“বিচারব্যবস্থা দুর্নীতিগ্রস্থদেরই রক্ষাকবচে পরিণত হয়েছে”।

বিস্ফোরক এই উক্তি যদি সাধারন কোনও মানুষ করতেন, এটা নিশ্চিত আদালত অবমাননার মামলায় জেলে যেতেন তিনি। কোন প্রেক্ষিতে এই কথা বলা হয়েছে, তা কেউ ভেবেও দেখতো না।

কিন্তু এই বাক্যটি এবং এর থেকেও ‘ভয়ঙ্কর’ কিছু মন্তব্য যদি কোনও হাইকোর্টের কর্মরত বিচারপতি করেন ? তখনও কি আমজনতা বুঝবে যে দেশের বিচারব্যবস্থা আদৌ সন্দেহের উর্ধ্বে নয় ? আদালত সম্পর্কে সাধারন মানুষের চিন্তাধারাও কি এমনই ? এ প্রশ্নও উঠেছে দেশজুড়ে।

রাকেশ কুমার। পাটনা হাইকোর্টের বিচারপতি। এই বিচারপতি রাকেশ কুমারের এক রায়ে দেশের বিচার ব্যবস্থা তোলপাড়। রায়ের ভাষা এবং অর্থ, সত্যি না মিথ্যা, কেন বিচারপতি রাকেশ কুমার এক মামলার রায়ে এভাবে বিস্ফোরন ঘটালেন, তা কেউ দেখার চেষ্টা না করেই এই রায় বাতিল করলেন 11 জন বিচারপতি’র বিশেষ বেঞ্চ।

এক মামলায় পাটনা হাইকোর্টের বিচারপতি রাকেশ কুমারের 20 পাতার একটি রায়কে কেন্দ্র করে বেনজির কাণ্ড দেশজুড়ে। বিষয়টি আরও গুরুত্ব পায় যখন বেনজিরভাবে পরদিনই সেই রায় খারিজ করে দেয় পাটনা হাইকোর্টের 11 বিচারপতির বেঞ্চ। বিচারপতি রাকেশ কুমারের এই রায় একদিকে যেমন হইচই ফেলে দিয়েছে দেশের আইন মহলে, অন্যদিকে তুলে দিয়েছে বহু প্রাচীন কিন্তু প্রাসঙ্গিক একাধিক প্রশ্ন। যে প্রশ্নমালার প্রথমেই রয়েছে, ‘দেশের বিচারবিভাগ কি দুর্নীতির আঁতুড়ঘর?’

কি এমন ঘটনা ? গত 28 আগস্ট। 5 কোটি টাকার এক দুর্নীতি মামলায় বিহারের প্রাক্তন আমলা কে পি রামাইয়াকে নিম্ন আদালতের জামিন দেওয়া নিয়ে একটি সুয়ো মোটো মামলা শুনছিলেন পাটনা হাইকোর্টের বিচারপতি রাকেশ কুমার। সুপ্রিম কোর্ট এবং হাইকোর্টে তাঁর আগাম জামিনের আর্জি খারিজ হওয়ার পর অভিযুক্ত সেই অবসরপ্রাপ্ত আমলা দুম করে নিম্ন আদালত থেকে জামিন পেয়ে যান। আর এখানেই প্রশ্ন তোলেন বিচারপতি কুমার। শুধু প্রশ্ন তোলাই নয়, দেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে এই প্রথমবার এমন সব বিস্ফোরক কথা 20 পাতার দীর্ঘ রায়ে তিনি লিখে দেন।
রায়ে বিচারপতি রাকেশ কুমার বলেছেন, “জামিন দেওয়া কিংবা খারিজ করা আদালতের এক্তিয়ার। কিন্তু যেভাবে এই মামলায় জামিন দেওয়া হয়েছে, তা বিচারব্যবস্থাকে গুরুতর প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। তাই এই আদালত জানতে চায়, জামিন কি আইনের ভিত্তিতে দেওয়া হয়েছে, নাকি বাইরের কোনও প্রভাবে? আমার মতে এই ঘটনার তদন্ত হওয়া উচিত। তদন্ত করুন পাটনার জেলা জজ”।
রায়ে স্পষ্টভাষায় তিনি বলেছেন, “সংবাদপত্রে বেরিয়েছে, নিয়মিত বেঞ্চ সেই সময় ছুটিতে ছিল। এটা কি সত্যি? যদি নিয়মিত বেঞ্চের বদলে ভেকেশনাল বেঞ্চ জামিন মঞ্জুর করে, তাহলে সেই বিচারকের শেষ 6 মাসের কাজকর্ম খতিয়ে দেখা হোক। স্পেশাল বেঞ্চের বিচারক আচমকা এই সময় ছুটিতে গেলেন কেন? বিশেষ কোনও কারণেই কি ওই সময় তিনি ছুটিতে ছিলেন?”
রায়ের এই অংশে বিচারপতি কুমার বিচারব্যবস্থায় দুর্নীতির বেশ কয়েকটি অভিযোগের উল্লেখ করেন।

