বিশ্ব বই দিবস উদ্যাপন মানেই শুধু বইয়ের গুরুত্ব নিয়ে কথা বলা নয়—বরং বইয়ের সঙ্গে এক নতুন করে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ। ঠিক সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ওমেন্স কলেজ ক্যালকাটা-র পিজি সাংবাদিকতা ও গণজ্ঞাপন বিভাগ আয়োজন করেছে এক ব্যতিক্রমী বই (Book) পড়ার মেলা, আলোচনা সভা এবং একদিনব্যাপী কর্মশালা।এই উৎসবের মূল ভাবনা—তরুণ প্রজন্মকে বইয়ের দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। যখন ‘within time’ অপেক্ষা ‘screen time’-এর প্রতি আসক্তি বেড়ে চলেছে, তখন বইয়ের সঙ্গে দূরত্বও ক্রমশই বাড়ছে। সেই দূরত্ব মেটানোর, সেই সম্পর্ককে আরও নিবিড় করার জন্যই এই মেলার পরিকল্পনা।

শুধু একটি দিনের অনুষ্ঠান নয়, এই মেলাই হতে পারে আগামী দিনে একটি ‘বই পড়ার মেলার’-এর সম্ভাব্য ভিত্তিপ্রস্তর।অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যিক অধ্যাপক সুবোধ সরকার (Subadh Sarkar)। বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন সাংবাদিক অভিজিৎ ঘোষ (Abhijit Ghosh) এবং শিক্ষক ও সাংবাদিক প্রীতিকণা পাল রায়। বই পড়ার অভ্যাসকে কেন্দ্র করে তাঁদের মূল্যবান অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গি তরুণদের ভাবনার জগতে নতুন আলো জ্বালাবে।


উদ্বোধনী সঙ্গীত এবং কাশ্মীরের এই নির্মম ঘটনার জন্য নীরবতা পালনের পর শুরু হয় অনুষ্ঠান। বিভিন্ন কলেজ ও বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীরা এই মেলায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করছে। বই পড়ার প্রতি উৎসাহ জাগানোর এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ সম্পর্কে উদ্যোক্তা অধ্যাপক বিশ্বজিৎ দাস বলেন, একজন ছাত্র বা ছাত্রীও যদি এই মেলায় অনুপ্রাণিত হয়ে নিয়মিত বই পড়ার অভ্যাস শুরু করে, তবেই এই মেলা সফল।” কলেজের অধ্যক্ষা ড. অনুপমা চৌধুরীর বিশ্বাস, “বইমুখী ভাবনার মধ্য দিয়েই গড়ে উঠবে শিক্ষার্থীদের একটি গভীর আত্মিক ভিত্তি।”এই মেলা তাই শুধুমাত্র একটি উৎসব নয়, বরং পাঠাভ্যাসের প্রতি এক নতুন ভালোবাসার জন্ম—যা ভবিষ্যতের প্রজন্মকে ভাবনার জগতে নিয়ে যাবে আরও গভীর, আরও মানবিক পথে।

সুবোধ সরকার বলেন, আজকের প্রযুক্তিনির্ভর জীবনে আমরা কীভাবে ধীরে ধীরে বই থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। আমরা যদি সত্যিই চাই, তাহলে আবারও ফিরে যেতে পারি বইয়ের খুব কাছাকাছি, ঠিক যেমন এক সময় ছিল আমাদের জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ। তিনি জানান, বর্তমান প্রজন্ম মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, সোশ্যাল মিডিয়ার রিলস ইত্যাদির দুনিয়ায় এমনভাবে জড়িয়ে পড়েছে যে বই পড়ার অভ্যাস ক্রমশ লুপ্তপ্রায় হয়ে উঠছে। অথচ বই-ই একমাত্র মাধ্যম, যা আমাদের কল্পনাশক্তিকে প্রসারিত করে এবং জীবনকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সাহায্য করে।


