Saturday, August 23, 2025

‘যমুনা কে তীর’, উৎপল সিনহার কলম

Date:

Share post:

উৎপল সিনহা

সঙ্গীদের বললেন , ‘তাড়াতাড়ি তানপুরা বাঁধো , হাতে আর সময় নেই ‘ । দ্রুত বাঁধা হলো তানপুরা । উনি চোখ বুজে স্মরণ করলেন পরমেশ্বরকে , তারপর ধরলেন গান এবং গাইতে গাইতেই ঢলে পড়লেন মৃত্যুর কোলে ।

উস্তাদ আবদুল করিম খাঁ । শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সর্বকালের সেরাদের অন্যতম । মাদ্রাজ থেকে পণ্ডিচেরি যাচ্ছিলেন একটি সঙ্গীতানুষ্ঠানে যোগ দিতে । হঠাৎই ট্রেনের মধ্যে তাঁর বুকে প্রচণ্ড ব্যথা হতে থাকে , সঙ্গে ভয়ঙ্কর শ্বাসকষ্ট । যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে তিনি সঙ্গীদের নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে পড়েন সিঙ্গাপেরুমল কোইল স্টেশনে । প্ল্যাটফর্মেই তড়িঘড়ি চাদর বিছিয়ে মহান আল্লাহর আরাধনা করতে কাবার দিকে মুখ করে নামাজ পড়েন শিল্পী। সুর বাঁধা হয় তানপুরায়। সাধক আবদুল করিম খান উপলব্ধি করেন তাঁর শেষদিন সমাগত । তানপুরা হাতে নিয়ে সেই নিঝুম রাতে তিনি দরবারি কানাড়া রাগে মহান আল্লাহ পাকের গুনগান গাইতে গাইতে অন্তিম পথের উদ্দেশে যাত্রা করেন । ১৯৩৭ সালের ২৭ অক্টোবর , তখন ছিল মধ্যরাত । এভাবেই নির্বাপিত হয় দেবপ্রতিম এক কিংবদন্তি শিল্পীর জীবনদীপ । তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন , ‘ whatever he sang was music ‘ , আর উস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ চিৎকার করে উঠেছিলেন , ‘ হায় আল্লাহ , আজ সে সুর মর গয়া হিন্দুস্থান মে ‘ !

দেখতে রোগা-পাতলা কিন্তু নিয়মিত শরীরচর্চা এবং সুশৃঙ্খল ও মিতব্যয়ী মরমী এই কণ্ঠশিল্পী বীণা , সেতার , তবলা ও সারেঙ্গী বাদনেও বিশেষ পারঙ্গম ছিলেন । বাদ্যযন্ত্র মেরামত করতে পারতেন নিপুণ হাতে । হাতে একটি বেত , সাধারণ গোঁফ , একটি লাল সোনার সীমানা যুক্ত পাগড়ি শোভিত , কালো আচকান পরিহিত এই লম্বা মানুষটির স্বপ্নালু চোখদুটি ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয় ।

১৮৭২ সালের ১১ নভেম্বর উত্তর প্রদেশের শামলির কিরানা ( কাইরানা ) শহরে এক সাঙ্গীতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আবদুল করিম খান । শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে প্রতিটি স্বরের বিশিষ্টতা ও গুরুত্ব প্রতিফলিত হওয়া উচিত কণ্ঠশিল্পীদের কলানৈপুণ্যে , একথা মেনে প্রতিটি স্বরকে প্রতিষ্ঠা দেওয়া গায়ক ও গায়িকাদের অবশ্য কর্তব্য বলে মনে করতেন তিনি । কণ্ঠ তথা কণ্ঠশৈলীতে এক অনন্য মাত্রা এনেছিলেন তিনি । সুরেলা বিস্তারের সাহায্যে ধীরগতিতে রাগরূপ প্রকাশ ছিল তাঁর গায়নশৈলীর সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিক ।

