ । অথচ খ্রীষ্টধর্মোন্মাদীদের রোষানলে পুড়ে এই রূপসী বিদুষীকে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিতে হয় মাত্র ৪৫ বছর বয়সে ।

এই মহিয়সীর অকাল মৃত্যুর পর পশ্চিম বিশ্বে গণিত , পদার্থবিজ্ঞান , জ্যোতির্বিদ্যা ও বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় আর কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায় নি দীর্ঘকাল , সেটাও কম করে হলেও প্রায় হাজার বছর । তাঁর মৃত্যুতে মানবসভ্যতার অগ্রগতি বহুকালের জন্য থমকে যায় । জ্ঞানচর্চায় নেমে আসে অন্ধকার । মুক্তবুদ্ধি তথা বিজ্ঞান ও শিল্প সাধনা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ।‌বাড়তে থাকে ধর্মীয় আস্ফালন ও কূপমণ্ডুকতা , বর্বরতা ও অরাজকতা । প্রগতির চাকা ঘুরতে থাকে উল্টোদিকে ।‌ পিছোতে থাকে সভ্যতা । ঐতিহাসিকগণ এই কলঙ্কিত সময়টিকে আখ্যায়িত করেন ‘ ডার্ক এজ’ বা অন্ধকার যুগ নামে ।

হাইপেশিয়ার বাবা থিওন , যিনি নিজেও ছিলেন একজন বড়ো মাপের গণিতজ্ঞ এবং আলোকপ্রাপ্ত মানুষ । ছিলেন জ্যোতির্বিদ । একইসঙ্গে তিনি ছিলেন আলেকজান্দ্রিয়া মিউজিয়ামের পরিচালক । সেই সময় মেয়েদের আক্ষরিক অর্থেই দেখা হতো পুরুষের সম্পত্তি হিসেবে । অথচ সেই পিছিয়ে পড়া সময়েই থিওন তাঁর মেয়েকে গড়ে তুলতে চেয়েছেন একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে। অনিন্দ্যসুন্দরী হাইপেশিয়া ছোট থেকেই ছিলেন তুখোড় মেধাবী । তাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল ঈর্ষণীয় । এমন মণিকাঞ্চন যোগ প্রায় বিরল । তাঁর রূপ ও গুণমুগ্ধ পাণিপ্রার্থীদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করে নিজেকে নিবিড় বিজ্ঞানসাধনায় নিয়োজিত করেন তিনি । কিছুদিন দেশের বাইরে কাটিয়ে দেশে ফিরে তিনি আলেকজান্দ্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতজ্ঞ তথা শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং অচিরেই ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন । বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর গভীর জ্ঞান ও প্রগাঢ় পাণ্ডিত্যের কথা দূর দূরান্তরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ছাত্র-ছাত্রীদের এবং জ্ঞানপিপাসুদের দাবিতে আলেকজান্দ্রিয়া গ্রন্থাগারের একটি বিশাল কক্ষে প্রতি সন্ধ্যায় সর্বসাধারণের জন্য বক্তৃতা দিতেন হাইপেশিয়া ।

পয়সা খরচ করে সেকালে এই নারীর বকLসাধারণের জন্য দর্শনী ছিল একটি মোহর । স্থায়ী ও স্বচ্ছল সদস্যেরা মাসিক ও ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে সম্মানী প্রদান করতেন । মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাঁর কথা শুনতেন গুণগ্রাহীরা।

হাইপেশিয়ার মৌলিক কাজের মধ্যে রয়েছে দায়োফ্যান্তাস রচিত অ্যারিথমেটিকা পুস্তকের উপর ১৩ অধ্যায়ের একটি মূল্যবান আলোচনা । এছাড়া অ্যাপোলোনিয়াসের কৌণিক ছেদ পুস্তিকার ওপর একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা লেখেন তিনি । ‘ Astronomical Canon ‘ শিরোনামে টলেমির কাজের ওপর আলোকপাত করেন হাইপেশিয়া । তিনি তাঁর বাবাকে জ্যামিতির কালজয়ী গ্রন্থ ‘ Euclid’s Element ‘-এর নতুন সংস্করণ লেখায় সাহায্য করেন।

তবে , যে দুটি যন্ত্রের আবিষ্কার তাঁকে ‘ উদ্ভাবক ‘ হিসেবে মহিমান্বিত করেছে তার একটি হলো ‘ অ্যাস্ট্রোলেব ‘ , আর অন্যটি হলো ‘ হাইড্রোস্কোপ ‘ । বিচক্ষণতা ও বিচারবুদ্ধির জোরে তৎকালীন শাসকদের ত্রাস হয়ে ওঠেন অপরূপা হাইপেশিয়া । তাই তাঁকে হত্যা করতে দেরি করে নি তারা ।

 

Previous articleমোদির হাত ছেড়ে সিকিম দখলে রাখল SKM, অরুণাচলে ক্ষমতায় BJP
Next articleপ্রস্তুতি ম্যাচে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জয় পেয়ে কী বললেন রোহিত শর্মা?