আলাদা উত্তরবঙ্গের দাবি তুলে উত্তরবঙ্গের বিধায়করা সরব হলেও তাঁদের বিরুদ্ধে দলীয় পর্যায়ে কোনও পদক্ষেপের কোনও প্রশ্ন নেই। বরং, তাঁরা উত্তরবঙ্গের “বঞ্চিত ও অবহেলিত” মানুষের কথা বলছেন বলে পাশে দাঁড়াবে রাজ্য বিজেপি। সদ্যসমাপ্ত বিধানসভা ভোটের পরে তিনদিনের উত্তরবঙ্গ সফরে লাগাতার দলীয় বৈঠকে এমনই বার্তা দিয়েছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। তবে এটাও জানিয়ে দিয়েছেন, আলাদা উত্তরবঙ্গের দাবিদারদের প্রতি সহানুভূতি দেখালেও রাজ্য “বিজেপি বাংলা ভাগের বিপক্ষে” বলে প্রতিটি সমর্থনসূচক বক্তব্যের পরে এক লাইন করে বিবৃতি দেওয়া হবে।

বিজেপির অন্দরের খবর, এখনই আলাদা রাজ্যের দাবি নিয়ে উত্তরবঙ্গের বিধায়কদের সম্মিলিত আন্দোলনের কথা ঘোষণা করতে নিষেধ করেছেন রাজ্য নেতৃত্ব। বরং, শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সেই লোকশিক্ষার গল্প শুনিয়ে বিজেপির রাজ্য নেতারা পরামর্শ দিয়েছেন, আগেই ছোবল না মেরে ফোঁস করে যেতে হবে। তার পরে জনমত প্রবল হলে রাজ্য বিজেপি নেতারা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে কথাবার্তা বলে পরের পদক্ষেপ ঠিক করে দেবেন।

তৃণমূল, বাম এবং কংগ্রেসের উত্তরবঙ্গের প্রথম সারির অনেক নেতাই বিজেপির রাজ্য় নেতাদের রণকৌশল সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। প্রবীণ বামনেতাদের একাংশের মতে, উত্তরবঙ্গে গত লোকসভা ভোটে বিজেপি আটটির মধ্যে সাতটি আসন জিতেছে। তার মধ্যে রায়গঞ্জের দেবশ্রী চৌধুরী ছাড়া কেউ মন্ত্রী হননি। দেবশ্রী চৌধুরীকে প্রতিমন্ত্রী হলেও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রক দেওয়া হয়নি। উপরন্তু, সদ্যসমাপ্ত বিধানসভা ভোটে উত্তরবঙ্গের ৫৪টি আসনের মধ্যে ৩০টি আসন বিজেপি পেয়েছে। কিন্তু, তৃণমূল ক্ষমতাসীন হওয়ায় আগামী ৫ বছর বিধায়কদের সেই অর্থে এলাকার উন্নয়ন করানোর কোনও রাস্তা নেই। তাই বিজেপির বিধায়কদের একাংশ তৃণমূলে চলে যাওয়ার পক্ষপাতি বলে তৃণমূলেরই কয়েকজন দাবি করেছেন। আলাদা রাজ্যের দাবিকে সামনে রেখে বিজেপি তাই একঢিলে দুই পাখি মারতে চাইছে।

প্রথমত, আলাদা রাজ্যের দাবি তুললে বিজেপির উত্তরবঙ্গের বিধায়করা একটা নতুন স্বপ্নে মেতে উঠতে পারবেন। দ্বিতীয়ত, উত্তরবঙ্গবাসীর কাছেও বিধায়কদের উন্নয়নের প্রশ্নে কোনও জবাবদিহি না করে স্রেফ আলাদা রাজ্যের দাবিতে আন্দোলনের কথা বলেই সময় কাটিয়ে দেওয়া যাবে। দল সূত্রের খবর, উত্তরবঙ্গের বিধায়কদের পর্যায়ক্রমে সোশ্যাল মিডিয়ায় আমজনতার মনের কথা হিসেবে কায়দা করে আলাদা উত্তরবঙ্গের দাবির কথা তুলে জনমত গঠন করার চেষ্টা করার পরামর্শ দিয়েছেন রাজ্য নেতৃত্ব। সেই মতো একেকদিন একেকজন বিধায়ক উত্তরবঙ্গের বঞ্চনা নিয়ে সরব হতে শুরুও করে দিয়েছেন ফেসবুক, ট্যুইটার, ইনস্টাগ্রাম সহ নানা সামাজিক মাধ্যমে।