অন্যান্য ঘরানার উৎকৃষ্ট দিকগুলিকে উদারচিত্তে গ্রহণ না করলে নিজেদের ঘরানার উৎকর্ষসাধন অসম্ভব বলে তিনি মনে করতেন । তিনি পছন্দ করতেন গোয়ালিয়র ঘরানার শৈলী । এছাড়াও তিনিই প্রথম সঙ্গীতজ্ঞ যিনি কর্ণাটিক পদ্ধতির গুরুত্ব অনুধাবন করেন এবং সম্ভবত প্রথম , যিনি সমগ্র দক্ষিণ ভারতে গান গাওয়ার জন্য আমন্ত্রিত হন । তাঁর কণ্ঠের প্রশান্তি এবং গানের বিরামের স্টাইল এমন ছিল যে শ্রোতারা সহজে ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারতেন না । সারা বিশ্বকে সুরে সুরে মন্ত্রমুগ্ধ করার কৌশল জানতেন এই মহান শিল্পী । তাঁর ধ্যানমগ্ন সঙ্গীত পরিবেশনে শ্রোতারা সুরের মায়াজালে আচ্ছন্ন হয়ে পড়তেন । তিনি শুধুমাত্র ‘ কিরানা ‘ ঘরানার অন্যতম প্রবাদপ্রতিম নন , হিন্দুস্তানি ধ্রুপদী সঙ্গীত এবং কর্ণাটকী রাগের সফল সমন্বয়ে তিনি উত্তর ভারতীয় রাগ সঙ্গীতকে এক উচ্চতর মাত্রায় উন্নীত করেছিলেন । এরমধ্যে ‘ সাবেরী ‘ , ‘ বনধ্বনি ‘ ও ‘ আনন্দ ভৈরব ‘ উল্লেখযোগ্য। তাঁর ঠুমরি গায়নের মধ্যেও ছিল এক আশ্চর্য বৈচিত্র‌।

খেয়াল গানের ক্ষেত্রে তিনি জোর দিতেন আলাপের ওপর এবং সচরাচর লয়কারি ও বোল-তান এড়িয়ে যেতেন । খুব সম্ভবত তিনি মনে করতেন এগুলো খেয়ালের আবহকে নষ্ট করতে পারে । সঙ্গীতের মায়াবী পরিবেশ নষ্ট হয় এমন কিছু করা থেকে তিনি বিরত থাকতেন । বলা হয় , পুনরাবৃত্তি বর্জন মহৎ শিল্প । কিন্তু এই মহৎ শিল্পটি আয়ত্ব করা যেমন কঠিন , তার চেয়েও বেশি কঠিন এর সফল প্রয়োগ , যা অনায়াসে করতেন আবদুল করিম খান । খেয়াল ও ঠুমরির গায়কীতে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেই ক্ষান্ত হননি তিনি , রাগসঙ্গীতের এই দুই ধারার মেলবন্ধন ঘটানোর ক্ষেত্রেও তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য ।

১৯৩৬ সালে অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্সে তাঁর গান শোনার জন্য গোটা কলকাতা যেন ভেঙে পড়েছিল । গাইছিলেন রাগ পরজ-বসন্ত । সুরের জাদুতে সম্মোহিত শ্রোতারা একসময় লক্ষ্য করলেন মঞ্চে শিল্পী যেন হাঁ করে আছেন , তাঁর মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোচ্ছে না । পাশে শুধু একজোড়া তানপুরা বাজছে । সম্বিত ফিরলে শ্রোতারা বুঝতে পারলেন সযত্নে মেলানো তানপুরা আর হারমোনিয়ামের ষড়জ তাঁর কণ্ঠস্বরের সঙ্গে এমনভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল যে সবারই মনে হয়েছিল তিনি বুঝি গাইছেন না !

