হরিয়ানা নির্বাচন: খড়কুটোর মতো উড়ে যাবে বিজেপি? হাল ধরবে হাত!

ড. কল্যাণ গোস্বামী

দিল্লির পাশেই হরিয়ানা রাজ্য। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, হরিয়ানার ভোট প্রকৃতি এবং নির্বাচনী বিশ্লেষণ করা অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় সহজতর। প্রথমত, এই রাজ্যটি আয়তনে বেশ বড় হলেও লোকসংখ্যা অতটা বেশি নয়। দ্বিতীয়ত, এখানকার জনগণ রেখে ঢেকে কথা বলে না। স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এ রাজ্যের লোকেরা তাদের রাগ উষ্মা আনন্দ প্রকাশ করে থাকে। এবারের বিধানসভা নির্বাচনে পরিষ্কারভাবে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হাওয়া আকাশে বাতাসে অনুভূত হচ্ছে। রাজ্যে শতকরা ৩৪-৩৫ ভাগ যুবক-যুবতীর হাতে চাকরিবাকরি নেই। গুরুগ্রাম ফরিদাবাদ পাঞ্চকুলা কারনাল এসব শহরের কর্পোরেট শিক্ষিত বহিরাগতদের ভিড়। বিজেপি সরকারের আমলে দেশে গ্রামীণ অর্থনীতি এবং বেকারত্বই যে মূল সমস্যা সেটা বিজেপি এখনও বুঝতে পারছে না। অথচ লোকসভা নির্বাচনের আগেই বোঝা যাচ্ছিল, বেকারত্ব একটা বড় ইস্যু।

লোকসভা নির্বাচনে ইন্ডিয়া জোট আশানুরূপভাবেই হরিয়ানার দশটির মধ্যে পাঁচটি আসন জিতে ফেলার পরেই বিজেপি টের পেয়েছিল যে বিধানসভা ভোটে রাজ্যের বেকারত্বের সমস্যা তাঁদের ভোগাবে। বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী নায়ব সিংহ সাইনি তড়িঘড়ি ঘোষণা করেছিলেন, বিধানসভা ভোটের আগেই ৫০ হাজার সরকারি শূন্যপদ পূরণ করা হবে। কিন্তু ফল হয়েছে উল্টো। মাসে ১৫ হাজার টাকা বেতনের ঝাডুদারের চাকরির জন্য প্রায় ৪০ হাজার স্নাতক এবং ৬ হাজারের বেশি স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী আবেদন করেছেন। আকস্মিকভাবে এই ঘটনার সুবাদে হরিয়ানার বেকারত্বের সমস্যা ভোটের আগে আগেই নগ্নভাবে উঠে এসেছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রবল অস্বস্তির মুখে বিজেপি!

হরিয়ানায় বেকারত্বের হার এ-মুহূর্তে ৩৪-৩৫ শতাংশ। রাজ্য সরকারে ২ লক্ষের বেশি শূন্যপদ পড়ে রয়েছে। সরকার সময় সময়ে ঠিকা কর্মী নিয়োগ করছে। তাঁরা ন্যূনতম বেতনও পাচ্ছেন না। উল্টে হরিয়ানা সরকার রাজ্যের ১০ হাজার ছেলেকে ইজরায়েলে শ্রমিক হিসেবে পাঠানোর বন্দোবস্ত করেছে! সম্প্রতি আমেরিকা সফরে গিয়ে সংসদে বিরোধী নেতা হরিয়ানার কয়েকজন যুবকের সঙ্গে দেখা করেছেন, যাঁরা চোরাপথে আমেরিকায় গিয়ে ট্রাক চালাচ্ছেন। চোরাপথে গিয়েছেন বলে দুর্ঘটনায় আহত হলেও বাড়ি ফিরতে পারছেন না। বিজেপির গত ১০ বছরের আমলে হরিয়ানা থেকে আমেরিকায় ছোটখাটো কাজের সন্ধানে চলে যাওয়া তরুণের সংখ্যা ৬০ গুণ বেড়েছে। কারণ, হরিয়ানার ১৫-৩০ বছর বয়সিদের প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন বেকার। বছরে ৩০ হাজার ছাত্র-ছাত্রী জমি বেচে দেশের অন্যত্র বা বিদেশে ডাক্তারি পড়তে যায়, অথচ রাজ্যে গত ১০ বছরে লোক দেখানো অনেকগুলির শিলান্যাস হলেও বাস্তবে একটিও নতুন মেডিক্যাল কলেজ চালু হয়নি। উচ্চশিক্ষার প্রতি রাজ্য সরকারের উদাসীনতার কারণে যুবসমাজ ফুঁসছে। ইভিএম-এ যার প্রতিফলন অবশ্যম্ভাবী।

