
কিছুতেই ঘুম আসে না রাজার । কে পাড়াবে ঘুম ? কীভাবে ? চুলে বিলি কেটে ? গল্প শুনিয়ে ? গান গেয়ে ? কার জানা আছে ঘুম পাড়ানোর বিদ্যে ? নিদ্রাহীনের চোখে নিদ্রা এনে দেওয়া ! এ কি বড়ো সহজ কাজ ? রাজার চোখে ঘুম এনে দিতে পারলে অঢেল পুরস্কার । এ নিয়ে গল্পও আছে বিস্তর ।কিন্তু অনিদ্রা ব্যাধি কি শুধুই রাজার ? আট থেকে আশি ছেলে-বুড়ো সকলেই কি এই মারাত্মক রোগের শিকার নয় ?

অধ্যাপকের একমাত্র ছেলেটি কিশোর । তার চোখে এই অল্প বয়সেই ঘুম নেই । সুন্দর স্বাস্থ্য । তুখোড় মেধা । উজ্জ্বল একজোড়া চোখ । কিন্তু দিনে দিনে কেমন শুকিয়ে যাচ্ছে ছেলেটি । ঘুম নেই তার চোখে । দিনে রাতে তার ঘুম আসে না কিছুতেই । এ বড়ো সাংঘাতিক ব্যাধি । বহু ডাক্তার দেখিয়ে জেরবার অধ্যাপক নাচার হয়ে শরণাপন্ন হন তাঁর এক গায়ক বন্ধুর । শিল্পী আসেন ছেলেটির কাছে । দু’চার কথার পর হারমোনিয়াম টেনে নিয়ে বড়ো নরম করে মন্দ্র সপ্তকে গাইতে লাগলেন দরবারী আলাপ । বিছানায় শুয়ে ছেলেটি শুনছে সেই সুর। ও মা , কী আশ্চর্য ! সুরের ওঠানামার সঙ্গে ছেলেটির দু’চোখে কখন যেন নেমে আসে ঘুম । একসময় গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় সে ।

একটু নীরবতা । আজ অনেকদিন পর শান্তিতে ঘুমোচ্ছে ছেলে । গোটা বাড়ি জুড়ে নীরব উচ্ছাস । সবার মুখে হাসি , চোখে জল । উদ্বেগ উৎকণ্ঠার গুরুভার আজ সবার বুক থেকে নেমে গেছে যে ! গায়কের প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা অধ্যাপকের বাড়ির সকলের । তাহলে কি নিদ্রাহীনতা রোগের ওষুধ রাগ দরবারী ? কিছুটা সত্যি হলেও সবটা কিন্তু নয় । কারণ বয়স , শরীর ও মনের অবস্থা এবং পরিস্থিতি ও পরিপ্রেক্ষিত ভেদে একেকজনের ক্ষেত্রে একেকরকম দাওয়াই । এ নিয়ে গবেষণা চলছে হাজার বছর ধরে । সঙ্গীত মানুষের পরম বন্ধু , এ নিয়ে কোনো সংশয় নেই । যে কোনো মানসিক সঙ্কটে ও বিপর্যয়ে সঙ্গীত যেভাবে মানুষকে আশ্বস্ত করে তার তুলনা নেই।

মনভার নামিয়ে মুহূর্তে মন ভালো করে দিতে জুড়ি নেই সঙ্গীতের । বহুক্ষেত্রেই সঙ্গীত জীবনদায়ী ওষুধের মতো , একথা খুব মিথ্যে নয় । সঙ্গীত থেরাপি শারীরিক অসুস্থতা ও মানসিক ব্যাধির উপশমের জন্য প্রাচীন যুগ থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বাঁশি ও বীণার সুর গাউটের চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হতো , যা জয়েন্টের ব্যথা ও ফোলা কমিয়ে দিতো । বাইথনিয়ার প্রাচীন গ্রীক চিকিৎসক অ্যাসক্লেপিয়াডেস রোগীদের বিষন্ন অবস্থা থেকে বের করে আনার জন্য সঙ্গীত থেরাপি ব্যবহার করতেন । বিশ্বাস করতেন সঙ্গীতের রয়েছে অমিতশক্তি । মানুষের মধ্যে আবেগ জাগাতে , বিমর্ষ মানুষকে উজ্জীবিত করতে এর বিকল্প নেই , এমনকি যে কোনো প্রাণী এবং উদ্ভিদের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন গবেষণায় এর সদর্থক ফলাফলের প্রমাণ পাওয়া গেছে । সঙ্গীতের মাধ্যমে আনন্দ , দুঃখ , ব্যথা , যন্ত্রণা , শোক , বিষন্নতা , আবেগ , উত্তেজনা , উচ্ছাস , হতাশা ইত্যাদি যেমন প্রকাশ করা যায় , ঠিক তেমনি শারীরিক ও মানসিক ব্যাধির প্রকোপ প্রশমিতও করা যায় । খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম ও চতুর্থ শতাব্দী থেকে সঙ্গীত থেরাপি চলে আসছে এবং এটি উদ্ভূত হয়েছিল প্রাচীন গ্রীস দেশে ।


