‘দশরথ মাঝি’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

একজন মানুষ একা একটা পাহাড় কেটে রাস্তা বানালেন ।সম্পূর্ণ একা । কাউকে সঙ্গে পেলেন না । কারণ , সবাই ভাবলেন , এই অসম্ভব কাজে সময় নষ্ট করে কী লাভ ? কিন্তু তিনি দশরথ , হাল ছাড়ার পাত্র নন । তিনি ডাক দিয়েছেন , কেউ সাড়া দেন নি , তাই একলা চলা শুরু করলেন । আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে যেমন একলা চলেছিলেন রাজা রামমোহন ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর । দুরুহ কঠিন কাজ বোধহয় একলাই করতে হয় । সঙ্গে কেউ নেই ভেবে বিদ্যাসাগর যদি পিছিয়ে যেতেন তাহলে আজও মেয়েরা বিদ্যালয়ের মুখ দেখতো না , বিধবা বিবাহের কথা কেউ ভাবতেও পারতো না ।‌ রামমোহন রায় যদি একলা চলতে হবে ভেবে সাহস হারাতেন তাহলে আজও ‘ সতীদাহ ‘ রমরমিয়ে চলতো । কিন্তু এঁরা দুর্জয় সাহসে , অটল সংকল্পে ঝড়বাদলে আঁধার রাতে একলা পথ চলেছেন এবং শেষপর্যন্ত অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছেছেন ।

দশরথ মাঝিও হাজার হাজার মানুষের লড়াই একাই লড়েছেন দীর্ঘ ২২ বছর এবং শেষে সফল হয়েছেন । দশরথের ( ১৯৩৪–২০০৭ ) এই একক যুদ্ধ রূপকথাকে হার মানায় । তিনি একজন গরীব শ্রমিক ছিলেন । আজ এই ‘মাউন্টেন ম্যান ‘ এক কিংবদন্তি । বিহারের গয়ার কাছাকাছি গেহলৌর গ্রামে জন্ম তাঁর । তিনি একাই ছেনি হাতুড়ি ও শাবল দিয়ে দীর্ঘ ২২ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে একটি পাহাড়ের ঢিপির মাঝখান দিয়ে ১১০ মিটার দীর্ঘ , ৯.১ মিটার চওড়া এবং ৭.৬ মিটার গভীর একটা রাস্তা তৈরি করেন ।

প্রথমদিকে পাথুরে পাহাড়ের গায়ে হাতুড়ি চালাতেই হাতুড়ি ছিটকে এসে আঘাত করতো পায়ে , রক্তাক্ত হতেন দশরথ , যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠতেন , কিন্তু সংকল্প থেকে বিচ্যুত হতেন না , কারণ এই পাহাড় চিরদিনের জন্য কেড়ে নিয়েছে তাঁর স্ত্রী ফাল্গুনীর জীবন , এর প্রতিশোধ না নিয়ে কী করে থামেন দশরথ ! শাবল-হাতুড়ি নিয়ে তাঁর এই লড়াই দেখে গ্রামবাসীদের অনেকেই নানা বিদ্রুপ করেন , কিন্তু দশরথ ভ্রুক্ষেপহীন । মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন । বিহারের গয়া জেলার মুহরা তহশিলের আতরি ব্লকে আছে পিছিয়ে পড়া প্রত্যন্ত গ্রাম গেহলৌর । গ্রামটিকে পাশের শহর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে এক বিশাল পাহাড় , তারও নাম গেহলৌর । পাহাড় ঘুরে ওয়াজিরগঞ্জ যেতে গ্রামের লোকেদের পাড়ি দিতে হয় দীর্ঘ ৫৫ কিলোমিটার পথ।

গ্রামের উন্নয়নের পথেও প্রধান বাধা এই পাহাড় । দারিদ্র , জাতপাতের রাজনীতি , অনাহার ও বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু তাঁদের নিয়তি হিসেবেই মেনে নিয়েছিলেন গ্রামের মানুষ । নেই পানীয় জল , বিদ্যুৎ । গরুর গাড়ি করে মুমূর্ষু রোগীকে সবচেয়ে কাছের হাসপাতালে নিয়ে যেতে পাড়ি দিতে হয় প্রায় ৭০ কিমি দীর্ঘ পথ । পথেই মারা যান অনেক রুগী । দশরথ মাঝির জীবনেও এমনিই এক করুণ ঘটনা ঘটে ।