বাম ও কংগ্রেস নেতাদের কয়েকজন জানান, অতীতে উত্তরাখণ্ড আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়েছে। বিস্তর আগুন জ্বালিয়ে, শয়ে-শয়ে দিন হরতাল করে পাহাড়ে অধা স্বশাসনের মবেশি কিছু মেলেনি। তা হলে আলাদা উত্তরবঙ্গ কি রাতারাতি হয়ে যেতে পারে! প্রবীণ বাম নেতারা জানান, দু-এক মাসের মধ্যেই বিজেপির আলাদা উত্তরবঙ্গ নিয়ে দ্বিচারিতার মুখোশ খুলে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা।

উত্তরবঙ্গের কংগ্রেসের প্রবীণ নেতাদের অনেকেই মনে করেন, ফারাক্কা সেতু পেরিয়ে মালদহে ঢোকার পর থেকে আলাদা রাজ্যের দাবি যুক্তি যুক্ত বলা হবে আর শিয়ালদহ কিংবা দমদমে পৌঁছলেই বাংলা ভাগ কোনমতে সম্ভব নয় বলা হবে, এই কায়দায় বিজেপি বেশি দিন রাজ্যের তৃমমূলকে চাপে রাখতে পারবে না। উল্টে, আলাদা রাজ্যের দাবির পক্ষে সওয়াল-জবাবের ফলে উত্তরবঙ্গে নানা অশান্তি দানা বেঁধে উঠতে পারে। সেই অশান্তির মামলায় জড়িয়ে যেতে পারে শয়ে-শয়ে আপাত নিরীহদের নামও।

বিজেপি নেতারাও সব জানেন ও বোঝেন। তাঁরাও আলাদা উত্তরবঙ্গ রাজ্যের দাবি নিয়ে রাজ্যের শাসক দলকে চাপে ফেলার রাস্তা থেকে যে সরবেন না সেটাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন। শনিবার থেকে সোমবার, বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ।

কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার ও দার্জিলিং জেলার বাছাই নেতা-কর্মীদের সঙ্গে অন্তত ৯টি বৈঠক করেছেন। তার বাইরে সমাজের নানা স্তরের শতাধিক প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলেছেন দিলীপবাবু। প্রতি জেলায় নিয়ম করে সাংবাদিক বৈঠক করেছেন। এমনকী, সোমবারও দিলীপবাবু শিলিগুড়িতে দলের সদর অফিসে বসে আলাদা উত্তরবঙ্গের দাবিতে তাঁর দলের স্থানীয় বিধায়করা কেন সরব হচ্ছেন তা যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি তথা সাংসদ দিলীপবাবু। তিনি দাবি করেন, উত্তরবঙ্গের মানুষকে ধারাবাহিকভাবে কংগ্রেস, বামেরা ও তৃণমূল বঞ্চনা করেছে বলেই তাঁদের মনে ক্ষোভ-দুঃখ-হতাশা তৈরি হয়েছে। তাঁদের সেই বঞ্চনার সুরে সুর মিলিয়েই বিজেপির উত্তরবঙ্গের বিধায়করা সরব হচ্ছেন বলে দিলীপবাবুর দাবি।

ঘটনা হল, গত তিনদিন ধরে উত্তরবঙ্গের প্রতিটি সাংবাদিক বৈঠকে আলাদা উত্তরবঙ্গের দাবির পক্ষে একই যুক্তি পেশ করেছেন দিলীপবাবু। প্রতিবারই বক্তব্যের লেজুড় হিসেবে জুড়ে দিয়েছেন, “কিন্তু, বিজেপির রাজ্য নেতৃত্ব কখনও বাংলা ভাগ চায় না বলে তিনি আবারও দাবি করেন।

ইতিহাস বলে, দুমুখো নীতির পরিনাম কোনদিন কারও পক্ষে ভাল হয়নি। এ ক্ষেত্রে কী হয় সেটা সময়ই বলবে।
