Monday, December 8, 2025

হৃদয়ে ট্রামের ধাক্কা’, উৎপল সিনহার কলম

Date:

Share post:

উৎপল সিনহা

… জীবনের এই স্বাদ —
সুপক্ক যবের ঘ্রাণ হেমন্তের বিকেলের —
তোমার অসহ্য বোধ হলো ;
মর্গে কি হৃদয় জুড়োলো
মর্গে — গুমোটে
থ্যাঁতা ইঁদুরের মতো
রক্তমাখা ঠোঁটে ।

গত একশো বছরে ট্রাম দুর্ঘটনায় কলকাতায় মৃত্যুর সংখ্যা মাত্র একটি। সেই দুর্ঘটনার ফলে যাঁর মৃত্যু হয়, তিনিই কবি জীবনানন্দ দাশ।
ট্রাম বড়ই মন্থর গতিতে চলে।
তাই ট্রামে চাপা পড়ে কেউ মারা যেতে পারে ভাবাই যায় না। যদিও ট্রামে চাপা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই কবি মারা যান নি। মারাত্মক আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। মারা যান কয়েকদিন পরে।

উল্লেখ করতে হয় , ২০১৬ সালের ৯ নভেম্বর ইংল্যান্ডের ক্রয়ডনে একটি ট্রাম লাইনচ্যুত হয়ে ৭ জন যাত্রী নিহত হন। ১৯২৬ সালের ৭ জুন স্পেনের বার্সেলোনায় একটি ট্রাম দুর্ঘটনায় বিখ্যাত স্থপতি আন্তোনি গাউদি মারা যান।
জীবনানন্দের মৃত্যুটা কি আত্মহত্যা ?’ চিত্ররূপময় ‘ , ‘নির্জনতম কবি ‘ , রূপসী বাংলার পাগল প্রেমিক মৃত্যুর কয়েক বছর আগে থেকেই ভীষণ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। ঘরে-বাইরের প্রবল চাপে তাঁর মানসিক অস্থিরতা সীমা ছাড়িয়েছিল।

১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর কলকাতায় বালিগঞ্জে ট্রামের ধাক্কায় আহত হন জীবনানন্দ দাশ। ট্রামের ক্যাচারে দলিত হয়ে যায় তাঁর শরীর । শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে তাঁকে দেখতে গিয়ে ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় জানিয়ে দেন যে কবির বাঁচার আর আশা নেই , যতদিন থাকেন একটু শান্তিতে যেন তাঁকে রাখা হয়।

শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে তখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন কবি। লড়াই ?

মৃত্যুর সঙ্গে কবেই বা লড়াই করতে চেয়েছেন তিনি?
গভীর হতাশা কবিকে কি আত্মহত্যাপ্রবণ করে তোলে নি?
জীবনানন্দের মৃত্যু আজও রহস্যের চাদরে ঢাকা। তাঁর মৃত্যু নিয়ে বিতর্ক সহজে শেষ হবার নয়। একটা ভয়ঙ্কর’ ডিপ্রেশন ‘ তাঁকে কুরে কুরে খেতো , এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
যেদিন সরিয়া যাব
তোমাদের কাছ থেকে
দূর কুয়াশায় চলে যাবো
সেদিন মরণ এসে অন্ধকারে
আমার শরীর ভিক্ষা করে
লয়ে যাবে…
রূপসী বাংলার কবিতায় এসব লিখেছেন তিনি।
লিখেছেন:

ঘুমায়ে পড়িব আমি একদিন
তোমাদের নক্ষত্রের রাতে…
আরও লিখেছেন:
যদি আমি ঝরে যাই একদিন
কার্তিকের নীল কুয়াশায়…
কেন লিখেছেন?
ট্রাম লাইনের পথ ধরে একা
হাঁটতেন তিনি। ভালো লাগতো তাঁর। নিজেকে ব্যর্থ কবি ভাবতেন। কারুবাসনা তাঁকে নষ্ট করে দিয়েছে ভাবতেন। তাঁর জীবনের সাফল্য, তাঁর সামাজিক সম্মান সব কেড়ে নিয়ে তাঁকে নিঃস্ব করেছে কারুবাসনা ,এমনই ভাবতেন কবি।

গভীর এক অবসাদ, ভয়াবহ এক বিমর্ষতা গ্রাস করেছিল কবিকে।‌
” কারুকর্মীর এই জন্মগত অভিশাপ , আমার সমস্ত সামাজিক সফলতা নষ্ট করে দিয়েছে। ”
তাই কি তিনি একা একা হাঁটতেন ট্রামলাইন ধরে ?
মুক্তির উপায় খুঁজে বেড়াতেন একা একা?
” ট্রামের লাইনের পথ ধরে হাঁটি ; এখন গভীর রাত
কবেকার কোন্ সে জীবন
যেন টিটকারি দিয়ে যায় … ”
আয়ু ফুরোবার আগে মরে যাওয়ার কথা লিখেছেন
‘ শ্রুতি স্মৃতি ‘ কবিতায় , যদিও তা ভালবাসার আকাশের আকাঙ্খায়।
‘ ঘাস ‘ কবিতার শুরুতেই লিখছেন,
” মরণ তাহার দেহ কোঁচকায়ে
ফেলে গেল নদীটির পারে। ”
এক প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে জানা যায় জীবনানন্দ যখন ট্রামলাইন পার হচ্ছিলেন তাঁর হাতে ছিল ডাব।
ডাব হাতে কোনো মানুষ আত্মহত্যা করতে পারেন কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে , কিন্তু যখন জানা যায় ট্রাম দুর্ঘটনায় কলকাতায় মৃত্যুর সংখ্যা একশো বছরে মাত্র একটি, তখন তো আত্মহত্যার কথা উঠতেই পারে।

