‘কালো বিড়াল সাদা বিড়াল’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

ব্যস্ত রাস্তা হঠাৎই থমকে থেমে আছে । অকুস্থল ফাঁকা। দু’পাশে প্রচুর গাড়ি দাঁড়িয়ে । পথচারীরা নট নড়ন-চড়ন ! কিন্তু কেন ? কী ব্যাপার ? বিড়াল রাস্তা কেটেছে ! সবাই অপেক্ষা করছে কে বা কারা ঝুঁকি নিয়ে শুরু করবে আবার পথচলা ।

ভিড়ের মধ্যে হঠাৎই এক যুবক ‘ তাহলে আমিই মরি আজ , আপনারা বেঁচে থাকুন অনন্তকাল ‘ ব’লে অকুস্থল পেরিয়ে গেলেন বীরদর্পে । আর তখনই আবার শুরু হলো চলাচল । কেননা বাকি সবার ফাঁড়া নাকি কেটে গেছে । তাহলে যুবকটির কি কোনো বিপদ হবে আজ ? এক তো বিড়ালের রাস্তাকাটা ব্যাপারটাকে তুচ্ছ করলেন তিনি , তায় আবার তীব্র বিদ্রুপে নাগরিক সমাজকে বিঁধে গেলেন । মনে করিয়ে দিয়ে গেলেন এসব মধ্যযুগীয় সংস্কার ।

আজকের এই তথাকথিত আধুনিক যুগে দাঁড়িয়েও বহু মানুষের ধারণা , বিড়ালের পথ কাটা নাকি অশুভ লক্ষণ। কারণ , বিড়াল রাস্তা কেটেছে মানেই নাকি সেখানে রাহুর প্রভাব রয়েছে । শাস্ত্র অনুযায়ী , কালো রং নাকি শনিদেবের রং । জ্যোতিষশাস্ত্র অনুসারে , কালো বিড়াল রাস্তা কেটে যাচ্ছে মানে শনিদেব হয়তো আসন্ন বিপদের সঙ্কেত দিচ্ছেন ।

বিড়াল রাস্তা কাটলে , মানে রাস্তার মাঝখান দিয়ে বিড়াল পেরিয়ে গেলে পথচলতি মানুষ ও গাড়িঘোড়া কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে যায় । এ সংস্কার বহু যুগের । অনেকেই মনে করেন এটা একটা কুসংস্কার ছাড়া আর কিছু নয় । এর মধ্যে কোনো বিজ্ঞান নেই । এ ভীতির কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। তাহলে বিড়ালের রাস্তা কাটা ব্যাপারটাকে অশুভ মনে করা হয় কেন ?

