জয়িতা মৌলিক
ঠিক এক সপ্তাহে আগে মঙ্গলবার বাংলা নববর্ষের প্রথমদিন ১০দিনের কাশ্মীর ভ্রমণ সেরে কলকাতা ফিরি। আর তার ঠিক পরের মঙ্গলবার সন্ধে অফিসে বসে ব্রেকিং পহেলগামে জঙ্গি হামলা। আমার দেখে আসা ভূস্বর্গের ছবিটা ছিঁড়ে গেল মুহূর্তে। শান্ত ছিল, কিছুটা থমথমেও। কিন্তু রাত ১০টায় শ্রীনগরের (Shrinagar) রাস্তাতেও এতটুকু নিরাপত্তার অভাব বোধ হয়নি। উল্টে স্থানীয় মানুষ জানিয়েছেন কার অটোতে করে সঠিক জায়গায় পৌঁছনো যাবে। আর পায়ে পায়ে নিরাপত্তা রক্ষী। হাতে অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। তাহলে, ২২ এপ্রিল বৈশারন উপত্যকায় কোথাও ছিল তারা! একরাশ প্রশ্নের উত্তর হাতড়াচ্ছি। কারণ, আমার দেখা এক সপ্তাহ আগের উপত্যকার ছবি তো এটা নয়!

হিন্দু না ওরা মুসলিম, ওই জিজ্ঞাসে কোনজন…
কারা জিজ্ঞাসা করেছিল, তোমার ধর্ম কী? এই কদিন কাশ্মীরে (Kashmir) থাকার সময় সেখানকার একজনের মানুষের মুখে বা চোখে সেই প্রশ্ন শুনিনি। শুনিনি কোনও বিশেষ ধর্মের স্তুতি বা নিন্দা। তাহলে, মঙ্গলের কালবেলায় কারা এসে পর্যটকদের জিজ্ঞাসা করেছিল- তুমি হিন্দু না মুসলিম! পুলিশ বলছে, হামলাকারীরা ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্টে’র সদস্য। চার জঙ্গির নামও প্রকাশ করা হয়েছে- আদিল গুরু, আসিফ ফুজি, সুলেমান শাহ ও আবু তালহা। দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট নিষিদ্ধ জঙ্গি গোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈবার একটি শাখা। কমপক্ষে ৫-৬ জঙ্গি ছদ্মবেশে বৈশারন উপত্যকার চারপাশের ঘন পাইন বন থেকে এসে AK-47 দিয়ে গুলি চালায়। তার আগে নাকি জিজ্ঞাসা করা হয়েছে ধর্ম। পরিচয় যাচাইয়ে পুরুষদের প্যান্ট খোলানো হয়েছে। এতটা সময় পেল হামলাকারীরা। অথচ প্রতি পদে পদে থাকা নিরপত্তারক্ষীরা পৌঁছতে পারল না! বিস্ময় জাগছে, কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না- এ ছবি আমার সদ্য দেখে আসা পহেলগামের।


৩৭০ তুলে নেওয়ায় কাশ্মীরের (Kashmir) যুব সমাজ খুব একটা খুশি নয়। অন্তত আমি যতজনের সঙ্গে কথা বলেছি, সবারই একমত- এই আচ্ছা নেহি হুয়া। কিঁউ? উত্তর একটাই এখানে বাইরের লোক এলে আমরা কোণঠাসা হয়ে যাব। কাশ্মীরের ভূপ্রকৃতিকে কী ভালবেসে ব্যবসা করবে বাহারওয়ালে? প্রশ্ন ছিল, ক্ষোভ ছিল কিন্তু পর্যটকদের প্রতি ছিল অকুণ্ঠ সহযোগিতা ও আতিথেয়তা। কথায় কথায় একটাই বুলি, আপ মেহমান হো। আপ খুশ রহেঙ্গে তো হাম লোগ ভি খুশ রহঙ্গে। ঠিকই তো। পর্যটন শিল্পের উপর বেশিরভাগ নির্ভর যে রাজ্য সেখানে পর্যটকের ঢল নামলে স্থানীয়রা তো খুশি হবেনই।

এবার কাশ্মীরের শ্রীনগর হোক বা সোনমার্গ, গুলমার্গ- একবার বাপি বা মিতা বা মুনমুন, বাবাই বলে ডাকলে বোধহয় একশোজন উত্তর দেবেন। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, কোভিডের পর থেকে এইবার সবচেয়ে ভালো ব্যবসা হচ্ছে। আর পর্যটকদের মধ্যে বাঙালি রয়েছেন প্রায় ৭৫ শতাংশ। সেই কারণে কেন্দ্রীয় সরকারের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর ছেলের রিসর্টের মতো হোটেল নিয়ে মন খচখচ থাকলেও, আম কাশ্মীরিরা বাঙালি পর্যটকদের বেশ পছন্দ করেন। টিউলিপ গার্ডেনে এক কাশ্মীরি তরুণ এসে ঝরঝরে বাংলায় বললেন, দিদি শাড়িটা দারুণ। রিল করো। ভাল লাগবে। শুনে তো আমি ছিটকে গিয়েছি- ভাই বলে কী! বললাম, কলকাতায় যাও প্রতি বছর। বললেন, “আরে আমি বিভিন্ন জায়গায় (হ্যাঁ, বিভিন্নই বলেছেন শুদ্ধ বাংলায়) যাই। কৃষ্ণনগরে দোকান আছে!” সেই কাশ্মীরে নিশানায় পর্যটকরা?