অপরদিকে কেন্দ্রীয় সরকারের পুরোনো কৃষি আইন, কৃষক আন্দোলন এবং কৃষক মৃত্যুর কারণে হরিয়ানার কৃষকরা এবার বিজেপি প্রার্থীদের ২০-২২টি গ্রামীণ বিধানসভাক্ষেত্রে প্রচার পর্যন্ত করতে দিচ্ছে না। ঠিক এই কঠিন সময়ে বিজেপি নেত্রী কঙ্গনা রানায়তের কৃষি আইন লাগু করার মন্তব্য বিজেপির যথেষ্ট ক্ষতি করল বলে মনে হয়। বিজেপি নেত্রী পরবর্তীকালে ক্ষমা চেয়ে নিলেও ড্যামেজ কন্ট্রোল হবে বলে মনে হয় না। অন্যদিকে কৃষকদের ক্রোধ এতটাই প্রকট যে মনে হচ্ছে হরিয়ানার প্রাক্তন উপমুখ্যমন্ত্রী এবং জেজেপি-র নেতা দুষ্মন্ত চৌতালা হয়ত নিজ কেন্দ্রে তাঁর জামানত পর্যন্ত বাঁচাতে সক্ষম হবেন না। বিভিন্ন নির্বাচনী জনসভায় দুষ্মন্ত ইতিমধ্যেই খেদোক্তি করছেন যে, ‘বিজেপির সাথে যাওয়াটাই শেষমেশ তার রাজনৈতিক কাল হল।’

‘হরিয়ানায় আদানির সরকারে’র প্রয়োজন নেই। কৃষক, শ্রমিক এবং গরিব মানুষের কথা বলবে এমন সরকার গঠনের কথা বলছেন ইন্ডিয়া জোটের নেতৃত্ব। হরিয়ানা বিধানসভাকে কেন্দ্র করে ক্রমশ চড়ছে পারদ। মাটি কামড়ে সে-রাজ্যে পড়ে রয়েছেন কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব। গত সোমবার থেকে হরিয়ানার বুকে ‘সঙ্কল্প যাত্রা’ শুরু করেছেন সংসদের বিরোধী নেতা। কৃষক আন্দোলনে মৃত কৃষকদের শহিদ অ্যাখ্যা দেওয়া এবং পরিবারের একজনকে চাকরি দেওয়ার ঘোষণা অবিজেপি দলগুলোর পালে হাওয়া আনবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। বিরোধী পক্ষের সোশ্যাল মিডিয়া হরিয়ানা বিধানসভা নির্বাচনে যুব হতাশা, কুস্তিগির নিপীড়ন, কৃষক আন্দোলন, অগ্নিবীর প্রকল্প, মুদ্রাস্ফীতি এবং সংবিধানে জাত সংরক্ষণ এই বিষয়গুলিকে হাতিয়ার করেছে। দিল্লি সীমান্তে কৃষকদের উপর চালানো বর্বরতার কথা জনগণকে মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে! আন্দোলনের সময় ৭৫০ কৃষকের শহিদ হওয়ার কথা উঠে আসছে সোস্যাল মিডিয়ার প্রচারে। একইভাবে, মহিলা কুস্তিগিরদের সাথে যন্তর মন্তরে প্রতিবাদের সময় পুলিশি বর্বরতার ভিডিও প্রায় প্রতিদিনই জনগণের মোবাইলে পাঠানো হচ্ছে পুরোনো সেই ঘটনার কথা বারে বারে মনে করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে।

কড়া নিরাপত্তার মোড়কে হরিয়ানায় আজ বিধানসভা নির্বাচন 

চতুর্দিক থেকে আক্রমণ করে বিজেপিকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে ইন্ডিয়া জোট। খুব স্বাভাবিকভাবেই গত রবিবার গুরগাঁও বাদশাপুর কেন্দ্রে ভাষণরত অমিত শাহজিকে বেশ চিন্তিত লাগছিল। উনি চিরাচরিতভাবে মুসলমান পাকিস্তানের বাণী না শুনিয়ে রুজি রোজগারের কথা বললে ভাল করতেন। যা অবস্থা তাতে মনে হয় এই সিটে কংগ্রেসের সাথে লড়াই হবে নির্দলীয় এক মহিলা প্রার্থীর। বিজেপি তৃতীয় স্থান পেলেও পেতে পারে।

