‘যমুনা কে তীর’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

সঙ্গীদের বললেন , ‘তাড়াতাড়ি তানপুরা বাঁধো , হাতে আর সময় নেই ‘ । দ্রুত বাঁধা হলো তানপুরা । উনি চোখ বুজে স্মরণ করলেন পরমেশ্বরকে , তারপর ধরলেন গান এবং গাইতে গাইতেই ঢলে পড়লেন মৃত্যুর কোলে ।

উস্তাদ আবদুল করিম খাঁ । শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সর্বকালের সেরাদের অন্যতম । মাদ্রাজ থেকে পণ্ডিচেরি যাচ্ছিলেন একটি সঙ্গীতানুষ্ঠানে যোগ দিতে । হঠাৎই ট্রেনের মধ্যে তাঁর বুকে প্রচণ্ড ব্যথা হতে থাকে , সঙ্গে ভয়ঙ্কর শ্বাসকষ্ট । যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে তিনি সঙ্গীদের নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে পড়েন সিঙ্গাপেরুমল কোইল স্টেশনে । প্ল্যাটফর্মেই তড়িঘড়ি চাদর বিছিয়ে মহান আল্লাহর আরাধনা করতে কাবার দিকে মুখ করে নামাজ পড়েন শিল্পী। সুর বাঁধা হয় তানপুরায়। সাধক আবদুল করিম খান উপলব্ধি করেন তাঁর শেষদিন সমাগত । তানপুরা হাতে নিয়ে সেই নিঝুম রাতে তিনি দরবারি কানাড়া রাগে মহান আল্লাহ পাকের গুনগান গাইতে গাইতে অন্তিম পথের উদ্দেশে যাত্রা করেন । ১৯৩৭ সালের ২৭ অক্টোবর , তখন ছিল মধ্যরাত । এভাবেই নির্বাপিত হয় দেবপ্রতিম এক কিংবদন্তি শিল্পীর জীবনদীপ । তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন , ‘ whatever he sang was music ‘ , আর উস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ চিৎকার করে উঠেছিলেন , ‘ হায় আল্লাহ , আজ সে সুর মর গয়া হিন্দুস্থান মে ‘ !

দেখতে রোগা-পাতলা কিন্তু নিয়মিত শরীরচর্চা এবং সুশৃঙ্খল ও মিতব্যয়ী মরমী এই কণ্ঠশিল্পী বীণা , সেতার , তবলা ও সারেঙ্গী বাদনেও বিশেষ পারঙ্গম ছিলেন । বাদ্যযন্ত্র মেরামত করতে পারতেন নিপুণ হাতে । হাতে একটি বেত , সাধারণ গোঁফ , একটি লাল সোনার সীমানা যুক্ত পাগড়ি শোভিত , কালো আচকান পরিহিত এই লম্বা মানুষটির স্বপ্নালু চোখদুটি ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয় ।

১৮৭২ সালের ১১ নভেম্বর উত্তর প্রদেশের শামলির কিরানা ( কাইরানা ) শহরে এক সাঙ্গীতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আবদুল করিম খান । শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে প্রতিটি স্বরের বিশিষ্টতা ও গুরুত্ব প্রতিফলিত হওয়া উচিত কণ্ঠশিল্পীদের কলানৈপুণ্যে , একথা মেনে প্রতিটি স্বরকে প্রতিষ্ঠা দেওয়া গায়ক ও গায়িকাদের অবশ্য কর্তব্য বলে মনে করতেন তিনি । কণ্ঠ তথা কণ্ঠশৈলীতে এক অনন্য মাত্রা এনেছিলেন তিনি । সুরেলা বিস্তারের সাহায্যে ধীরগতিতে রাগরূপ প্রকাশ ছিল তাঁর গায়নশৈলীর সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিক ।

অন্যান্য ঘরানার উৎকৃষ্ট দিকগুলিকে উদারচিত্তে গ্রহণ না করলে নিজেদের ঘরানার উৎকর্ষসাধন অসম্ভব বলে তিনি মনে করতেন । তিনি পছন্দ করতেন গোয়ালিয়র ঘরানার শৈলী । এছাড়াও তিনিই প্রথম সঙ্গীতজ্ঞ যিনি কর্ণাটিক পদ্ধতির গুরুত্ব অনুধাবন করেন এবং সম্ভবত প্রথম , যিনি সমগ্র দক্ষিণ ভারতে গান গাওয়ার জন্য আমন্ত্রিত হন । তাঁর কণ্ঠের প্রশান্তি এবং গানের বিরামের স্টাইল এমন ছিল যে শ্রোতারা সহজে ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারতেন না । সারা বিশ্বকে সুরে সুরে মন্ত্রমুগ্ধ করার কৌশল জানতেন এই মহান শিল্পী । তাঁর ধ্যানমগ্ন সঙ্গীত পরিবেশনে শ্রোতারা সুরের মায়াজালে আচ্ছন্ন হয়ে পড়তেন । তিনি শুধুমাত্র ‘ কিরানা ‘ ঘরানার অন্যতম প্রবাদপ্রতিম নন , হিন্দুস্তানি ধ্রুপদী সঙ্গীত এবং কর্ণাটকী রাগের সফল সমন্বয়ে তিনি উত্তর ভারতীয় রাগ সঙ্গীতকে এক উচ্চতর মাত্রায় উন্নীত করেছিলেন । এরমধ্যে ‘ সাবেরী ‘ , ‘ বনধ্বনি ‘ ও ‘ আনন্দ ভৈরব ‘ উল্লেখযোগ্য। তাঁর ঠুমরি গায়নের মধ্যেও ছিল এক আশ্চর্য বৈচিত্র‌।