জীবদ্দশায় কবি স্বীকৃতি পান নি , একথা সবাই জানেন। জীবনের প্রতি একধরনের বিতৃষ্ণা, স্থায়ী বিষন্নতা, জাগতিক নিঃসহায়তা এবং আত্মহননের স্পৃহাই হয়তো তাঁকে চলন্ত ট্রামের মুখে ঠেলে এনেছিল !

তাঁর সব ধরনের লেখাতেই মৃত্যুবোধ যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। তাঁর স্ত্রী লাবণ্য দাশ লিখেছেন, ” মৃত্যুর পরপার সম্পর্কে ওঁর একটা অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল। মাঝেমাঝেই ওই কথা বলতেন। বলতেন, মৃত্যুর পর অনেক প্রিয়জনের সঙ্গে দেখা হয়। আর খালি বলতেন, আচ্ছা বলতো আমি মারা গেলে তুমি কী করবে? ”

অকাল হেমন্তে দূর তমসায় পাড়ি দেওয়ার কয়েকদিন আগে হাসপাতালে একটা কমলালেবু খেতে চেয়েছিলেন কবি। তিনি নিজেই মুমূর্ষু রোগীর পাশে কমলালেবু হয়ে থাকতে চেয়েছিলেন তাঁর কবিতায়। এই হেমন্ত ঋতুতে জীবনানন্দ ল্যান্সডাউন রোড ধরে একা একা হেঁটে বেড়াতেন। দুর্ঘটনার সময় রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের কাছে ‘ জলখাবার ‘,’ জুয়েল হাউস ‘ – এর সামনে অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তা পার হচ্ছিলেন গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন কবি।  চলন্ত ডাউন বালিগঞ্জ ট্রাম তখনও পঁচিশ ত্রিশ হাত দূরে। অবিরাম ঘন্টা বাজানো ছাড়াও সতর্কবাণী ঘোষণা করে বারবার সাবধান করছিলেন ড্রাইভার। এরপর অনিবার্যভাবে ট্রাম এসে পড়ে মানুষটির সামনে।

ব্রেক কষে গাড়িও থামান ড্রাইভার। কিন্তু ততক্ষণে কবির দেহ আটকে গেছে ক্যাচারের ভেতরে। ভয়াবহ আঘাতে রক্তাপ্লুত, অচৈতন্য কবির শরীর। পাঁজরের এবং উরুর হাড় গুঁড়িয়ে গেছে। কেটে – ছড়ে – থেঁতলে গেছে দেহের বিভিন্ন অংশ । চোখের কোণে তীব্র আঘাতে আর্ত কবি। তাঁকে টেনে হিঁচড়ে বের করলেন পথচারীদের কয়েকজন এবং কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর কবিকে নিয়ে একটা ট্যাক্সি ছুটলো শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালের দিকে। মর্ত্যের বন্দর ছেড়ে একটি অমর জাহাজ চলে গেল শান্তি-পারাবারের উদ্দেশে।

আরও পড়ুন – স্বামীর নামে ভুল! SIR ফর্ম হাতে পেয়েও অশান্তি, আত্মঘাতী মহিলা

spot_img

Related articles

শুরু ২৫তম নাট্যমেলা, উদ্বোধনে মন্ত্রী ইন্দ্রনীল – অরূপ – ব্রাত্য

রবিবার সন্ধ্যায় কলকাতার রবীন্দ্রসদনে পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির উদ্যোগে শুরু হলো ২৫তম নাট্যমেলা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের তিন...

প্রয়াত চলচ্চিত্রের যুগান্তরের সাক্ষী কল্যাণ চট্টোপাধ্যায়, শোকের ছায়া টলিউডে

প্রয়াত বাংলা চলচ্চিত্রের বর্ষীয়ান অভিনেতা কল্যাণ চট্টোপাধ্যায়। দীর্ঘদিন ধরে একাধিক রোগে আক্রান্ত ছিলেন তিনি। রবিবার রাতে হাসপাতালেই প্রয়াত...

জৌলুসহীন সুপার কাপের ফাইনাল, ভারতীয় ফুটবলের ভবিষ্যৎ নিয়েও দিশাহীন কল্যাণ

রবিবার গোয়াতে সুপার কাপের (Super Cup) ফাইনাল ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল ইস্টবেঙ্গল ও এফসি গোয়া।  সুপার কাপ (Super Cup)...

ট্রফি জয়ের স্বপ্নভঙ্গ ইস্টবেঙ্গলের, সুপার কাপ চ্যাম্পিয়ন এফসি গোয়া

সুপার কাপে(Super Cup) চ্যাম্পিয়ন এফসি গোয়া(FC Goa)। ফাইনালে ইস্টবেঙ্গেলর (East bengal)  বিরুদ্ধে নাটকীয়ভাবে টাইব্রেকারে ৬-৫ ফলে জয়ী গোয়া।...