ওদিকে, রাজ্যে আম আদমি পার্টির অবস্থাও তথৈবচ। ২০১৯-এর হরিয়ানা বিধানসভা নির্বাচনে ৪৬টি সিটে প্রার্থী দিয়ে তারা পেয়েছিল ০.৪৩% ভোট। যেটা নোটার থেকেও কম। এবার ৯০টি কেন্দ্রে প্রার্থী দিলেও মনে হয় না নোটার চাইতে আম আদমি পার্টি বেশি ভোট পেতে সক্ষম। অপরদিকে জেজেপি এবং লোকদল খাদের কিনারায়। ওদের কজন শেষ পর্যন্ত জামানত বাঁচাতে পারে সেটাই এখন দেখার বিষয়। সুতরাং এবার হরিয়ানার লড়াই সরাসরি দুটি মেরুর মধ্যে। সেখানেও গ্রামীণ ৬৬টি সিটে অবজেপি একতরফা খেলছে। তবে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে শহরকেন্দ্রিক ২৪টি সিটে। কারণ হরিয়ানার শহরাঞ্চলে এখনও বিজেপির যথেষ্ট প্রতিপত্তি এবং জনসমর্থন রয়েছে।

হরিয়ানায় বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে দলিত, ওবিসি ভোটকে ‘পাখির চোখ’ করে প্রচার করছেন নরেন্দ্র মোদি। প্রচার করছেন, কংগ্রেস ক্ষমতায় এসে সংরক্ষণ তুলে দেবে। তবে ২০১৪ সনের মোদি ইমেজের সাথে ২০২৪-এর মোদি ইমেজের কোনও মিল নেই। বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে। তাই জনসভায় লোক আসছে না। দলীয় কর্মীরাও দিশাহারা এবং হতাশায় ভুগছে। সদ্য মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে সরে যাওয়া হাই-প্রোফাইল নেতা মনোহর খাট্টারকে র‍্যালিতে দেখা যাচ্ছে না। এবার কিন্তু এখনও বিজেপির একজন নেতাকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি যে জোর গলায় বলতে পারে, বিজেপি অন্তত ২৫টি সিট পাবে! আবার, নির্বাচনের ঠিক আগে আগেই বড় ধাক্কা খেয়েছে বিজেপি। দলবিরোধী কাজের জন্য দুই প্রাক্তন মন্ত্রী-সহ মোট আট জন প্রার্থীকে বহিষ্কার করতে বাধ্য হয়েছে বিজেপি। বহিষ্কারের তালিকায় প্রাক্তন মন্ত্রী রঞ্জিত চৌটালার নাম রয়েছে। বহিষ্কার করা হয়েছে লাডওয়া থেকে মুখ্যমন্ত্রী নয়াব সিং সাইনির বিরুদ্ধে ভোটে লড়তে চেয়ে মনোনয়ন জমা দেওয়া সন্দীপ গর্গকেও। তবে পিছিয়ে নেই কংগ্রেসও। হাত শিবির ইতিমধ্যে দলবিরোধী কাজের জন্য ১৩ জনকে বহিষ্কার করেছে। ভোটের মুখে আচমকা এমন সিদ্ধান্ত কংগ্রেস ও বিজেপিকে কতটা স্বস্তি দেয় সেটাই এখন দেখার।

বলা যায় এই নির্বাচন সম্পূর্ণভাবে বিজেপির বিরুদ্ধে। গত ১০ বছর মাটি কামড়ে পড়ে থাকার ফল ভূপেন্দ্র সিং হুডা পেতে চলেছেন। অর্ধেকেরও বেশি বিজেপির মন্ত্রী এই নির্বাচনে হেরে যেতে পারে। হাইপ্রোফাইল মন্ত্রী নায়েব সিং সাইনি (মূখ্যমন্ত্রী), অনিল ভিজ, ক্যাপ্টেন অভিমন্যু হেরে গেলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।

বোঝাই যাচ্ছিল, লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানো দিয়ে বিজেপির অধোগতি শুরু হবে। সত্যি বলতে কি আগামী ২-৩ বছরে একটি রাজ্যের নির্বাচনেও বিজেপি জেতার মতো অবস্থায় নেই! সে-কারণেই হয়ত থেকে থেকে ‘এক দেশ এক নির্বাচনে’র জিগির তুলছে বিজেপি!!