অভিজিৎ ঘোষ বলেন, আজকের দিনে একটি ফোন, কিংবা একটি পিডিএফ ফাইল আমাদের চাহিদা অনুযায়ী সব কিছু ঠিকঠাকভাবে পরিবেশন করে দিচ্ছে, কিন্তু তার বিনিময়ে আমরা হারাচ্ছি আমাদের অনুসন্ধান করার ক্ষমতা, কৌতূহল, ধৈর্য। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, আগে যখন আমরা কোনও নির্দিষ্ট বই খুঁজতাম, তখন লাইব্রেরির তাক ঘেঁটে খুঁজতে হতো। তখন সেই একটি বইয়ের খোঁজে আমরা আরও ৫-৬টি নতুন বইয়ের নামের সঙ্গে পরিচিত হতাম। অনেক সময় এমন হতো, যে বইটা খুঁজছিলাম তা হয়তো পাইনি, কিন্তু অন্য কোনও বই আমাদের চোখে পড়ে গিয়েছে, যেটা আমাদের দারুণভাবে নাড়া দিয়েছে। এই ভাবেই জ্ঞানের দুনিয়ার দরজা খুলত একটার পর একটা। একই অভিজ্ঞতা গান শোনার ক্ষেত্রেও হতো। আজ যখন আমরা একটি নির্দিষ্ট গান ইউটিউবে লিখে সার্চ করি বা পিডিএফ ডাউনলোড করি, তখন সেই একটাই জিনিস পাই—তার বাইরের জগৎ আর আমাদের সামনে খুলে যায় না। ফোন আমাদের যা দিতে চায়, শুধু সেটুকুই আমরা পাই। আমরা হয়ে উঠছি যন্ত্র দ্বারা চালিত—আমরা আর খুঁজি না, আমরা শুধু চেয়েই নিচ্ছি।

প্রীতিকনা পাল রায় বলেন, আমরা প্রায়ই সোশ্যাল মিডিয়া—ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম বা হোয়াটসঅ্যাপের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে এমন কাউকে খুঁজে বেড়াই, যে আমাদের ভালবাসবে, আমাদের অনুভব করবে, আমাদের মন বোঝার চেষ্টা করবে। আমরা খুঁজি এমন এক বন্ধুকে, যে নিঃশব্দে আমাদের কষ্ট বুঝে পাশে দাঁড়াবে, নিঃস্বার্থভাবে আগলে রাখবে আমাদের। কিন্তু অনেক সময়ই এই খোঁজ অপূর্ণ থেকে যায়, কারণ ভার্চুয়াল জগতে ভালবাসা অনেক সময়ই ক্ষণস্থায়ী, বন্ধুত্বের গভীরতা হারিয়ে যায় স্ক্রলের ভিড়ে। এই অপূর্ণতার মাঝে, এই খোঁজের মধ্যে আমরা প্রায় ভুলে যাই—এই রকমই একজন ‘চিরন্তন বন্ধু’ আমাদের অনেক আগেই অপেক্ষা করে আছে বইয়ের পাতায়। যে বই আমরা খুলি না, যে চরিত্রগুলোর দিকে আমরা তাকাই না, সেখানেই লুকিয়ে আছে আমাদের মনের ঠিক সেই বন্ধুটি।

অধ্যাপক বিশ্বজিৎ দাস অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় তুলে ধরেন বইয়ের প্রয়োজনীয়তা এবং প্রাসঙ্গিকতা। তাঁর মতে, এই যন্ত্রনির্ভর সময়ে মানুষ যখন ধীরে ধীরে আবেগহীন ও যান্ত্রিক হয়ে উঠছে, তখন বই-ই হতে পারে আমাদের বাঁচার পথ, শেখার মাধ্যম, ভালবাসার পাঠশালা। বলেন, “বই আমাদের ভালোবাসতে শেখায়—নিজেকে, অন্যকে, মানবতাকে। কিন্তু আজকের ‘ফেক বুক’-এর দুনিয়ায় ভালোবাসা আর বন্ধুত্ব কেবল এক ক্লিকের ইমোজিতে সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। এটা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হল বইয়ের দিকে ফিরে যাওয়া।

আরও পড়ুন – রোহিত-বোল্টের ধাক্কায় ঘরের মাঠে বেসমাল সানরাইজার্স হায়দরাবাদ

_

_

_

_