Friday, November 14, 2025

Must watch: “আমি, তনু ও সে “, ছকভাঙা নাটকের মধ্যে নাটক, কুণাল ঘোষের কলম

Date:

Share post:

নাট্যকারের হাত ধরে এগোচ্ছে নাটক। অভিনেতা অভিনেত্রীরা চলছেন মাপা অঙ্কে। এর মধ্যেই হঠাৎ বিদ্রোহ এক অভিনেতার। ছক ভেঙে চলবে সে। ঝড় উঠছে চিত্রনাট্যে। বাকি অভিনেতারা বেসামাল। বিদ্রোহী অভিনেতা চ্যালেঞ্জ করছে নাট্যকারকে, অপমান করছে। নাট্যকার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন ওই অভিনেতার মৃত্যুসংবাদ শুনিয়ে নাটক থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হবে তাকে। চিৎকার করে লোক ডেকে বিদ্রোহীকে বার করে দিচ্ছেন তিনি। মঞ্চের কর্মীদের উদ্দেশে চিৎকার করে বলছেন,” আলো নেভাও। পর্দা ফেলো এখনই।” আলো নিভছে। পর্দা পড়ছে। আর টানতে টানতে বার করে নিয়ে যাওয়ার সময় বিদ্রোহীর হুঙ্কার কাঁপিয়ে দিচ্ছে প্রেক্ষাগৃহ :” আমি আসব। এভাবে আমাকে মুছে ফেলা যাবে না। আমি আবার ফিরে আসব।”
এখানেই প্রথমার্ধ শেষ। বিরতি।

শুধু এই দৃশ্যটি দেখার জন্যেই দশবার দেখা যায় নতুন নাটক- কথাকৃতির ‘আমি, তনু ও সে।’
গিরীশ মঞ্চে শনিবার দেখলাম প্রথম প্রদর্শন।
বিস্তারিত আলোচনায় ঢোকার আগেই সরাসরি বলছি, ওদের পরের অভিনয় 10 মার্চ অ্যাকাডেমিতে, সন্ধে সাড়ে ছটায়। দেখে আসুন। নতুন অভিজ্ঞতা নিশ্চিত।

নাটকে ‘আমি’ নাট্যকার। ‘তনু’ এক ঝলমলে তরুণী, যে জীবনে নাটকীয়তা চায় বটে, তবে তা যেন স্থিতিশীল আশ্রয়ের ছাদটিতে বিঘ্ন না ঘটায়।
সমস্যাটা ‘সে’।
এই ভূমিকায় আসলে কে?
সাধারণ মোড়কের ইঞ্জিনিয়ার অরির সঙ্গে তনুর প্রেম।
কিন্তু জঙ্গলমহলে খামারবাড়ি করে অন্যরকম জীবনে থাকা কল্লোলকে বিয়ে করে তনু, আপাত রোমাঞ্চের প্রভাবে।
কিন্তু সংঘাত প্রবল। কল্লোল জঙ্গলমহলের যে গরিব মানুষগুলোর পক্ষে সরব; তনুর কাছে তারা অসহ্য। তনু ফিরে আসে অরির কাছে।

নাট্যকার নাটকের নিয়ম মেনে অরির সঙ্গে তনুর বিয়ে দিয়ে কালিম্পঙে মধুচন্দ্রিমায় পাঠিয়ে দেন। ততক্ষণে এই উপসংহার না মেনে কল্লোল বিদ্রোহ করেছে। নাট্যকার তাকে নাটক থেকে বার করে দিয়েছেন। দর্শক জেনেছে জঙ্গলমহলে কল্লোলের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। আর অভিনেতা নাট্যকারকে শাসিয়ে গেছে, “এভাবে আমাকে বাদ দেওয়া যাবে না। আমি ফিরব। ”
এদিকে নিজের তৈরি চরিত্র ‘তনু’কে ভালো লেগে যাচ্ছে নাট্যকারের নিজেরও।
তাহলে কোন্ ‘সে’ কে হৃদমাঝারে রাখবে তনু?

