আগুনের অকাল প্রস্থান, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

আগুন ঝাঁপ দিলো জলে …

লিখেছিলেন সম্ভবত শঙ্খ ঘোষ , এক ক্ষনজন্মা শিল্পীর অকাল মৃত্যুর পর। বিদুষী সেই অভিনেত্রী সত্যিই ঝাঁপ দিয়েছিলেন , নাকি মুহূর্তের অসতর্কতায় জলে পড়ে গিয়ে তলিয়ে গিয়েছিলেন অতল গঙ্গায় , সে রহস্যের কিনারা আজও হয় নি । বাংলা মায়ের এই হারিয়ে যাওয়া অগ্নিকন্যাকে নিয়ে প্রবীন নাট্যপ্রেমীদের দীর্ঘশ্বাস কান পাতলেই আজও শোনা যায় । ঠিক কী হয়েছিল সেদিন ? কেন ঘটেছিল ওই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ? কেন অকালে ঝরে গেলেন কেয়া চক্রবর্তী ?

দিনটা ছিল ১২ মার্চ , ১৯৭৭ , বাংলা রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসের মহা বিতর্কিত দিন । সাঁকরাইলে গঙ্গার ওপর শুটিং চলছিল একটি বাংলা সিনেমার । ছবির নাম ‘ জীবন যে রকম ‘ । ছবিতে কেয়ার চরিত্রটি ছিল এক অন্ধ মায়ের । দৃশ্যটি ছিল এইরকম : লঞ্চে করে মা ও ছেলে যেতে যেতে হঠাৎই জলে পড়ে যায় ছেলে । ছেলেকে বাঁচাতে মা’ও সঙ্গে সঙ্গেই ঝাঁপ দেন মাঝ গঙ্গায়।

এই দৃশ্যেরই শুটিং করতে গিয়ে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যান তুমুল প্রতিভাময়ী বছর পঁয়ত্রিশের কেয়া । তিন পয়সার পালা ও ভালোমানুষ নাটকে অসামান্য অভিনয়ের সুবাদে কেয়া যখন খ্যাতির শীর্ষে , ঠিক তখনই সহসা তাঁর জীবন রঙ্গমঞ্চ থেকে অকাল প্রস্থান নানা বিতর্কের জন্ম দিয়ে গেছে।

সেই সময় মাঝগঙ্গায় শুটিং করার অনুমতি ছিল ? ডামি ছাড়া অভিনেত্রী স্বয়ং কেন ঝাঁপ দিয়েছিলেন ভরা গঙ্গায় ? লাইফবোট কিংবা জাল শুটিং ইউনিটের সঙ্গে ছিল কি ? সাঁতার না জানা কেয়া এতোবড় ঝুঁকি নিলেন কেন ? তাঁকে কি জোর করা হয় , নাকি তিনি নিজেই চাপ দেন পরিচালককে ? এটা আত্মহত্যা নয় তো ? নাকি কেউ ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল কেয়াকে ? এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর আজ ৪৫ বছর কেটে গেছে । তবুও অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে বাংলা রঙ্গমঞ্চের অন্যতম সেরা এই অভিনেত্রীর মৃত্যু নিয়ে ।

কেয়ার ছিল তুখোড় মেধা , স্থির প্রত্যয় , দৃপ্ত ব্যক্তিত্ব । স্কটিশচার্চ কলেজের এই প্রতিভাময়ী ছাত্রী ইংরেজিতে এম এ পাশ করে ওই কলেজেই অধ্যাপনার সুযোগ পান । অভিনয় করতে খুব ভালবাসতেন কেয়া । আন্তঃ কলেজ নাট্য প্রতিযোগিতায় ১৯৫৮ , ১৯৫৯ এবং ১৯৬০ সালে টানা তিন বছর শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পান ।

আন্তঃ বিশ্ববিদ্যালয় যুব উৎসবে দিল্লি এবং মহীশূরে আমন্ত্রিত হন । এরপর যোগ দেন নান্দীকার থিয়েটার দলে। তাঁর প্রথম অভিনয় ১৯৬১ সালে চার অধ্যায় নাটকে । তিন পয়সার পালা নাটকে অসামান্য অভিনয়ের সুবাদে কেয়ার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে । এরপর উল্কার বেগে তাঁর উত্থান । ভালোমানুষ নাটকে একইসঙ্গে নারী ও পুরুষের দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করে সবাইকে চমকে দেন তিনি । আক্ষরিক অর্থেই বিদুষী কেয়া তাঁর নাটকের দলের ছেলেমেয়েদের শিখিয়ে গেছেন , ভালো মানুষ না হতে পারলে ভালো থিয়েটার করা অসম্ভব । ভালোমানুষ নাটকে কেয়ার গাওয়া অসাধারণ গান আজও মনে রেখেছেন বাংলার প্রবীণ নাট্যপ্রেমীরা, মেনে নিতে পারেন নি তাঁর হঠাৎ প্রস্থান ।

সাঁকরাইল থেকে পাঁচ মাইল দূরে হীরাপুরে ভেসে এসেছিল কেয়া চক্রবর্তীর কাদামাখা , কচুরিপানা জড়ানো নিথর দেহ । তাঁর মৃত্যুবর্ণনা দিতে গিয়ে কবিতা সিংহ লেখেন ,” কেয়ার দেহ পচতে আরম্ভ করেছে । অনেকক্ষণ জলে ছিল , এখন রোদে । আমি তার ঈষৎ নীলবর্ণ মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম । মুখের বাঁ পাশ সুন্দর । ডান পাশ ফুলে ঝুলে পড়েছে । সেখানে একটি গভীর দাগ । ”

২০ মার্চ যুগান্তর পত্রিকায় লেখা হয় , ” কেয়ার মৃতদেহে তিন চারটি ক্ষত দেখা যায় , তাঁর হাত দুটি ভাঙা । মুখে আঘাতের চিহ্ন ।” তাঁর হাত ভাঙলো কী করে ? গঙ্গার জলের তোড়ে ? স্টিমারের প্রপেলারের ঘায়ে ? না ধ্বস্তাধ্বস্তির চোটে ?  কেয়ার অকাল মৃত্যুতে ক্ষোভে ফেটে পড়েন উৎপল দত্ত । লেখেন , ” চলচ্চিত্রের কিছু ক্রিমিনালের গাফিলতিতে বাংলা নাটকের কত বড়ো ক্ষতি হয়ে গেল তাঁরা কি কোনোদিন বুঝবেন ? এ যেন নাট্যকর্মীদের বৃহত্তর আত্মহত্যার প্রতীক।”

আরও পড়ুন – বিজেপি রাজ্যেও ওয়াকফ বিরোধী আন্দোলনে কেন্দ্রীয় বাহিনী! ত্রিপুরায় আহত ৭ পুলিশকর্মী

_

 

_