প্রাচীনকালে , যখন গরুর গাড়ি ছিল অন্যতম প্রধান যানবাহন , তখন গরুদের সামনে দিয়ে বিড়াল পার হয়ে গেলেই গরুগুলো অস্থির হয়ে উঠতো । গরুদের শান্ত করতে তখন চালককে কিছুক্ষণের জন্য গাড়ি থামিয়ে দিতে হতো । সেই রেওয়াজই নাকি পরবর্তীকালে কুসংস্কারের রূপ নেয় এবং সেই থেকেই নাকি যে কোনোও গাড়ির সামনে দিয়ে বিড়াল পার হয়ে গেলেই গাড়ি তৎক্ষণাৎ থামিয়ে দেওয়ার রীতি চালু হয় । এ কোনো প্রশাসনের নির্দেশ নয় , মুখে মুখে ছড়িয়ে যাওয়া অন্ধবিশ্বাস । রয়েছে আরও কারণ । বিড়াল জাতীয় ছোট প্রাণীদের সাধারণত অন্যান্য বড়ো প্রাণী এবং মানুষ তাড়া করে। এর ফলে ভয় পেয়ে তারা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছোটাছুটি করে ।তাই বিড়াল রাস্তা পার হওয়ার সময় একটু দাঁড়িয়ে গেলে অন্য প্রাণী অথবা মানুষের সঙ্গে তাদের ধাক্কা লাগার সম্ভাবনা কমে যায় । দাঁড়িয়ে পড়ার প্রবণতার এও এক কারণ হয়তো । তাছাড়া জ্যোতিষশাস্ত্র অনুসারে , রাহুকে অশুভ গ্রহ মানা হয় । রাহুর প্রভাবে নাকি জীবনে দুর্ঘটনার যোগ আসতে পারে। বৈদিক জ্যোতিষ অনুসারে বিড়াল রাহুর বাহন। এই কারণে বিড়াল পথ কাটলে তা অশুভ মনে করা হয় । ধরে নেওয়া হয় যে , বিড়াল রাস্তা কেটেছে মানেই সেখানে রাহুর প্রভাব রয়েছে । আর কালো বিড়াল রাস্তা কাটলে তা নাকি আরও ভয়ঙ্কর । কালো বিড়ালের সঙ্গে শনিদেবের গায়ের রং মিলিয়ে যে ধারণা তৈরি হয়ে আছে যুগ যুগ ধরে , তা থেকে খুব কম মানুষই বেরোতে পেরেছেন । কালো বিড়ালকে সাক্ষাৎ বিপদ বলে ধরা হয় । এই বিড়াল রাস্তা পেরোলেই দুপাশের সব গাড়িঘোড়া ও মানুষ থেমে থাকে যতক্ষণ না কোনো গাড়ি বা মানুষের চলাচল শুরু হয় । অর্থাৎ যা কিছু অশুভ তা অন্য কোনো মানুষ বা গাড়ির ওপর দিয়ে যাক ! আপনি বাঁচলে বাপের নাম । কী অমানবিক ভাবনা , কী নৃশংস স্বার্থপরতা ! অন্য কারোর বিপদ হোক , আমি নিরাপদে থাকি !

গ্রিক মাইথোলজি অনুসারে , জিয়াস-এর স্ত্রী হেরা নাকি একবার তাঁর পরিচারক গ্যালিনথিয়াসকে কালো বিড়াল বানিয়ে দেন । এরপর গ্যালিনথিয়াস ডাইনি বিদ্যার দেবতা হেকেট – এর সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করে । তখন থেকেই সম্ভবত , নানা সংস্কৃতিতে কালো বিড়ালকে অশুভ বলে মনে করা হয় । অনেকেই আবার বিড়াল রাস্তা কাটলে সেই রাস্তা ত্যাগ করে ঘুরপথ বা অন্য পথের সন্ধান করেন । অনেকে থুথু ফেলে , হাতের মুদ্রায় বাতাসে কাটাকুটি করে বিপদ কেটে গেছে এমন আশ্বাস তৈরি করে তবেই আবার পথচলা শুরু করেন । মূলত অঘটন ও দুর্ঘটনা এড়াতেই এমন ধারণার উদ্ভব । তবে হ্যাঁ , সাদা রঙের বিড়ালকে কিন্তু বিপদ হিসেবে দেখা হয় না । বরং সাদা বিড়ালকে শুভ মানা হয় । বিড়াল নিয়ে আজও মানুষের মনে নানা কুসংস্কার । বিড়ালের কান্না নাকি অশুভ , বিপদ সঙ্কেত । আবার মাংসের টুকরো মুখে বিড়াল নাকি শুভফল দায়ক। কিন্তু দুই বিড়ালের মারামারি নাকি অশুভ । বাচ্চাসহ বিড়াল এবং সাদা বিড়াল নাকি বিরাট সৌভাগ্যের প্রতীক । পরিশেষে বিড়াল নিয়ে বিখ্যাত সেই ছড়া :
খিলখিল্লির মুল্লুকেতে
থাকতো নাকি দুই বেড়াল ,
একটা শুধোয় আরেকটাকে ,
‘ তুই বেড়াল , না মুই বেড়াল ? ‘

আরও পড়ুন- নিয়মরক্ষার ম্যাচে দুরন্ত জয় মোহনবাগানের, গোয়াকে হারাল ২-০ গোলে

_

 

_

 

_

 

_

 

_