এর পরের অংশের জন্য নাটকটা নিজের চোখে দেখাই ভালো।

এই নাটক শুধু সম্পর্কের টানাপোড়েনেই থেমে নেই; সেই টানাপোড়েনের কারণ খুঁজতে সমকালীন সমাজকে কাটাছেঁড়া করে বিশ্লেষণ করেছে অনায়াস। বৈষম্য, উন্নয়ন, রাষ্ট্র, প্রতিবাদ, কন্ঠরোধ, ধর্মের নামে রাজনীতি, প্রতিটি বিষয় এসেছে। জঙ্গলমহলের অনাহার থেকে শহরে উড়ালপুল ভেঙে পড়া, কিছুই বাদ যায় নি।

অথচ এই বিষয়গুলো কখনও থান ইঁটের মত ভারি মনে হয় নি, যা দর্শককে ক্লান্ত করে দিতে পারে। কারণ, চরিত্রগুলোর সঙ্গে মিশে গেছে ঘটনাক্রম। আমরা দেখি, বুঝি, আপত্তি করি না, নিজেরা ঝামেলায় জড়াই না। নাটক আমাদের চাবুক মেরেছে।

তনুও প্রতিবাদ চায়, কিন্তু ঝুঁকি চায় না। কল্লোল প্রতিবাদ চায়, সবরকম ঝুঁকি নিয়েই। নাট্যকার তাঁর নাটক নিয়ে যেন বিভ্রান্ত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিরীহ অরির চরিত্রে বৈচিত্র এনে তিনি বুঝেছেন এবং বুঝিয়েছেন : কোনো অভিনেতাকে বাদ দেওয়া গেলেও চরিত্র মুছে ফেলা যায় না। ব্যক্তি আসবে যাবে। চিন্তা থেকে যাবে। প্রভাব বাড়াবে।

এখানে তো দুই নাট্যকার।
একজন, যিনি সত্যিই লিখেছেন।
আরেকজন, যিনি মঞ্চে নাট্যকারের ভূমিকায়।

সৌনাভ বসু, আপনি দারুণ লিখেছেন এই নাটক। বড় কঠিন বিষয়কে নিয়ে অনায়াসে খেলা করেছেন। নাটকের মধ্যের নাটককে বারবার মোচড় দিয়েছেন।
আর আপনার তৈরি করা নাট্যকারের ভূমিকায় ততটাই দক্ষ, সাবলীল গম্ভীরা। এই তরুণ অভিনেতা সূত্রধরের মত টেনে গেলেন গোটা নাটক। নিজেকে ভাঙচুর করলেন অবলীলায়।
তনুর ভূমিকায় অসাধারণ অমৃতা। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের কঠিন মুহূর্তগুলি অনায়াসে তুলে ধরলেন আপনি। প্রাণোচ্ছ্বল প্রেমিকা থেকে স্বপ্নভঙ্গে বিধ্বস্ত স্ত্রী; প্রতিটি ভাঙাগড়াকে এমন মসৃণ উপস্থাপন বড় কম কথা নয়। সোহাগ থেকে সংঘাত, যে দক্ষতায় আপনি মঞ্চে ফুটিয়ে তুলেছেন, তা আগামীর লম্বা ইনিংসের স্পষ্ট ইঙ্গিত।

এবং কল্লোলের ভূমিকায় শ্রীমান কিঞ্জল। দেখতে নায়কোচিত। অভিনয়ে দাপুটে। গোটা মঞ্চে যেন ভেসে বেড়ালেন। কল্লোলকে যেভাবে দর্শকের সামনে রাখলেন কিঞ্জল, অনেক নামজাদা নায়ককে টেক্কা দেওয়ার মত এই পারফরমেন্স। পেশায় ডাক্তার, নেশায় অভিনেতা কে বলবে! অভিনয়কে পেশা করে পুরো সময় দিলে তো অনেক দোকান বন্ধের সম্ভাবনা থাকছে।

