রাজনৈতিক প্ররোচনায় পা নয়, বাংলার মানুষকে সতর্ক-শান্ত থাকার বার্তা মুখ্যমন্ত্রীর 

ওরা সংকীর্ণ নির্বাচনী রাজনীতির কথা ভেবে আমাদের মধ্যে ভাগাভাগি করতে চায়। আইন-শৃংখলার স্বার্থে এবং মানুষের প্রাণ ও সম্মান রাখার প্রয়োজনে আমরা কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছি।

শান্ত বাংলাকে অশান্ত করার পরিকল্পিত চিত্রনাট্য তৈরি করেছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার (BJP Government)। একদিকে রয়েছে ভারতীয় জনতা পার্টি ও আরএসএস, অন্যদিকে কেন্দ্রীয় এজেন্সি, কমিশন ও বিএসএফের (BSF) ত্রিমুখী চক্রান্ত।শনিবার বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) কাছে আরএসএসের এক ঘৃণ্য চক্রান্তমূল প্রচার ছড়িয়ে দেওয়ার খবর আসে। এরপরই চক্রান্তকারীদের প্ররোচনায় পা না দিয়ে রাজ্যবাসীকে সতর্ক এবং শান্ত থাকার আহ্বান বাংলার প্রশাসনিক প্রধানের। রবীন্দ্র-নজরুল-বিবেকানন্দের এই বাংলায় কিছুতেই অশান্তির চিত্রনাট্য সাজাতে দেবে না বাংলার সরকার (Govt of WB)। রাজ্যবাসীর উদ্দেশ্যে তাঁর বার্তা—

‘বিজেপি এবং তাঁদের সঙ্গীরা পশ্চিমবঙ্গে হঠাৎ খুব আক্রমণাত্মক হয়েছে। এই সঙ্গীদের মধ্যে আরএসএস-ও আছে। আমি আগে আরএসএস-এর নাম নিইনি, কিন্তু এবার বাধ্য হয়েই বলতে হচ্ছে যে, রাজ্যে যে কুশ্রী মিথ্যার প্রচার চলছে তার মূলে তারাও আছে। প্ররোচনার সূত্রে একটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতটিকে এরা ব্যবহার করছে। ব্যবহার করছে বিভেদের রাজনীতি করার জন্য। এরা ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’-এর খেলা খেলতে চায়। এ খেলা বিপজ্জনক। এইসবের প্রতিক্রিয়ায়, আমি একটি আবেদন করতে চাই। আমি জন্মেছি এবং বড় হয়েছি পশ্চিমবঙ্গে, বাংলা আমার মাতৃভূমি, দেশ আমার ইন্ডিয়া— ভারতবর্ষ। আমি আমার দেশকে ভালবাসি, আমার রাজ্যকে ভালবাসি, আমার তৃণমূলস্তরে আছে যে জেলা থেকে ব্লক থেকে গ্রাম— আমি তাঁদের সবকিছু নিয়ে ভালবাসি। এই ভালবাসা থেকেই আমার এই আবেদনপত্র।’

তৃণমূল কংগ্রেস প্রথম থেকেই বলে এসেছে, কেন্দ্রীয় সরকারের নয়া ওয়াকফ সংশোধনী আইনের প্রতিবাদে মুর্শিদাবাদে যে ঘটনা ঘটেছে তা কাজে লাগিয়ে মিথ্যে প্রচারে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা করছে বিজেপি। মুখ্যমন্ত্রীর আবেদন, ‘দয়া করে ধীর ও শান্ত থাকুন। আমরা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার নিন্দা করি এবং তাঁদের রুখবই। দাঙ্গার পিছনে আছে যে দুর্বৃত্তরা, তাঁদের কড়া হাতে দমন করা হচ্ছে। কিন্তু, সেই সঙ্গেই, পারস্পরিক অবিশ্বাসের বাতাবরণও আমাদের এড়িয়ে চলতে হবে। সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে পরস্পরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করতে হবে, পরস্পরের ব্যাপারে সহমর্মী ও যত্নশীল হতে হবে। আগুনের সঙ্গে খেলা করার জন্য ওরা প্রথমে রাম নবমী দিনটিকেই বেছে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে রাম নবমী উদযাপন হয় খুবই শান্তিপূর্ণভাবে। এরপর ওরা ওয়াকফ (সংশোধনী) আইনের বিরুদ্ধে সংঘটিত আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কিছু বিষয়কে ব্যবহার করতে চায়।’