দীর্ঘ 20 পাতার রায়ে বিচারপতি রাকেশ কুমার লিখেছেন, “সাধারণত আমি এই ধরনের রায় দিই না। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে এই পাটনা হাইকোর্টে সব কিছু ঠিকঠাক চলছে না। 2009 সালের 25 ডিসেম্বর ন্যায় দেওয়ার শপথ নিয়েছিলাম আমি। তাই এই মামলায় যদি আমি দুর্নীতি বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করতে না পারি, তাহলে তা নিজের জন্যও অন্যায় করা হবে। কীভাবে দেশের বিচারব্যবস্থা দুর্নীতিগ্রস্থদের রক্ষাকবচে পরিণত হয়েছে, উদাহরণ দিয়ে সে সব কথাও লেখেন বিচারপতি কুমার। ওই আমলার জামিন পাওয়ার বিষয়টির CBI-স্তরে তদন্তের নির্দেশ দিয়ে বিচাপতি কুমার রায়ের কপি পাঠিয়ে দেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি, সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়াম, পিএমও, আইন মন্ত্রক এবং CBIয়ের ডিরেক্টরকে।
এই রায় ঘোষনার পরই শোরগোল পড়ে যায়। পাটনা হাইকোর্টের সব থেকে সিনিয়র বিচারপতির এই রায়ের প্রেক্ষিতে ফৌজি তৎপরতায় বৈঠকে বসেন পাটনা হাইকোর্টের বিচারপতিরা। 11 জন বিচারপতির বেঞ্চ, বিচারপতি রাকেশ কুমারের ঘোষনা করা এই রায় ‘সাসপেন্ড’ করে। এটুকুই শেষ নয়,
এই ভাষায় রায় ঘোষনার ‘অপরাধে’ বিচারপতি কুমারের হাত থেকে কেড়ে নেওয়া হয় সমস্ত মামলা।
ওদিকে চুপ করে বসে থাকেন না বিচারপতি কুমারও। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে গত 1 সেপ্টেম্বর দেখা করেন বিচারপতি রাকেশ কুমার এবং পাটনা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি এ পি শাহি। নিজের বক্তব্য তুলে ধরেন বিচারপতি কুমার। প্রবল চাপে বিচারপতি কুমারকে সব মামলা ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
পাটনা হাইকোর্টের এই রায় সারা দেশে সাড়া ফেলে দেয়। বিচারপতি কুমার, তার রায়ে কেন এসব কথা লিখলেন? পাটনা হাইকোর্টের সিনিয়র-মোস্ট বিচারপতি রাকেশ কুমারের পরিচিতি নিজের সততা এবং ডাকাবুকো মনোভাবের জন্য। পশুখাদ্য কেলেঙ্কারিতে CBI-এর আইনজীবী হিসেবে তিনি যেভাবে সওয়াল করেছিলেন, তা মানুষ দেখেছেন এবং শুনেছেন। পাটনা হাইকোর্টের বিচারপতি রাকেশ কুমার এবার আঙুল তুললেন বিচার ব্যবস্থার সততা নিয়েই। ওই রায় পরে বাতিল হলেও বিচারপতির এই বিস্ফোরক রায়ে নড়েচড়ে বসেছে গোটা দেশ।