গান ছাড়া তাঁর অন্যতম শখ ছিল ঘুড়ি ওড়ানো । সঙ্গীত নিয়ে তাঁর কোনো সঙ্কীর্ণতা ছিল না । তিনি গুরুকুল প্রথায় গান শেখাতেন । যা রোজগার করতেন তার অধিকাংশই খরচ করতেন শিষ্যদের জন্য এবং সঙ্গীতের উন্নয়নের জন্য । উদার ও দিলদরিয়া স্বভাবের এই শিল্পী ফকিরের মতো সাদাসিধে জীবন যাপন করতেন । তাঁর অপরূপ গায়কীতে খুঁজে পাওয়া যেত সারেঙ্গীর গমক ও বীণার মীড় । ললিত , জৌনপুরী , মারবা , মালকোষ ইত্যাদি ছিল তাঁর খুব পছন্দের রাগ । ঝিঁঝোটি রাগে গাওয়া তাঁর ‘ পিয়া বিন নাহি আবত ‘ এবং ভৈরবী রাগে গাওয়া ‘ যমনা কে তীর ‘ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মাইলফলক হয়ে আছে । হিন্দু মুসলিম ভেদাভেদের ছায়া তাঁর জীবনে কখনও পড়ে নি।

তিনি মন্দিরে বসে গাইতেন উপাসনা সঙ্গীত , আর দরগায় বসে আপনমনে গাইতেন আল্লা-বন্দনা । তাঁর গাওয়া ‘ হরিকে ভেদ না পায়ো রামা ‘ তৎকালীন বিদ্বজ্জনেরা বারবার শুনতে চাইতেন ।‌ শোনা যায় আবদুল করিমের গলা নষ্ট করে দেওয়ার জন্য তাঁকে দু’বার বিষ খাওয়ানো হয়েছিল । কিন্তু দু’বারই শত্রুদের মুখে ছাই দিয়ে তিনি বেঁচে যান । রেওয়াজের সময় তাঁর পোষা কুকুর ‘ টিপুমিঞা ‘ তাঁর গানে অদ্ভুতভাবে গলা মেলাতো । রাতারাতি খ্যাতি পায় সেই সুরেলা কুকুরটিও ।

আবদুল করিম খানের গানের আবেদন আজও অমলিন । ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ইতিহাসের এক অত্যুজ্জ্বল অধ্যায় উস্তাদ আবদুল করিম খান , কিংবদন্তি শিল্পী হিসেবে যাঁর নাম চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হবে ।

আরও পড়ুন- তাজমহলের রক্ষণাবেক্ষণে গাফিলতি! ছাদ ফুটো হয়ে চুঁইয়ে বৃষ্টির জল পড়ছে ‘সপ্তম আশ্চর্যে’

 

spot_img

Related articles

বাংলা দখলে প্রধানমন্ত্রীর ‘হতাশার আর্তনাদ’! ভিডিও দেখিয়ে তোপ তৃণমূলের

বাংলার মানুষকে দিনের পর দিন বঞ্চিত রেখে বাঙালির কাছেই ভোট ভিক্ষা! বাঙালিকে একের পর এক রাজ্যে হেনস্থা করে...

সঠিক পরিকল্পনাই ডায়মন্ডহারবারের সাফল্যের চাবিকাঠি, মনে করছেন আকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়

মাত্র তিন বছরের ক্লাব। কিন্তু কী অসাধারণ সাফল্য। কলকাতা লিগ, আইলিগ থ্রি থেকে আইলিগ টু জিতে এবার আইলিগের...

অসংগঠিত শ্রমিক-ক্ষেত্রে পথ দেখাচ্ছে বাংলা: সাহায্য পেলেন ৭২০ শ্রমিক

একের পর এক নতুন প্রকল্প, অসংগঠিত শ্রমিকদের দাবিদাওয়া নিয়ে লাগাতার আলোচনা, তাঁদের পরিবারের প্রতি নজর রাখার ব্যাপারে তৎপর...

প্রাপ্য চায় বাংলা, উপহার না: মোদিকে জবাব তৃণমূলের

বাংলার মানুষ উপহার চায় না, প্রাপ্য চায়। উপহার দিয়ে বাংলার মানুষকে অপমান করবেন না। বাংলায় বরাদ্দ নিয়ে শুক্রবার...