এবং কিঞ্জল এই নাটকের নির্দেশকও বটে। নাটকের মধ্যে নাটক, চরিত্রের মধ্যে চরিত্র, বৈপরীত্যের সংঘাত, বিদ্রোহী অভিনেতার বিদায়ের পরেও অশরীরী প্রত্যাবর্তন- মঞ্চে তুলে ধরা সহজসরল বিষয় না। সামান্য এদিকওদিক হলে নাটকের তাল কাটত। কিঞ্জল সেটা হতে দেন নি। মেদহীন স্মার্ট প্রোডাকশন নামিয়েছেন। এই নাটক 1977 সালের পরিবর্তনের সাক্ষীদের ভাবাবে ; আবার আজকের প্রজন্মকেও চিন্তার খোরাক যোগাবে।
মঞ্চ, আলো, শব্দ, যন্ত্রসঙ্গীত- সবই যথাযথ। প্রতিটি শাখাই মূল বিষয়বস্তুকে যোগ্য সঙ্গত দিয়েছে। সংগীতে ময়ূখ-মৈনাক। আলো দীপংকর দে।

নাটকের শুরুতেও চমক।
সাধারণত হলের দরজা খোলার পর দর্শকরা ঢোকেন। নির্ধারিত সময়ে পর্দা উঠে নাটক শুরু হয়। এই নাটকে অন্য শুরুর চমক। হলের দরজা খুলল। দর্শক ঢুকতে ঢুকতে দেখলেন পর্দা খোলা। পরিচালক, নাট্যকার, অভিনেতা অভিনেত্রীরা চারজন গুছিয়ে গল্প করছেন এই নাটক নিয়েই। সেটাও শোনার মতই। তারপর নির্ধারিত সময়ে মসৃণভাবে তার মধ্যে থেকেই সূত্রধরের ভূমিকায় শুরু করে দিলেন মঞ্চের নাট্যকার।

বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক হরনাথ চক্রবর্তীও প্রথম প্রদর্শনের দর্শকাসনে। বিরতিতে হরদাও বললেন,” নতুনরকম। অন্যরকম।”

প্রিয় পাঠকপাঠিকা, আপনি যদি নাটক বা অভিনয়ের অনুরাগী হন, একবার দেখে আসুন নতুনদের এই নতুন উদ্যোগ। আবার মনে করিয়ে দিই, 10/3/20 অ্যাকাডেমিতে সন্ধে সাড়ে ছটায় ওদের পরের প্রদর্শন। মিস্ করবেন না।

কয়েকটি ছবি দিলাম। এগুলি তুলেছেন অভিজিৎ দাশগুপ্ত।

কিঞ্জল এবং তাঁর সহশিল্পীদের অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।
‘ আমি, তনু ও সে’ এগিয়ে চলুক। ‘আমরা’ দেখি এবং বাংলা নাটকের দর্শকদের বলি,’ আসুন, আপনিও দেখুন।’

spot_img

Related articles

আইপিএলে দলবদল! নিজামের ডেরা থেকে নবাবের শহরে শামি?

ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা টেস্টের মধ্যেই চর্চায় আইপিএল(IPL)। শনিবারই রিটেন করা ক্রিকেটারদের তালিকা প্রকাশ করবে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলি। তবে শনিবার বিকেলে চমকের...

মমতার পথে হেঁটেই নীতীশের জয়! কী বলছে রাজনৈতিক মহল

বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) পথ ধরেই বিহারে নীতীশ কুমারের (Nitish Kumar) সাফল্য। বাংলায় লক্ষ্মীর ভাণ্ডারকে নকল...

কটকে শ্রেয়ার অনুষ্ঠানে ভিড়ের চাপে হুলুস্থুল, জ্ঞান হারালেন একাধিক শ্রোতা

ওড়িশার কটকে (Cuttack, Odissa) অনুষ্ঠান করতে গিয়ে অস্বস্তি সঙ্গীতশিল্পী শ্রেয়া ঘোষাল (Shreya Ghoshal)। হুলুস্থুল বেঁধে গিয়েছিল কনসার্টে। শ্রোতারাও...

৯৮ বছরে প্রয়াত বিশিষ্ট অভিনেত্রী ও ধর্মেন্দ্রর প্রথম নায়িকা কামিনী কৌশল

প্রয়াত বলিউডের জনপ্রিয় অভিনেত্রী কামিনী কৌশল( Kamini Kaushal)। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৯৮। বর্ষীয়ান এই অভিনেত্রী বহুদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত...