Wednesday, November 12, 2025
উৎপল সিনহা

এসো এসো মাগো

দেবী দশভূজা
এসো মা শারদজননী
এসো মা ভবানী
পিনাকধারিনী
এসো মা ভুবনমোহিনী ।

এই যে আগমনী গান , একি শুধু গানের জন্য গান ? শুধু কি কথা ও সুর , তাল ও লয় , আর ছন্দের নন্দিত বন্দনা ? এর সঙ্গে কি জড়িয়ে নেই হাজারো পেশার অগণ্য মানুষের রুটিরুজি , সারা বছরের অন্নসংস্থান ? একি শুধু কথার পিঠে কথা বসিয়ে মাকে তুষ্ট করার অভিসন্ধি?

এসো মা আশ্বিনে শারদপ্রাতে
এসো শুভ্র মেঘের রথে
দুঃখের সংসারে
খুশি নিয়ে এসো
এসো দুর্গতিনাশিনী ।

যাঁরা বিষাক্ত সাপের ছোবল উপেক্ষা করে প্রাণ হাতে নিয়ে পদ্ম তোলেন মায়ের পূজার অর্ঘ্য সম্পূর্ণ করার অভিপ্রায়ে , সে কি শুধুই কিছু বাড়তি রোজগারের আশায় ?

এতে কোনো সমর্পণ নেই ? সন্তানকে দুধেভাতে রাখার বাসনা কি মিশে নেই অমূল্য পদ্ম আহরণে ? শুধু কি পদ্ম ? আমাদের তথাকথিত সভ্য নাগরিক সমাজে একপ্রকার ব্রাত্য বারাঙ্গনা তকমাপ্রাপ্ত অসংখ্য মা-বোনেরা অপেক্ষা করেন সারাটা বছর শুধুমাত্র এক চিলতে সম্মানপ্রাপ্তির আশায় , যখন কিনা হাজার হাজার মণ্ডপে দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে ‘ বেশ্যাবাড়ির মাটি’ দারুণ মূল্যবান হয়ে ওঠে ।

জমানো চোখের জলে
শাপলা শালুক ফুলে
অর্ঘ্য রচেছি যতনে
অঞ্জলি নিও আর
আশ্রয় দিও মাগো
তোমার রাতুল চরণে ।

শাপলা-শালুক চয়ণ করেন যাঁরা , সারা বছর অভাবের মেঘে ঢাকা থাকে তাঁদের সাধের সংসার । শারদোৎসব তাঁদের হাতে এনে দেয় কিছু কাঁচা পয়সা । যদিও সাময়িক , তবুও মায়ের আগমন ছাড়া এও কি জুটতো ?

আর ঢাকি ভাইয়েরা ? বোধনের দিন থেকে যাঁরা আনন্দের হিল্লোল তোলেন তালে তালে ছন্দে ছন্দে হরেক বোল আর লয়কারীর জাদুতে ? আমরা সমস্বরে উচ্ছল হয়ে উঠি , ‘ ওই তো ঢাকে কাঠি পড়েছে ‘ ! কিন্ত যতই তাল ঠুকি না কেন , আসল ‘ বোল ‘ তো লুকিয়ে থাকে হাজারো ঢাকি ভায়েদের বুকের গভীরে কান্না হয়ে । কি সেই ‘ বোল ‘ ?
‘ ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ
ঠাকুর যাবে বিসর্জন ‘ ।

একলপ্তে হাজার কয়েক টাকা আসবে বটে হাতে , কিন্তু সে সব তো ফুরিয়ে যাবে কিছুদিনের মধ্যেই । তারপর খাবো কি বাবু ? কিভাবে সংসার চলবে আমাদের ? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে পৃথিবীর আহ্নিক গতি যেন থমকে যায় । কেউ কি বলতে পারেন দুর্গাপূজা শেষ হয়ে গেলে কীভাবে চলবে ঢাকশিল্পীদের সংসার ?

যাঁরা চাঁদমালা বানান , পুজোর ছোট ছোট অথচ ভীষণ জরুরি উপাদানের জোগান দেন , তাঁদের সারা বছর কতটা টানাটানির মধ্যে দিয়ে কাটাতে হয় তার খবরই বা কে রাখে ? যাঁরা প্যান্ডেলের বাঁশ বাঁধেন , অসামান্য সব মণ্ডপসজ্জার কাঠামো তৈরি করেন দিনরাত এক করে , তাঁরা শারদোৎসব শেষ হয়ে গেলে কীভাবে বাঁচেন ?

