এখানে বাজে না আলোর বেণু, ‘ভুবন’ মেতে ওঠে না পুজোর গন্ধে। আশ্বিনের শারদপ্রাতে শরতের নীল আকাশে অরুণ আলোর অঞ্জলি ছড়িয়ে পড়ে না। বালিয়া পরগনার ১২ গ্রামে কোনও আঁচই পড়ে না শারদীয়া দুর্গোৎসবের (Durga Puja)। গোটা বঙ্গে এমন ব্যতিক্রমী চিত্র আর কোথাও মেলা ভার। শরতে সারা বাংলা যখন থিমভাবনা, মণ্ডপ-সজ্জার আতিশয্যে দুর্গোৎসবে মাতোয়ারা, তখন বালিয়া পরগনার বাসিন্দারা পুজোর সব আনন্দ জলাঞ্জলি দিয়ে কাটান আর পাঁচটা সাধারণ দিনের মতোই নিরুত্তাপ, নিরুদ্বেগে।
হাওড়ার (Howrah) জগৎবল্লভপুরের বালিয়া। বালিয়া পরগনার অন্তর্গত ১২ গ্রামে দেবী দুর্গার আবাহন নিষিদ্ধ। দশভূজা নন, ১২ বালিয়ায় প্রায় ৬০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই রীতি চলে আসছে। আজও তার অন্যথা হয়নি। এমনকী অন্য কোনও এলাকার দশভুজার প্রতিমা নিয়ে শোভাযাত্রাও করা যায় না এখানে। কিন্তু কেন এই বৈপরীত্য? কী এর কারণ? সে কাহিনি বড়ই বিচিত্র। বালিয়া পরগনার প্রধান উৎসব বৈশাখের সীতানবমী তিথিতে দেবী সিংহবাহিনীর মহাপূজাকে ঘিরে। এই পুজোকে কেন্দ্র করে বিরাট অন্নকুট মহোৎসবের আয়োজন হয় ১২ বালিয়ায়। তা ভিন্ন অন্য উৎসবের রেওয়াজ নেই বালিয়ার গ্রামে।
মোট ১২টি গ্রাম নিয়ে বালিয়া পরগনা। এই বালিয়াযুক্ত কোনও গ্রামেই দুর্গাপুজো (Durga Puja) হয় না। এলাকার প্রবীণরা বলেন, নিজবালিয়া, যমুনাবালিয়া, বাদেবালিয়া, গড়বালিয়া, নিমাবালিয়া, বালিয়া-ইছাপুর, বালিয়া-রামপুর, বালিয়া-প্রতাপপুর, বালিয়া-পাইকপাড়া প্রভৃতি গ্রামে দুর্গাপুজোয় নিষেধাজ্ঞা দেবী সিংহবাহিনীরই। সেই রীতি ভাঙার সাহস কারও নেই। কথিত আছে, পঞ্চদশ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমানের রাজা দেবীর স্বপ্নাদেশে জগৎবল্লভপুরের নিজবালিয়া গ্রামে নির্মাণ করে সুবিশাল মন্দির। সেখানেই সিংহবাহিনী দেবীর মুর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়। দেবীর নিত্যভোগ ও সেবার জন্য ৩৬৫ বিঘা জমিও দান করেন মহারাজা। তারপরই এলাকায় বসতি স্থাপন হয় ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের। সেই থেকে সিংহবাহিনীই বালিয়া পরগনার একমাত্র আরাধ্যা। দেবী সিংহবাহিনী নিমকাঠ দিয়ে নির্মিত। তাই গ্রামে পোড়ানো হয় না নিমকাঠও। জনশ্রুতি রয়েছে, স্বয়ং দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা বন্ধ মন্দিরকক্ষে দেবীর স্বপ্নাদেশ মতো নিমকাঠ খোদাই করে মূর্তি তৈরি করেন। শ্বেত সিংহের পিঠে দাঁড়ানো সিংহবাহিনী কাঞ্চণবর্ণা ও সালঙ্কারা। তাঁর সাত হাত অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। আর এক হাতে তিনি বরাভয়া। তবে মূর্তি গড়ে, আতিশয্যের মণ্ডপসজ্জায় মহিষাসুরমর্দিনীর পুজো না হলেও, দুর্গাপুজো ক’দিন সিংহবাহিনীকেই দুর্গারূপে আরাধনা করা হয়।
–
–
–
–
–
–
–