এখন তো সারা পৃথিবীর বহু দেশে মিউজিক থেরাপি নিয়ে গবেষণা চলছে শুধুমাত্র সহায়ক চিকিৎসা হিসেবে নয় , প্রচলিত ওষুধের বিকল্প হয়ে ওঠার ক্ষমতা সঙ্গীতের মধ্যে কতটা , তা নিয়ে । সঙ্গীত থেরাপি যদি বিভিন্ন রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষভাবে কার্যকরী ভূমিকা নিতে থাকে , তাহলে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে । প্লেটো , অ্যারিস্টটল , পিথাগোরাস প্রমুখ প্রসিদ্ধ ব্যক্তিবৃন্দ সঙ্গীত থেরাপি নিয়ে সারা পৃথিবীকে দিয়ে গেছেন নতুন ভাবনাচিন্তার খোরাক ।


বর্তমানে সঙ্গীত থেরাপি আধুনিক চিকিৎসার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার । রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ , শিথিল নার্ভকে চাঙ্গা করে তোলা থেকে শুরু করে স্মৃতিভ্রংশ রোগীদের স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে সঙ্গীত থেরাপি নাকি দারুণ কার্যকরী ভূমিকা নিচ্ছে ইদানিং ।

সেই কবে ( ৮০০ বি সি-ই ) কোমায় চলে যাওয়া রোগীদের জীবনে ফেরাতে সঙ্গীত থেরাপি ব্যবহার করেন তৎকালীন বিখ্যাত সুশ্রুত , চরক সংহিতাও এর উল্লেখ করে । এককালে যক্ষা রোগ নিরাময়ের জন্য ব্যবহৃত হতো সঙ্গীত । প্রাচীনকালে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ডাক্তারদের মতোই নিয়োগ করা হতো মিউজিশিয়ানদের।

সঙ্গীতপ্রেমী মানুষজনের অনেক স্বপ্ন রয়েছে মিউজিক থেরাপি নিয়ে । তাঁরা ভাবেন একদিন বিষন্নতার একমাত্র ওষুধ হবে রাগ বসন্ত । মালকোষ শুনতে শুনতে সেরে উঠবেন হাঁটুর ব্যথায় কাতর বৃদ্ধা মা । উত্থানশক্তিরহিত বৃদ্ধ মানুষ সন্ধ্যায় ইমন গাইতে গাইতে উঠে বসবেন বিছানায়। অকাল বিস্মরণ যে তরুণীর জীবন তছনছ করে দিয়ে গেছে , সেতারে রাগ বেহাগ শুনে একদিন সহসা তার মনে পড়ে যাবে হারানো সব কথা । দুরুহ পক্ষাঘাতগ্রস্ত এক মধ্যবয়স্ক মানুষ এক বর্ষামুখর বিকেলে মিঞা কি মলহার শুনতে শুনতে উঠে দাঁড়াচ্ছেন বিছানা ছেড়ে , কাঁধ সোজা করে , মাথা উঁচু করে হেঁটে চলে যাচ্ছেন বাড়ির বাগানের দিকে বহুকাল , যেন বহুজনমের পর । একদিন সারা পৃথিবী জুড়ে সমবেত প্রার্থনার মতো গাওয়া হবে সাগা রেমা গাপা মাধা পানি …

আরও পড়ুন – ভূমিকম্প বিধ্বস্ত মায়ানমারে লাশের স্তূপ, যুদ্ধবিরতির ঘোষণা জুন্টাবিরোধী সামরিক গোষ্ঠীর
_

_

_