
‘ শান্ত সমুদ্রে দক্ষ নাবিক তৈরি হয় না । ‘
( ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট )

কপিলদেবের হাত ধরে সেই অবিস্মরণীয় বিশ্বজয়ের পর থেকে ভারতীয় ক্রিকেট-সমুদ্র কখনও শান্ত ছিল না । উত্তাল তরঙ্গের ঝুঁটি ধরে ক্রমাগত উথালপাথালের মধ্যেই তৈরি হয়েছে ঝাঁকের পর ঝাঁক সুদক্ষ নাবিক আর একের পর এক ক্যাপ্টেন কুল ।

এই তো সেদিন ( ১৯ নভেম্বর , ২০২৩ ) ক্যাপ্টেন রোহিতের হাত থেকে চিলের মতো ছোঁ মেরে একদিনের বিশ্বকাপটা নিয়ে চলে গেল প্যাট কামিন্সের অস্ট্রেলিয়া । তীরে এসেও তরী ডোবা কখনো কখনো দেখতে হয় বৈকি দক্ষ নাবিকদের । একশো চল্লিশ কোটি ভারতবাসীর স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল যেদিন , সেই অভিশপ্ত রাত থেকে টানা কয়েকদিন কান্না থামে নি রোহিতের । গোটা দেশের সঙ্গে কেঁদেছিলেন বিরাট , রাহুল ও বুমরা-সহ সমস্ত খেলোয়াড় । গুজরাটের সেই অন্ধকার কান্নার রাত থেকে বার্বাডোজের আলো ঝলমল বিকেল আসতে লেগেছে মাত্র ৬ মাসের কিছু বেশি সময় । ১৯ নভেম্বর থেকে ২৯ জুন ।
অবশেষে ক্যাপ্টেন কুলের হাতে উঠলো বিশ্বকাপ । উপশম হলো যাবতীয় যন্ত্রণার। হলো শাপমোচন ।
আবার জল এলো চোখে , কিন্তু এ আনন্দাশ্রু । একদা মিস্টার ডিপেন্ডেবল কোচ রাহুলের শো-কেসে কোনো বিশ্বকাপ ছিলো না এতদিন । এবার তা শোভা পাবে জীবনের অন্যতম সেরা প্রাপ্তি হিসেবে । আর এক মহানায়ক বিরাট । এই টি-২০ বিশ্বকাপে প্রায় সব ম্যাচে ব্যর্থ এই দুর্ধর্ষ নাবিক ফাইনালে সর্বোচ্চ রান করে প্লেয়ার অফ দ্য ম্যাচ হয়ে গেলেন । এই হলো অনিশ্চয়তা ঘেরা ক্রিকেটের মহিমা । ‘ ওস্তাদের মার শেষরাতে ‘-র অর্থটা সবাইকে আর একবার বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন বিরাট ।

রাহুল দ্রাবিড় আর কোচ থাকছেন না । রাহুলের বিকল্প পাওয়া খুব সহজ হবে না । একইসঙ্গে এমন দারুণ কোচ , বুদ্ধিমান ইভেন্ট ম্যানেজার এবং ক্রিকেটারদের ভীষণ প্রিয় মধুর ব্যক্তিত্ব এই মুহূর্তে প্রায় বিরল ।
টি-টোয়েন্টি থেকে একসঙ্গে অবসর নিলেন বিরাট , রোহিত এবং জাদেজা । এঁদের বিকল্পও সহজে পাওয়া যাবে না । বিশেষ করে রোহিত শর্মার বিকল্প পাওয়া এই মুহূর্তে প্রায় অসম্ভব । মিচেল স্টার্কের এক ওভারে ২৯ রান করতে পারেন এমন ব্যাটার আর কেউ আছেন নাকি এই ক্রিকেটবিশ্বে ? প্যাট কামিন্সের বল গ্যালারির ছাদে আছড়ে ফেলতে পারেন ক’জন ব্যাটসম্যান ? টানা দশ ম্যাচে জেতা ক্যাপ্টেন কুলের অশ্বমেধের ঘোড়া ফাইনালে ( ১৯ নভেম্বর , ২০২৩ ) থামিয়ে দিয়েছিল কামিন্সের অস্ট্রেলিয়া ।

হতাশার অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল গোটা ভারতবর্ষ । সেই জ্বালাপোড়া , সেই দগদগে ঘা , সেই অবর্ণনীয় হাহাকার ছ’মাস ধরে বয়ে বেড়াচ্ছিলেন ক্যাপ্টেন রোহিতের নাবিকেরা । তাই বোধহয় অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধেই সবচেয়ে নির্দয় ছিল রোহিতের ব্যাট । তাঁর ৪১ বলে ৯২ রানের অমর ইনিংস অস্ট্রেলিয়াকে শুধু যে এবারের টি-২০ বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে দিয়েছে তাই নয় , আগামী বেশ কিছুদিন অস্ট্রেলিয়ার বোলারদের দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করবে রোহিতের সেই সংহারমূর্তি । বোলারদের বলের সুতো বের করে দেওয়া , বলের আকার বিগড়ে দেওয়া রোহিতের নটরাজ নৃত্য , খেলার শুরুতেই , এমনকি প্রথম বল থেকেই ওইরকম ধুন্ধুমার , ওই রুদ্ররূপ টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে আর দেখা যাবে না ভাবলেই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে । সেই ম্যাচে বিরাটের মতো ব্যাটসম্যান তাড়াতাড়ি আউট হয়ে যাবার পর যেন আরও নির্দয় হয়ে ওঠেন রোহিত । তাঁর চার অথবা ছয় , প্রত্যেকটা শটে যেন বেরিয়ে আসছিল প্রচণ্ড ক্রোধের আগুন আর ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ের নিদারুণ যন্ত্রণা , অস্ট্রেলিয়ার হাড় হিম করে দেওয়ার জন্য যা যথেষ্ট । ওখানেই অস্ট্রেলিয়া বজ্রাহতের মতো স্তব্ধ হয়ে যায়। ওই পরাজয়ের পর কামিন্সদের মনোবল চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় । রোহিতের ওই আগুনে ইনিংস সেদিন যাঁরা দেখেছেন , জন্মজন্মান্তরেও ভুলবেন না ।

সূর্যকুমার , ক্রিজে যাঁর বিচরণ রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের মতো , সবসময় অভিনব সব শট সৃজন করেন , ফাইনালে তাঁর ওই অবিস্মরণীয় ক্যাচটা ভেবে দেখুন । ওই মুহূর্তে ওই পরিস্থিতিতে মাথা ঠাণ্ডা রেখে ওই ক্যাচ ম্যাচ জিতিয়ে দেয় ভারতকে । বিরলের মধ্যে বিরলতর একটা ক্যাচ ।

যশপ্রিত বুমরা । টুর্ণামেন্টের সেরা বোলার । এই মুহূর্তে বিশ্বের এক নম্বর । এমন আনপ্রেডিকটেবল বোলার প্রায় বিরল । কপিলদেব সম্প্রতি বলেছেন , বুমরা নাকি তাঁর চেয়ে হাজার মাইল এগিয়ে । হতে পারে সৌজন্য , কিন্তু কপিল যখন এতটা প্রশংসা করছেন তার তো নিশ্চয়ই কিছু কারণ আছে । হার্দিককে চুমু খেয়ে কোলে তুলে নিলেন রোহিত । রোহিতের চওড়া কাঁধের পাশ দিয়ে চাঁদের মতো উঁকি দেওয়া চোখে জল মুখে হাসি হার্দিককে দেখেই বোঝা গেলো বর্তমানের কোলে ভবিষ্যৎ । বাকি নাবিকেরা প্রত্যেকেই দুর্দান্ত ।

ফাইনালে শেষ বল পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার লড়াইকে কুর্নিশ । তাঁদের ক্রিকেট সমুদ্রও মোটেও শান্ত নয় ।
আপাতত জয় ভারত ।

আরও পড়ুন- খাস জমি পুনরুদ্ধারে উদ্যোগ রাজ্যের, শুরু ব্লকস্তরে পর্যালোচনা