এক পুত্র ও এক কন্যা নিয়ে দশরথ ও তাঁর স্ত্রীর দিন কেটে যাচ্ছিল কষ্টেসৃষ্টে । কিন্তু বিধি বাম । পাহাড়ের ওপারে বাবুদের ক্ষেতে দিনমজুরের কাজ করে দশরথ সকাল থেকে সন্ধ্যা । সরীসৃপের মতো পাহাড় বেয়ে তাকে প্রতিদিন দুপুরে খাবার পৌঁছে দেয় ফাল্গুনী । পাথর নড়ে , ভয় পায় ফাল্গুনী । একদিন ঘটলো মারাত্মক দুর্ঘটনা । পাহাড় থেকে পা পিছলে পড়ে গিয়ে ভয়ঙ্কর জখম হলো সে । খবর পেয়ে দশরথ ছুটে আসে। গরুর গাড়িতে ৭০ কিলোমিটার দূরে হাসপাতালে যাওয়ার পথে দশরথের কোলেই মারা গেল ফাল্গুনী । এরপর এলোমেলো বিধ্বস্ত হয়ে যায় দশরথের জীবন । তখনই ভাবনা আসে , কিছু একটা করতেই হবে । আর কেউ যাতে বিনা চিকিৎসায় মারা না যায় সেই ব্যবস্থা করতেই হবে । পাহাড় কেটে বানাতে হবে পথ ।

ডিনামাইট নেই , পাথর কাটার মেশিন নেই , সঙ্গীসাথী নেই , আছে শুধু স্বপ্ন আর সংকল্প । দিনমজুরের কাজ ছেড়ে দেয় দশরথ । একা পাহাড় কাটতে আরম্ভ করে । লোকে ঠাট্টা করে , ‘ বউয়ের শোকে পাগল হয়ে গেছে দশরথ ‘ । কিন্তু দশরথ অটল । দিন যায় , মাস যায় , বছর যায় । বহু বছর পর একদিন গ্রামের লোকজন দেখতে পায় পাহাড়ের মাঝে এক বিশাল ফাটল । অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন দশরথ । প্রখর রোদে , ঝড়বাদলে যখন গ্রামের মানুষ নিশ্চিন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে , দশরথের হাতুড়ি তখনও থামে না ।

দীর্ঘ ২২ বছর পর একদিন ( ১৯৮২ ) শেষ পাথরটি কাটার পরে দশরথ তীব্র আক্রোশে সেটিকে লাথি মেরে গড়িয়ে দেন ঢালুপথে , তারপর কান্নায় ভেঙে পড়েন । সেদিন আচমকাই মেঘ ভাঙা বৃষ্টি নামে গেহলৌর গ্রামে । পাহাড় ভেঙে রাস্তা হয়েছে খবর পেয়ে দলে দলে গ্রামের লোকজন বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ছুটে আসে এবং অবাক হয়ে দেখে পাহাড়ের বুক চিরে শুয়ে আছে ৩৬০ ফুট লম্বা আর ৩০ ফুট চওড়া এক রাস্তা । গ্রামবাসীরা তুমুল উল্লাসে কাঁধে তুলে নেয় দশরথকে । ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পথকে কমিয়ে এনেছেন দশরথ মাত্র ১৫ কিলোমিটারে , ২২ বছর ধরে রক্তজল করা কঠিন পরিশ্রমে। খবর পেয়ে ছুটে আসে সংবাদ মাধ্যম । পাশে দাঁড়ায় বিহার সরকার । ৫ একর জমি উপহার পান দশরথ । সে জমি তিনি দান করে দেন গ্রামে হাসপাতাল তৈরির জন্য ।

আরও পড়ুন- ক্ষমা চাইলেন অরিন্দম শীল, চিঠি মহিলা কমিশনকে

আজ সেখানে তাঁরই নামে গড়ে উঠেছে হাসপাতাল । পান অঢেল সম্মান ও প্রচুর পুরস্কার । ‘ বিহারের ব্যক্তিত্ব ‘ সিরিজে তাঁকে নিয়ে একটি ডাকটিকিট ( স্ট্যাম্প ) প্রকাশ করে ভারতীয় ডাক বিভাগ ২৬ ডিসেম্বর , ২০১৩ সালে । দশরথের নিজের হাতে তৈরি রাস্তাটির নাম রাখা হয়’ দশরথ মাঝি রোড ‘ ।

 

 

 

Previous articleBreakfast news : ব্রেকফাস্ট নিউজ
Next articleToday’s market price আজকের বাজার দর