টিউলিপ গার্ডেনে (Tulip Garden) ঢুকে মনে হয়েছিল, পৃথিবীর সব ফুল এক জায়গায় জড়ো হয়েছে। রঙের সমাহারে হারিয়ে যেতে যেতেও চোখে পড়েছিল আপাদমস্তক উর্দি পরা হাতে ইনসাস নেওয়া নিরাপত্তারক্ষীদের। কয়েক পা অন্তর দাঁড়িয়ে তাঁরা। অনেক অতুৎসাহী দিদি, বোন, বউদি, মাসি, পিসিরা তাঁদের সঙ্গে সেলফি-ছবি তুলছেন। তাঁরাও হাসিমুখে পোজ দিয়েছেন। অভিশপ্ত মঙ্গলের দুপুর তাহলে কেন পহেলগামে ছিলেন না আপনারা? কেন ঘটনাস্থলে আসতে আপনাদের ১ঘণ্টা সময় লাগল?

ফুরফুরে সকালে চলেছি সোনমার্গের পথে। পথে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ। গেটের দুধারে খান দশেক আগ্নেয়াস্ত্র-সহ নিরাপত্তা রক্ষী। শুধু তাই নয়, ছিল সাঁজোয়া গাড়িও। গুলমার্গের গন্ডোলা-তে (রোপওয়ে) চড়ার ব্যাপক ভিড় ছিল। অনলাইনের টিকিটের মধ্যেও চলে টাকা নিয়ে লাইন কেনাবেচা। কিন্তু নিরাপত্তার অভাব বোধ একবারও হয়নি। উল্টে টয়েলেটে যাওয়ার চরম প্রয়োজনে কাদাজলের পথের মধ্যে হাতটি শক্ত করে ধরে রেখেছিলেন এক কাশ্মীর প্রৌঢ় পারভেজ আহমেদ ভাট। সোনমার্গে বরফে বার দুয়েক আছাড় খাওয়ার সময়ও টেনে তুলেছিলেন ফোটোগ্রাফার দানিশ।

ডাল লেকে শিকারা চালক আদিলের সঙ্গে একফ্রেমে ছবি দেখে কলকাতার অনেকেই জানতে চেয়েছে, চালকটি কে? তিনি আদিল। হ্যান্ডসাম হাঙ্ককে আমরা জিজ্ঞাসা করেই ফেলেছিলাম, বিয়ে করেছেন? উত্তরে লাজুক হেসে আদিল জানান, সামনের বছর শাদি করবেন। এখন টাকা জমিয়ে বাড়ি করছেন। কতক্ষণ শিকারা চালান? যতক্ষণ ট্যুরিস্টরা টাকা দেয়। কোভিডের সময়ের ক্ষতি সরিয়ে এখন মুনাফা ঘরে তোলার দিন। নিজের বাড়ি করার দিন। নতুন বাড়িতে নতুন বেগমকে নিয়ে আসার দিন। সেই সুদিনের আলো কে নেভালো মূহর্মূহ বুলেটে! এই শব্দের পরে আর কি আদিলের শিকারায় সওয়ারির সেই ভিড় থাকবে?

কাশ্মীর শান্ত ছিল। কারণ রোজগার ছিল। মানুষের হাতে পরিশ্রমের অর্থ ছিল। কাজ ছিল। বৈশরন ভ্যালি, আরু ভ্যালি, বেতাব ভ্যালি, চন্দনওয়াড়ি-তে পনি অর্থাৎ টাট্টু চালানোর কাজ, ছবি তোলার কাজ, গাড়ি করে ঘুরে গাইডের কাজ, শাল, আখরোট, জাফরান, শিলাজিৎ বিক্রির কাজ। ব্যবসা ছিল, বিকিকিনি ছিল। কারা তারা যারা এই সবের উপর নজর দিয়ে প্রশ্ন তুলল, হিন্দু না ওরা মুসলিম?

পহেলগাম যাওয়ার পথে আমাদের গাড়ির চালক ইশফাক দেখিয়েছিলেন ৪৪ নং জাতীয় সড়কের উপরে পুলওয়ামা ব্লাস্টের জায়গায়। কিন্তু কোথাও কোনও ক্ষত রাখেনি কাশ্মীর। একেবারে স্বাভাবিক জীবন দেখে বোঝাই যাচ্ছিল না এখানে কীভাবে বিস্ফোরণ হতে পারে! এত জনবহুল এলাকায় চার দিকে জাফরান আর ড্রাই ফুডের সারি সারি দোকান, অসংখ্য গাড়ির যাতায়াত, মেশিনগান লাগানো সাঁজোয়া গাড়ি, অ্যান্টি মাইন গাড়ি-এত সবের মধ্যে বিস্ফোরক বোঝাই গাড়ি দেড়-দুদিন ধরে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, কেউ নজর করল না! এতটাই কী উদাসীন কাশ্মীর? তার খেসারৎই কি দিত হল সরকারি মতে ২৬টি বেসরকারি মতে ২৮টি প্রাণকে?
আরও খবর: পর্যটকদের কাশ্মীর ছাড়ার হিড়িক শুরু হতেই বিমান ভাড়া তিনগুণ! সরব ওমর

না কি গোয়েন্দাদের ব্যর্থতা? যারা সাধারণ রাস্তায় গাদা গাদা নিরাপত্তারক্ষী রাখে, সেই প্রশাসন কেন বৈশারন ভ্যালির মতো জনবহুল পর্যটনস্থলে নিরাপত্তারক্ষীদের রাখেনি? আর কে সেই জঙ্গি যারা ধর্ম জিজ্ঞাসা, পয়েন্টব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি চালাল? এই হামলার ব্লু প্রিন্ট কে, কোথায় সাজিয়েছিল? হামলার রকম দেখে আর সদ্য দেখা কাশ্মীরের স্মৃতি মনে করে শুধু একটাই প্রশ্ন মাথায় আসছে, জিজ্ঞাসে কোন জন!

–
