কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে দুর্ঘটনা: দায় এড়াতে মোড় ঘোরানোর চেষ্টা? রেলের আজব দাবিতে চাঞ্চল্য!

ওড়িশার বাহানাগা বাজার স্টেশনে করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ভয়াবহ স্মৃতি এখনও দেশবাসীর মনে দগদগে। আর সেই বিপর্যয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই এবার একইভাবে দুর্ঘটনার কবলে শিয়ালদহগামী ডাউন কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস (Kanchanjungha Express)। সোমবার উত্তরবঙ্গের রাঙাপানি স্টেশনের কাছে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের উপর উঠে যায় মালগাড়ির ইঞ্জিন। ইতিমধ্যে মঙ্গলবারই উত্তরবঙ্গের ট্রেন দুর্ঘটনায় জখম এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এখনও পর্যন্ত ওই দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ১০। উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেল এই দুর্ঘটনার প্রেক্ষিতে বুধবার থেকেই শুরু করেছে তদন্ত। তবে তদন্ত শুরুর আগেই মালগাড়ির চাললককে কাঠগড়ায় তুলে নিজেদের দায় ঢাকতে চাইছে রেল।

রেলের তরফে আগেভাগেই অভিযোগ করা হয়েছে, মালগাড়ির চালক সিগন্যাল মানেননি। মঙ্গলবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে কিভাবে তদন্তের আগেই এমন মন্তব্য করল রেল তা নিয়ে ইতিমধ্যেই জোর সমালোচনা শুরু হয়েছে। রেলকর্মীদের একাংশ দাবি করেছেন, যে রাঙাপানি স্টেশনের স্টেশনমাস্টার সিগন্যালের কাগজ দিয়েছিলেন মালগাড়ির চালককে, সেখানে গতিবেগ নিয়ন্ত্রণের কথা বলা ছিল না। ওই লাইনেই যে মালগাড়ির আগে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস রয়েছে, তা লিখিত ভাবে মালগাড়ির চালককে জানানোর কোনও নথিও এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি বলে ওই অংশের দাবি। মনে করা হচ্ছে, দুর্ঘটনার নেপথ্যে কোথাও একটা সমন্বয়গত ত্রুটি রয়ে গিয়েছে।

এদিকে বুধবার ডেকে পাঠানো হয় রাঙাপানির স্টেশন ম্যানেজার, মালগাড়ির ম্যানেজার (গার্ড), রাঙাপানি রেল গেটের গার্ড, কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের চালকদের ৷ এদিন সকাল সকালই তাঁরা হাজিরা দেন শিলিগুড়ি এনজেপি সংলগ্ন এডিআরএম অফিসে তাঁরা হাজিরা দেন। এদিকে, এই দুর্ঘটনার তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টও জমা পড়েছে রেলের সুরক্ষা কমিশনের কাছে। রেল সূত্রে খবর, সেই রিপোর্টে দুর্ঘটনার দিনে মালগাড়ি এবং কাঞ্চনজঙ্ঘার গতিবেগ সংক্রান্ত তথ্যের উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়াও সে সময় কর্তব্যরত কর্মীরা কে, কী দায়িত্ব পালন করছিলেন, তা-ও রয়েছে ওই রিপোর্টে।

প্রাথমিক তদন্তে যে তথ্য উঠে আসছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, সোমবার সকাল ৮টা ২০ মিনিটে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস রাঙাপানি স্টেশনে ঢোকে। ছাড়ে ৮টা ২৭ মিনিট নাগাদ। দুর্ঘটনাটি ঘটে ৮টা ৫৫ মিনিটে। আর মালগাড়িটি ৮টা ৪২ মিনিটে রাঙাপানি স্টেশন ছাড়ে। রাঙাপানি স্টেশন থেকে দুর্ঘটনাস্থলের দূরত্ব আড়াই কিলোমিটার। হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, ওই পথ অতিক্রম করতে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস সময় নেয় প্রায় ২৮ মিনিট। অন্যদিকে, মালগাড়ির সময় লাগে ১৩ মিনিট। বুধবারই শিলিগুড়ির বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মালগাড়ির সহ-চালক মনু কুমারের সঙ্গে দেখা করতে যায় সিট। তবে সেখানে কী কথা হয়েছে, সে সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমের সামনে কোন কথা বলেনি তারা।

রেল সূত্রে জানা গিয়েছে, সোমবার ভোর প্রায় সাড়ে ৫টা থেকে ‘অকেজো’ ছিল রাঙাপানি এবং চটেরহাটের মধ্যেকার স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা। এই পরিস্থিতিতে ওই লাইনে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে কাগজে লিখে অনুমতি দেওয়া হয় ট্রেনচালকদের। রেলের পরিভাষায় যাকে বলা হয় ‘ষপেপার লাইন ক্লিয়ার টিকিট। রেলের একটি সূত্রে দাবি করা হচ্ছে, দুর্ঘটনার আগে রাঙাপানি স্টেশনের স্টেশনমাস্টার কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস এবং মালগাড়ির চালক ও ট্রেন ম্যানেজার (গার্ড)-কে আলাদা আলাদা ভাবে ‘টিএ-৯১২ ফর্ম’ দেন। ফর্ম দু’টিতে একই নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তবে প্রাক্তন রেলকর্মীদের একাংশের বক্তব্য, লাল সিগন্যাল থাকা সত্ত্বেও নিয়ম ভেঙে মালগাড়ির চালক ট্রেন চালিয়েছিলেন, এমনটা সঠিক নয়। কারণ, স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা অকেজো থাকায় সিগন্যাল লাল থাকা অবস্থাতেই ট্রেন চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছিল মালগাড়ির চালককে। সেটা দিয়েছিলেন রাঙাপানির স্টেশনমাস্টারই। একই নির্দেশ ছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের জন্যও।

এদিকে উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের মধ্যে একমাত্র কাটিহার ডিভিশনেই স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা রয়েছে বলে রেলের একটি সূত্রে জানা গিয়েছে। এই পদ্ধতি চালু হয়েছে ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে। পরে আমবাড়ি থেকে আলুয়াবাড়ি পর্যন্ত স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা গত ছয় মাস ধরে কাজ করছে বলেই ওই সূত্রের দাবি। তবে রেলকর্মীদের একাংশের মতে, নতুন পদ্ধতি চালু হলেও হয়তো পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ হয়নি। সে কারণেই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে সোমবার। তবে রেলের সাফাই, প্রতি তিন বছর অন্তর ট্রেনচালক, ট্রেন ম্যানেজার (গার্ড)-সহ বিভিন্ন কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কিন্তু তিন বছরের মধ্যে অনেক জায়গাতেই কাজ চালানোর পদ্ধতিতে পরিবর্তন হয়।

২০২৩ সালের ২ জুন সন্ধ‌্যায় করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার পর সোমবার ১৭ জুন সকালে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে একইভাবে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। দুটি ক্ষেত্রেই রেলের সুরক্ষাকবচ নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। তবে তদন্ত শেষ না হলে কার গাফিলতিতে এই বিপর্যয় তা জানা সম্ভব নয় বলেই মত বিশেষজ্ঞদের।

Previous articleউইমেন বেঙ্গল প্রো টি-টোয়েন্টি লিগে অঙ্কিতার ঝোড়ো ব্যাটিংয়ে জয় পেল শ্রাচি রাঢ় টাইগার্স
Next articleঝাড়খণ্ডে পালিয়েও রেহাই মিলল না, পুলিশের জালে দুষ্কৃতী সোনা