ক্রমশ সর্বজনগ্রাহ্য অশোক ভট্টাচার্য! দেখে শিখুক কলকাতার বামেরা বলছে উত্তরবঙ্গ

কিশোর সাহা

বামেদের দুর্দিনের বাজারেও একাধিক প্রতিদ্বন্দ্বী দলকে সঙ্গে নিয়ে কীভাবে কার্যসিদ্ধি করা যায় তা যেন আরও একবার দেখিয়ে দিলেন সত্তরোর্ধ্ব এক রাজনীতিক। যাঁর নাম অশোক ভট্টাচার্য। বৃহস্পতিবার সব বামপন্থী দলের প্রতিনিধি তো বটেই, কংগ্রেসের জেলা ও শহরের নেতাদের সঙ্গে নিয়ে সিপিএম বিধায়ক অশোকবাবু শিলিগুড়ির হিলকার্ট রোডে মিছিল করে এলাকার জনজীবন প্রায় স্তব্ধ করে দিলেন। সেখানে ইনটাক নেতা অলোক চক্রবর্তী, নকশাল নেতা অভিজিৎ মজুমদার সহ ১১টি বাম ও ডান পন্থী সংগঠনের নেতা-প্রতিনিধিরা কাঁধ মিলিয়ে হাঁটলেন। যার ফলে, উত্তরবঙ্গের অলিখিত রাজধানী প্রায় অচল হয়ে থাকল সারাদিনই। যদিও কিছু শপিং মল খুলেছে। কিন্তু, তাতে লোকসমাগম হয়নি। কয়েকটি চা বাগান খুললেও তাতে শ্রমিকের উপস্থিতির হার স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম।

যা দেখেশুনে রাজনৈতিক মহলের অনেকেই বলে দিলেন, টিভি শোয়ে বড় বড় বুলি না আউড়ে, প্রতিপক্ষকে কুকথা না বলে, সকলকে সঙ্গে নিয়ে নিজেদের পায়ের তলার মাটি শক্ত রাখা যায় তা অশোকবাবুকে দেখে শিখতে পারেন কলকাতার বাম নেতারাও। শুধু তাই নয়, মাসকানেক আগে করোনায় আক্রান্ত হয়ে বিপজ্জনক অবস্থায় চলে যাওয়ার পরেও লড়াই করে ফিরে আশা পোড় খাওয়া নেতার অদম্য মনোবল দেখে উদ্দীপিত নবীন প্রজন্মও।

এখানেই শেষ নয়, শিলিগুড়ি তথা দার্জিলিং পাহাড় ও সমতলের তৃণমূল ও বিজেপির নেতাদের একাংশও একান্তে মানেন, তৃণমূলের প্রবল হাওয়ার মধ্যেও যেভাবে কংগ্রেস, নকশাল ও নানা বামপন্থী দলকে এক সূতোয় বেঁধে রাখার যে দক্ষতা অশোকবাবুর রয়েছে তা সত্যিই শিক্ষণীয়। তৃণমূলের একাধিক নেতা মানছেন, তাঁরা এলাকায় এখনও অশোকবাবুর বিকল্প হিসেবে কাউকে সেভাবে তুলে ধরতে পারেননি। বিজেপির জেলা স্তরের এক নেতাও স্বীকার করেছেন, তাঁদের ঝুলিতেও অশোকবাবুর সমকক্ষ কেউ এখনও কাউকে পাওয়া যায়নি। আরএসপি, ফরওয়ার্ড ব্লক সহ নানা বামপন্থী দলের একাংশও জানিয়েছেন, তাঁদের কখনও অমর্যাদা করেননি অশোকবাবু।
তাই দেশ জুড়ে বামপন্থী ও কংগ্রেসিদের ডাকা ধর্মঘটের দিন শিলিগুড়িতে অনেক দিন পরে দেখা গেল জনজীবন প্রায় বিপর্যস্ত। শহরের রাস্তায় যান চলাচল হয়েছে অন্যান্য দিনের তুলনায় বড়জোর ১০ শতাংশ। দোকানপাট, হাটবাজার প্রায় সবই বন্ধ। তরাইয়ের চা বাগানের অধিকাংশে কাজ হয়নি বলে জানিয়েছেন ইনটাক নেতা অলোক চক্রবর্তী। শিলিগুড়ির তৃণমূল নেতারাও ধর্মঘটের বিরোধিতায় পথে নেমেছেন। তা নিয়ে কোনও আকচাআকচি, গোলমালের রাস্তায় কেউই হাঁটেননি। ফলে, পুলিশ রাস্তায় আর পাঁচটা দিনের চেয়ে যথারীতি বেশি থাকলেও তাঁদের তেমন কোনও ঝুটঝামেলা সামলাত দিতে গিয়ে নাস্তানাবুদ হতে হয়নি।
ধর্মঘটের ফলে যে সামগ্রিকভাবে উৎপাদন ও পরিষেবায় বিঘ্ন ঘটে তা মানছেন অশোকবাবুরাও। কিন্তু, তৃণমূল জমানায় বিজেপির উত্থানের প্রাণপন চেষ্টার বিরুদ্ধে সিপিএম-কংগ্রেস ও অন্যান্য বামপন্থী দলের জোটশক্তি প্রদর্শনের জন্য ধর্মঘটের দিনটিকে বেছে নিয়েছেন শিলিগুড়ি পুর কর্পোরেশনের পুর প্রশাসক অশোকবাবু।

সব মিলিয়ে যত বয়স বাড়ছে, অশোকবাবুর সবাইকে নিয়ে চলার ক্ষমতা যেন বেড়েই চলেছে বলে অনেকের ধারনা। খোদ অশোকবাবুও এদিন ধর্মঘট প্রসঙ্গে নিজের কিংবা সিপিএমের ঝুলিতে ক্রেডিট ভরতে চাননি। তিনি বলেছেন, যে ধর্মঘট হয়েছে তা সবার চেষ্টার ফসল এবং এটা কারও একার কৃতিত্ব নয়। তিনি আগাগোড়া বিজেপিকে দূষেছেন। তৃণমূলের সমালোচনা করেছেন তা বক্তব্যের একেবারেই শেষে মাত্র একটি সংক্ষিপ্ত বাক্যে। যা কি না তৃণমূলের অনেকের কাছেও স্বস্তির ব্যাপার!

৭১ বছর বয়সেও অশোককবাবু রাজনীতির ময়দানের সিংহভাগ কীভাবে সবাইকে নিয়ে দখল করে রাখায় যায় তা আরও একবার দেখিয়ে দিয়েছেন। তবে সিপিএমের উত্তরবঙ্গের নেতাদের অনেকের একটাই আফশোস, তা হল, দুর্দিনের বাজারে অশোকবাবু যেভাবে শিলিগুড়িতে ঘাঁটি আগলে রেখেছেন তাতে তাঁকে দলের নেতৃত্ব কেন্দ্রীয় কমিটি দূরের কথা, রাজ্য সিপিএমের কোনও নীতি নির্ধারক কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে আজও রাখা হয়নি।

আরও পড়ুন : দু-বছর ইপিএফ-র টাকা দেবে কেন্দ্র: কারা পাবেন সেই সুবিধা?