Tuesday, May 20, 2025
উৎপল সিনহা

সঙ্গীত না বুঝলে ‘ সঙ্গত ‘ হবে কী করে ? সবাই তো আর ‘ রাধুবাবু ‘ হয়ে জন্মান না । মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় কিংবা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে যখন বাজাচ্ছেন তখন যেমন কথা বলাচ্ছেন তবলাকে , ঠিক তেমনি একটি ছোট্ট মেয়ে যখন ভয়ে ভয়ে গাইছে গান , তাকে দুরন্ত নদীতে ভাসমান নৌকোর সুদক্ষ মাঝির মতো নিরাপদে পৌঁছে দিচ্ছেন সাফল্যের তীরে । তাই বুঝি সঙ্গীতমহলে তাঁকে বলা হতো ‘ মিস্টার পারফেক্ট ‘ । আর তাঁর সঙ্গীতবোধ ? তা নিয়ে তো পাতার পর পাতা লেখা যায় । তাঁর বাজনা যে শুধু শিল্পসুষমামণ্ডিত এবং অসামান্য কারুকার্যে ভরপুর তাই নয় , তিনি অনন্য , তিনি স্বতন্ত্র , তাঁর বাজনা অভিনব ।

তাঁর তাৎক্ষণিক উদ্ভাবনী ক্ষমতা প্রায় বিরল । গানের প্রথম কলিতেই যেন তিনি গোটা গানটার মেজাজ বুঝে যেতেন । তারপর গোটা গানটিতে তিনি যেন সারথি কৃষ্ণ । সঙ্গতকার হিসেবে তাঁকে পেলে ধন্য হতেন শিল্পীরা , হতেন পরম নিশ্চিন্ত। গানের মেজাজ বোঝার মতোই তাঁর নিজের মেজাজটা ছিল আসল রাজা ।শোনা যায় , সন্ন্যাসী রাজা ছায়াছবির জন্য যখন গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার লিখেছিলেন ,

‘ কাহারবা নয় দাদরা বাজাও উল্টোপাল্টা মারছো চাঁটি ,
রাধাকান্ত তুমি দেখছি
আসরটাকে করবে মাটি ‘ ,

তখন সেই গানে মান্না দে-র সঙ্গে তবলা বাজাতে রাজি হন নি তিনি । ‘ তিনি ‘ অর্থাৎ তবলার জাদুকর রাধাকান্ত নন্দী । অগত্যা গানের কথা সামান্য বদলাতে বাধ্য হন গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন । ‘ রাধাকান্ত ‘ নামের বদলে লিখতে হয় ‘ শশীকান্ত ‘ । এমনই আপসহীন ছিলেন এই আত্মদর্পী তবলা-শিল্পী ।

রাধাকান্ত নন্দী ( ১৯২৮ — ১৯৮৪ ) বাংলাদেশের বরিশাল জেলার বানারিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন । মাত্র ৫৬ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয় কলকাতায় । রাধুবাবু নিজেও গান গাইতেন চমৎকার । অনামী অখ্যাত শিল্পীদের সাহস জুগিয়ে উদ্বুদ্ধ করার বিশেষ ক্ষমতা ছিল তাঁর । শুধু সঙ্গত নয় , একক বাদনেও তাঁর নৈপুণ্য ছিল প্রশ্নাতীত ।
তাঁর প্রাণপ্রিয় তবলা নিয়ে তিনি লিখে গেছেন :
‘ তবলা আমায় বাজায়
তাইতো আমি বাজি ,
তবলাকে মোর দুঃখ দিয়ে
বাজাতে নই রাজি ‘ ।

তাঁর বাবা রোহিনীকান্ত ছিলেন সে কালের খ্যাতিমান তবলিয়া । পিতামহ কালীচরণ ছিলেন কীর্তনীয়া ।ছোটবেলায় গ্রাম পরিক্রমায় নগরকীর্তনে রাধাকান্ত বাজাতেন শ্রীখোল । মাত্র ছ’ বছর বয়সে শ্রীখোল বাজিয়ে পুরস্কার পান ছোট্ট রাধাকান্ত। শুধু তবলা নয় , সব ধরনের তালবাদ্যেই তাঁর ছিল প্রখর জ্ঞান ও সংশয়াতীত দক্ষতা । তাঁর সমকালে তাঁর বিকল্প ছিল না । তাই তিনি যখন খ্যাতির মধ্যগগনে এবং চূড়ান্ত ব্যস্ত , সেই সময়ে তাঁকে নিয়ে চালু হয় ‘ নো রাধাকান্ত , নো রেকর্ডিং ‘ কথাটি । এর চেয়ে বড় সম্মান একজন শিল্পীর জীবনে আর কী হতে পারে ? ছোটবেলায় বাবার শাসন এবং পড়াশোনার চাপ তাঁকে তবলা বাজানোর ইচ্ছা থেকে বিরত করতে পারে নি । শোনা যায় এজন্যই তিনি নাকি পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিলেন ।‌

উস্তাদ আনোখেলাল ছিলেন রাধাকান্ত নন্দীর গুরু ।‌ মার্গসঙ্গীতে তিনি সঙ্গত করেছেন বাবা আলাউদ্দিন খাঁ , উস্তাদ আলি আকবর খাঁ , উস্তাদ আমির খাঁ , পণ্ডিত তারাপদ চক্রবর্তী , পণ্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় , পণ্ডিত মনিলাল নাগ প্রমুখ খ্যাতনামা শিল্পীদের সঙ্গে । আধুনিক বাংলা গান এবং নজরুল গীতিতে তাঁর বাজনা অমর হয়ে আছে । মান্না দে , সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় , মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় , শ্যামল মিত্র এবং সেকালের সমস্ত বিখ্যাত শিল্পীদের কাছে ভীষণ প্রিয় ছিলেন ‘ রাধুবাবু ‘ । তিনি পাখোয়াজ বাজাতেন দুর্দান্ত । দশ রকমের তালবাদ্য অনায়াসে বাজাতেন তিনি ।

তাঁর আরেক গুরু ছিলেন পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ‌ ঘোষ ।‌ রাধাকান্ত নন্দী প্রসঙ্গে মান্না দে-র মূল্যায়ন অসামান্য । তিনি বলতেন , ‘ রাধুবাবুর মতো ওই সুর তাল বাঁধবে কে ? ও হচ্ছে ন্যাচারাল জিনিয়াস ‘ ।

সত্যিই আজও রেকর্ডে রাধুবাবুর বাজনা শুনে বোঝা যায় কেন তাঁকে বলা হতো জীবন্ত বিস্ময় । তিনি ছিলেন প্রকৃতই কিংবদন্তি । ক্ষণজন্মা এই তালশিল্পীর মাত্রাবোধ আজও সঙ্গীত জগতের চর্চার বিষয় । তবলার বাইরে তাঁর প্রিয় সখ ছিল ছিপ ফেলে মাছ ধরা । ছিপ ও চার হাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাতেন পুকুরপাড়ে । তখন তাঁর নিবিষ্টতা ও স্থির অচঞ্চল আঙুলগুলো দেখে আন্দাজ করা যেতো না যে এই শান্ত আঙ্গুলগুলোই প্রতি সন্ধ্যার জলসা আর রেকর্ডিং স্টুডিওতে তীব্র গতিময় উঠান আর বক্র তেহাইয়ের বোল ফোটায় বাঁয়া-তবলায় । তখন তিনি যেন এক ধ্যানমগ্ন চিত্রকর । ছন্দোময় আঙ্গুলের ছোঁয়ায় চূড়ান্ত উৎকর্ষতায় অনায়াস নৈপুণ্যে পৌঁছে যান মুগ্ধ শ্রোতাদের নিয়ে । এক মাত্রা থেকে অন্য মাত্রায় , অনন্য মাত্রার এমন এক মায়াজগতের সন্ধান তিনি শ্রোতাদের বারবার উপহার দিয়েছেন যেখান থেকে সহজে ফিরতে চাইতেন না কেউ । মাত্রাবোধের পাঠ অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে পেতে হয় যে !

আরও পড়ুন- মাঝসমুদ্রে জাহাজে আগুন, নেভাতে নৌসেনার ২৪ঘণ্টার লড়াই

 

Related articles

পাক বিরোধী প্রচারের প্রতিনিধি দলে থাকুন জওয়ানরা, শহিদ-মৃতদের পরিবারও: প্রস্তাব অভিষেকের

পাক বিরোধী প্রচারে বিদেশে পাঠানো প্রতিনিধি দলে থাকুন দেশের অতন্দ্র প্রহরী জওয়ানরা। থাকুন শহিদ ও মৃতদের পরিবারের সদস্যরাও।...

সৌভিক, জ্যোতির্ময়ীদের হাতে উদ্বোধন ক্রীড়া সাংবাদিক ক্লাবের স্পোর্টস মিউজিয়াম

অভিনব উদ্যোগ ক্যালকাটা স্পোর্টস জার্নালিস্ট ক্লাবের(CSJC)। শহরের বুকে নয়, এবার জেলাতে স্পোর্টস মিউজিয়াম(Sports Museum)। ক্যালকাটা স্পোর্টস জার্নালিস্ট ক্লাবের...

এফডি-তে সুদের হার ফের কমাল এসবিআই!  ক্ষতির মুখে আমানতকারীরা

ফিক্সড ডিপোজিটে (FD) বিনিয়োগকারীদের জন্য বড় ধাক্কা। ফের একবার সুদের হার কমাল স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (SBI)। সর্বশেষ...

সরকারি প্রকল্পে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে পড়ে থাকা টাকা ফেরত নেওয়ার উদ্যোগ রাজ্যের 

পাঁচ বছর বা তার বেশি সময় ধরে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের খাতে পড়ে থাকা অব্যবহৃত অর্থ ফেরত নেওয়ার প্রক্রিয়া...
Exit mobile version