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বরাবরই সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের বার্তা দিয়ে এসেছেন। শনিবারের খোলা চিঠিতেও তিনি লেখেন, ‘বিজেপি এবং তাদের সঙ্গীরা তথাকথিত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের নামে আমাদের বিশ্বজনীন হিন্দুধর্মের অপযশ করছে। শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের হিন্দুধর্ম হল একটি বিশ্বজনীন ধর্ম। এই বিশ্বজনীন ধর্ম আমাকে শেখায় সকলকে গ্রহণ করতে, ভালবাসতে। হিন্দুধর্ম থেকে ইসলাম, খ্রিস্টধর্ম থেকে বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম থেকে ইহুদিধর্ম সকল পন্থাকেই শ্রদ্ধা করতে শেখায় আমাদের এই বিশ্বজনীন ধর্ম। গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও আমাদের শেখান সকল মানুষের সকল ধর্মকে ভালবাসতে। এই ছিল আমাদের প্রাচীন তপোবনসমূহের হিন্দুধর্ম। উল্টোদিকে, বিজেপি ও তার সঙ্গীরা যা প্রচার করছে, তা মিথ্যা ও সংকীর্ণ। তাঁরা যা বলছে তা অসত্যের ঝুড়ি, অপব্যাখ্যায় ভর্তি। দয়া করে ওদের বিশ্বাস করবেন না। ওরা দাঙ্গা বাধাতে চায়। দাঙ্গায় সকলের ক্ষতি হয়। আমরা সবাইকে ভালবাসি। আমরা সকলে মিলেমিশে থাকতে চাই। আমরা দাঙ্গার নিন্দা করি, আমরা দাঙ্গার বিরুদ্ধে। ওরা সংকীর্ণ নির্বাচনী রাজনীতির কথা ভেবে আমাদের মধ্যে ভাগাভাগি করতে চায়। আইন-শৃংখলার স্বার্থে এবং মানুষের প্রাণ ও সম্মান রাখার প্রয়োজনে আমরা কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছি। পুলিশের দুজন অফিসার-ইন-চার্জকে সরানো হয়েছে। পুলিশ তদন্ত করছে। আরও পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। দয়া করে মনে রাখবেন, দাঙ্গা যারা ঘটায়, তারা হিন্দুও নয়, তারা মুসলমানও নয়— দাঙ্গা বাধায় দুর্বৃত্তরা। সব অপরাধীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কাউকে ছাড়া হবে না।’

দীর্ঘ বার্তায় মুখ্যমন্ত্রীর সংযোজন, ‘উত্তরপ্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান— এসব রাজ্যে তো প্রতিবাদ-মিছিল করতেই দেওয়া হয় না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে তো এমন সংবিধান-বিরোধী ব্যবস্থা কায়েম নেই। অন্যদিকে আছে মনিপুর— সেখানে বহু মাস ধরে আগুন জ্বলেই চলেছে, শত শত মানুষ নিহত হয়েছেন, হাজার হাজার মানুষ ঘরছাড়া। জাতিদাঙ্গার কোনও বিরাম দেখছি না সেখানে। অসম এবং ত্রিপুরাও গভীরভাবে অশান্ত। উত্তরপ্রদেশের মতো বড় রাজ্যে যখন ধর্ষণ, অত্যাচার ও মনুষ্যত্বের ক্রমাগত অবমাননা দেখি, তখন লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ এমন নৈরাজ্য-পরিস্থিতির থেকেও বিপরীত মেরুতে। দেশের সুশাসন ও উন্নয়ন মানচিত্রে আমরা অগ্রণীর স্থানে। বাস্তবিকই, বাংলা সব অর্থে দেশের অগ্রণী রাজ্য। ভারতে সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংস্কারসাধনে দেশের মধ্যে বাংলা ছিল প্রথম সারিতে এবং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামেও দেশে বাংলাই ছিল অগ্রগণ্য। এই অগ্রগণ্য ভূমিকা আজও আমাদেরই রয়েছে, সকল প্রয়াসে ও চর্চায়। বাংলা এগিয়ে সকল সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় চর্চায় বা উদযাপনে। দুর্গাপূজা হোক বা কালীপূজা, দোল হোক বা হোলি, গঙ্গাসাগর মেলা বা ভক্তির শোভাযাত্রা অথবা মনসা-শীতলার পূজা, ঈদ বা বড়দিনের উৎসব, বুদ্ধপূর্ণিমা বা মহাবীর জয়ন্তীর পালন— সব ব্যাপারেই আমরা এগিয়ে। গুরু নানক, পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মু ও ঠাকুর হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ইত্যাদি সকল সন্ত বা মনীষীর জন্মদিন আমরা উদযাপন করি সমান আন্তরিকতা ও উৎসাহে। সমস্ত সামাজিক উৎসব আমরা পালন করি, সকল ধর্মীয় আচারের প্রতি আমাদের সমান শ্রদ্ধা।

মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, উত্তরপ্রদেশে ওরা বুলডোজার চালায় জন্ম হয় যন্ত্রণার। বিপরীতে আমাদের দেখুন— যে-কেউ যখন উৎপীড়িত বোধ করেন, আমরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিই। পশ্চিমবঙ্গে এই হল আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি। কোনও সম্প্রদায় বা জনগোষ্ঠী পশ্চিমবঙ্গে বিব্রত বোধ করবেন না। সকলের কাছে আমাদের আবেদন, আমাদের বিশ্বাস করুন, আমাদের উপর আস্থা রাখুন। ন্যায় সাধিত হবেই। আপনারা আমাদের সকল সহায়তা পাবেন। যাঁরা দাঙ্গার জন্ম দেয়, তারা বাইরে থেকে আসে এবং দাঙ্গা বাধিয়ে পালায়। ভিতর থেকে আমাদেরই লড়তে হবে তাদের খারাপ কাজের বিরুদ্ধে। আমরা একত্রে বাঁচব, লড়ব এবং জিতব। বাইরে থেকে এসে যে লোকগুলি সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার জন্ম দেয় এবং সংকীর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দাঙ্গার জন্ম দেয়— তাঁদের বিশ্বাস করবেন না। ঈর্ষার কোনও ওষুধ নেই। হিংসুটে লোকেরা তাদের সংকীর্ণ দৃষ্টিপথের বাইরে যেতে পারে না। চাকরি, উন্নয়ন, সৃজনশীলতা, কিছুই ওই বিরোধীরা চায় না বা দিতে পারে না। ওদের একমাত্র উদ্দেশ্য মূল্যবৃদ্ধি, ওষুধের দাম বাড়ানো, হাসপাতালের খরচ এবং বিমার ব্যয় বাড়ানো, পেট্রল-ডিজেল-রান্নার গ্যাসের মূল্য বাড়িয়ে যাওয়া। জীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘোরানোই ওদের লক্ষ্য, তাই তারা বিভেদকামী প্রচারের আগুন জ্বালাতে চায়।

বাংলার সব মানুষের কাছে মুখ্যমন্ত্রীর আবেদন, ‘ধীর থাকুন, শান্ত থাকুন, ঐক্যবদ্ধ থাকুন। মিথ্যা সাম্প্রদায়িক প্রচারে বিপথগামী হবেন না। আসুন, আমরা মিলেমিশে একজোট হয়ে থাকি এবং ওদের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে লড়ি। ওদের গুন্ডামি ও মিথ্যার বিরুদ্ধে আমাদের লড়তে হবে। ভারতীয় হিসেবে আমাদের একত্র থাকতে হবে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথায়-

“অহরহ তব আহ্বান প্রচারিত, শুনি তব উদার বাণী,হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মুসলমান খৃস্টানী।পূরব পশ্চিম আসে তব সিংহাসন-পাশে,প্রেমহার হয় গাঁথা। জনগণ-ঐক্য-বিধায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!”