জগতের লাঞ্ছিত আতুর জনে
বরাভয় দিও
বল দিও গো প্রাণে
দাও মা সুরের আলো
ছড়িয়ে আঁধারে
ওগো মা করুণারূপিনী ।।
বরাভয়দাত্রীর কৃপা করুণা কারা পান ? যাঁদের প্রকৃতই পাওয়া উচিত তাঁরা পান কি ? সম্পন্ন ব্যবসায়ীরা শারদোৎসবের পর ফুলে ফেঁপে ওঠেন । কিন্তু পুজোয় যুক্ত থাকেন হাজার হাজার গরীব মানুষ । পুজোর বিশাল অর্থনীতি থেকে তাঁদের প্রাপ্তি যথারীতি যৎসামান্য , ছিটেফোঁটা । সন্তানদের দুধেভাতে রাখাটা তাঁদের কাছে স্বপ্নই । তবু নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালোর মতো তাঁরা বছরভর চাতকের মতো অপেক্ষা করতে থাকেন মায়ের আগমনের । কিছুই না পাওয়ার চেয়ে বছরের ওই বিশেষ চারদিনের নগদপ্রাপ্তি তো ভালো বটেই ।

আরও পড়ুন- সারেগামাপার মঞ্চে দরদী রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়ে মন জিতলেন জাভেদ

অটো বা টোটোর মতো ছোট গাড়ির চালকেরা পুজোয় বাড়তি কিছু রোজগার করেন। বড়ো ও বিখ্যাত পুজোমণ্ডপের আশেপাশে চা-পান-চপ-ঘুঘনি-ঝালমুড়ি-ফুচকা ও অন্যান্য ছোট ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত কিছু রোজগার করার সুযোগ পান অবশ্যই । মেলা বসে অনেক জায়গায় । দরিদ্র ব্যবসায়ীদের মুখে সামান্য হাসি ফুটে ওঠে ওই ক’টা দিন। আলোক শিল্পী , মাইক্রোফোন ব্যবসায়ী , ডেকরেটর্স , ফল ও ফুল বিক্রেতা , বাসন ও দশকর্মা ব্যবসায়ী , মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী ও পেশাদার গায়ক-গায়িকারা সাধারণত ভালো রোজগার করেন শারদোৎসবে । কিন্তু এখানে যুক্ত দরিদ্র শ্রমিক ও কর্মচারীরা অন্যান্য সময়ের চেয়ে কিছুটা বেশি রোজগারের মুখ দেখলেও সারা বছরের জন্য তা নেহাতই অপ্রতুল । তবুও তাঁরা সম্ভবত এই ভেবেই নিজেদের সান্ত্বনা দিতে থাকেন যে ,’ … তবুও শান্তি তবু আনন্দ তবু অনন্ত জাগে ‘ । এটা কিন্তু অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে , মায়ের মুখের হাসি সমস্ত দুঃখ ভুলিয়ে দেয় । হাজার কষ্টের মাঝেও অপার শান্তি অনুভূত হয় । মায়ের আগমণে অনন্ত জাগে । বিশ্বচরাচর আনন্দময় হয়ে ওঠে ।

 

Related articles

বৃষ্টির জল সংরক্ষণে নজির: কেন্দ্রের পুরস্কার বাংলার দুই প্রতিষ্ঠানকে, উচ্ছ্বসিত মুখ্যমন্ত্রী

বৃষ্টির জল সংরক্ষণে অসামান্য উদ্যোগের স্বীকৃতি স্বরূপ কেন্দ্রীয় সরকারের  (Central Govt) ‘জল সংরক্ষণ পুরস্কার পাচ্ছে রাজ্যের দুটি প্রতিষ্ঠান। ...

সততার সঙ্গে মন্ত্রিত্ব করেছি? বলেন কী পার্থ!

তিনবছর তিনমাস কারা মুক্তির পরে বাড়ি ফিরে প্রথম রাতে ঘুমোতে পারেননি প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় (Partha Chattopadhyay)। বুধবার,...

একনজরে আজ পেট্রোল-ডিজেলের দাম 

১২ নভেম্বর (বুধবার), ২০২৫ কলকাতায় লিটার প্রতি পেট্রোলের দাম ১০৫.৪১ টাকা, ডিজেলের দাম লিটার প্রতি ৯২.০২ টাকা দিল্লিতে...

দু-ধরনের রাসায়নিকেই বিস্ফোরণ! দিল্লি কাণ্ডে নজর ঘাতক গাড়ির গতিবিধিতেও

দিল্লির লালকেল্লা এলাকায় বিস্ফোরণের (Delhi blast near Red fort area) ঘটনায় দু’টি তাজা কার্তুজ এবং দু’ধরনের বিস্ফোরকের নমুনা...
Exit mobile version