খেয়াল গানের ক্ষেত্রে তিনি জোর দিতেন আলাপের ওপর এবং সচরাচর লয়কারি ও বোল-তান এড়িয়ে যেতেন । খুব সম্ভবত তিনি মনে করতেন এগুলো খেয়ালের আবহকে নষ্ট করতে পারে । সঙ্গীতের মায়াবী পরিবেশ নষ্ট হয় এমন কিছু করা থেকে তিনি বিরত থাকতেন । বলা হয় , পুনরাবৃত্তি বর্জন মহৎ শিল্প । কিন্তু এই মহৎ শিল্পটি আয়ত্ব করা যেমন কঠিন , তার চেয়েও বেশি কঠিন এর সফল প্রয়োগ , যা অনায়াসে করতেন আবদুল করিম খান । খেয়াল ও ঠুমরির গায়কীতে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেই ক্ষান্ত হননি তিনি , রাগসঙ্গীতের এই দুই ধারার মেলবন্ধন ঘটানোর ক্ষেত্রেও তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য ।

১৯৩৬ সালে অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্সে তাঁর গান শোনার জন্য গোটা কলকাতা যেন ভেঙে পড়েছিল । গাইছিলেন রাগ পরজ-বসন্ত । সুরের জাদুতে সম্মোহিত শ্রোতারা একসময় লক্ষ্য করলেন মঞ্চে শিল্পী যেন হাঁ করে আছেন , তাঁর মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোচ্ছে না । পাশে শুধু একজোড়া তানপুরা বাজছে । সম্বিত ফিরলে শ্রোতারা বুঝতে পারলেন সযত্নে মেলানো তানপুরা আর হারমোনিয়ামের ষড়জ তাঁর কণ্ঠস্বরের সঙ্গে এমনভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল যে সবারই মনে হয়েছিল তিনি বুঝি গাইছেন না !

গান ছাড়া তাঁর অন্যতম শখ ছিল ঘুড়ি ওড়ানো । সঙ্গীত নিয়ে তাঁর কোনো সঙ্কীর্ণতা ছিল না । তিনি গুরুকুল প্রথায় গান শেখাতেন । যা রোজগার করতেন তার অধিকাংশই খরচ করতেন শিষ্যদের জন্য এবং সঙ্গীতের উন্নয়নের জন্য । উদার ও দিলদরিয়া স্বভাবের এই শিল্পী ফকিরের মতো সাদাসিধে জীবন যাপন করতেন । তাঁর অপরূপ গায়কীতে খুঁজে পাওয়া যেত সারেঙ্গীর গমক ও বীণার মীড় । ললিত , জৌনপুরী , মারবা , মালকোষ ইত্যাদি ছিল তাঁর খুব পছন্দের রাগ । ঝিঁঝোটি রাগে গাওয়া তাঁর ‘ পিয়া বিন নাহি আবত ‘ এবং ভৈরবী রাগে গাওয়া ‘ যমনা কে তীর ‘ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মাইলফলক হয়ে আছে । হিন্দু মুসলিম ভেদাভেদের ছায়া তাঁর জীবনে কখনও পড়ে নি।

তিনি মন্দিরে বসে গাইতেন উপাসনা সঙ্গীত , আর দরগায় বসে আপনমনে গাইতেন আল্লা-বন্দনা । তাঁর গাওয়া ‘ হরিকে ভেদ না পায়ো রামা ‘ তৎকালীন বিদ্বজ্জনেরা বারবার শুনতে চাইতেন ।‌ শোনা যায় আবদুল করিমের গলা নষ্ট করে দেওয়ার জন্য তাঁকে দু’বার বিষ খাওয়ানো হয়েছিল । কিন্তু দু’বারই শত্রুদের মুখে ছাই দিয়ে তিনি বেঁচে যান । রেওয়াজের সময় তাঁর পোষা কুকুর ‘ টিপুমিঞা ‘ তাঁর গানে অদ্ভুতভাবে গলা মেলাতো । রাতারাতি খ্যাতি পায় সেই সুরেলা কুকুরটিও ।

আবদুল করিম খানের গানের আবেদন আজও অমলিন । ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ইতিহাসের এক অত্যুজ্জ্বল অধ্যায় উস্তাদ আবদুল করিম খান , কিংবদন্তি শিল্পী হিসেবে যাঁর নাম চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হবে ।

আরও পড়ুন- তাজমহলের রক্ষণাবেক্ষণে গাফিলতি! ছাদ ফুটো হয়ে চুঁইয়ে বৃষ্টির জল পড়ছে ‘সপ্তম আশ্চর্যে’

 

Previous articleতাজমহলের রক্ষণাবেক্ষণে গাফিলতি! ছাদ ফুটো হয়ে চুঁইয়ে বৃষ্টির জল পড়ছে ‘সপ্তম আশ্চর্যে’
Next articleBreakfast Sports : ব্রেকফাস্ট স্পোর্টস