Monday, August 25, 2025

Narayan Debnath: নারায়ণ দেবনাথ : একটি প্রতিষ্ঠান, একটি যুগ, সাহিত্যে বেনজির

Date:

Share post:

চলে গেলেন নারায়ণ দেবনাথ। পেছনে রেখে গেলেন অন্য এক ইতিহাস। যা সম্ভবত কোনওদিন কেউ স্পর্শ করতে পারবেন না। গত ২৫ দিন ধরে বেলভিউ হাসপাতালে ভর্তি থাকার পর মঙ্গলবার সকালেই হঠাৎ শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। আজ সকাল ১০.১৫ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর।

আরও পড়ুন:Corona Update:স্বস্তি দিয়ে খানিকটা কমল দেশের দৈনিক সংক্রমণ, মৃত্যুও নিম্নমুখী

নারায়ণ দেবনাথ নামেই ফিরে ফিরে আসে শৈশব, আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে নস্টালজিয়া।’বাঁটুল দি গ্রেট’, ‘নন্টে ফন্টে’-এর মতো জনপ্রিয় কার্টুনের স্রষ্টা নারায়ণ দেবনাথের সঙ্গে জনি হার্টের ‘বিসি’ (৪৯ বছর; ১৯৫৮-২০০৭) এবং হ্যাঙ্ক কেচামের ‘ডেনিস দ্য মেনেস’ (৪৩ বছর; ১৯৫১-১৯৯৪) নাম ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। একক লেখক -শিল্পী হিসেবে বিশ্বের সবচেয়ে বেশিদিন ধরে একটানা চলা কমিক স্ট্রিপ লিখে গেছেন তাঁরা। কিন্তু যদি বলি, রেকর্ডটির মালিক আসলে আমাদের বাংলা ভাষারই একটি জনপ্রিয় কমিক স্ট্রিপ, ‘হাঁদা ভোঁদা’?

হ্যাঁ, শুনতে অবাক লাগলেও, সম্ভবত নারায়ণ দেবনাথের সৃষ্ট এই বিখ্যাত কমিক স্ট্রিপটিই উপর্যুক্ত রেকর্ডের প্রকৃত দাবিদার। কেননা ২০১৭ সালে ৯২ বছর বয়সে নারায়ণবাবু ‘হাঁদা ভোদা’র কাজ থামিয়ে দিলেও, এর আগে টানা ৫৫ বছর এটি লিখে ও এঁকে গেছেন তিনি।

সেই যে ১৯৬২ সালে শিশুদের মাসিক পত্রিকা ‘শুকতারা’য় ‘হাঁদা ভোদা’ বের করা শুরু করেছিলেন, এরপর থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তিনি উপর্যুপরি নতুন নতুন পর্ব তিনি উপহার দিয়ে গেছেন অন্তত তিনটি পৃথক প্রজন্মের অগণিত ভক্তকে।

একটু আগে বললাম যে ‘বিসি’ ও ‘ডেনিস দ্য মেনেস’-এর কথা, তাদের সাথে ‘হাঁদা ভোঁদা’র পার্থক্য হলো, জনি হার্ট ও হ্যাঙ্ক কেচামের বিদায়ের পরও অন্য শিল্পীরা টেনে নিয়ে গেছেন সেগুলো। কিন্তু ঠিক হার্জের ‘টিনটিন’-এর মতোই, নারায়ণ দেবনাথ কাজে ইস্তফা দিয়েছেন দায়িত্ব অন্য কারো কাঁধে সঁপে না দিয়েই।

আর ‘হাঁদা ভোঁদা’, তাও কিন্তু নারায়ণ দেবনাথের সৃষ্ট নয়। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, , ১৯৫০-এর দশক থেকেই হাঁদা-ভোঁদাকে নিয়ে অনিয়মিতভাবে একটি কমিক স্ট্রিপ বের হতো ‘শুকতারা’য়। সেখানে কথা ও ছবির জায়গায় থাকত একতি বোলতার ছবি। ১৯৬২ সালে ওই হাঁদা-ভোঁদাকে পরিমার্জন ও সংশোধন করেই নিয়মিত রচনা ও অলঙ্করণ শুরু করেন নারায়ণবাবু। হাঁদা-ভোঁদাকে নিয়ে তার করা প্রথম কাজটির নাম ছিল ‘হাঁদা ভোঁদার জয়’। আর সেই গল্পের বিষয়বস্তু ছিল ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ।এছাড়াও নারায়ণ দেবনাথ সৃষ্টি করেছিলেন ‘নন্টে ফন্টে’, ‘পটলচাঁদ দি ম্যাজিশিয়ান’, ‘বাহাদুর বেড়াল’, ‘ডানপিটে খাদু আর তাঁর কেমিক্যাল দাদু’ এবং ‘পেটুক মাস্টার বটুকলাল’-এর মতো অসাধারণ সব সৃষ্টি।

প্রথমদিকে তার চলার পথ খুব একটা মসৃণ ছিল না। মনের মতো কাজ তো দূর অস্ত, আঁকাআঁকি করে যে অন্তত খেয়ে-পরে টিকে থাকবেন, তেমন কোনো রাস্তাও খুঁজে পাচ্ছিলেন না।যতদিন মন ভরানোর মতো কাজ না পান, ততদিন প্রসাধন সামগ্রীর লোগো, মাস্টহেড আর সিনেমা কোম্পানির বিভিন্ন লিফলেটের কাজ করে যেতে লাগলেন। এরই ফাঁকে ত্রিবেণীর বাংলা অনুবাদেও করে ফেললেন একটি অলঙ্করণ। আর সেখান থেকেই শুরু। এরপরই শিল্পীর হাতে এসে পড়ল ‘শুকতারা’ পত্রিকা। বছর দুয়েকের মধ্যেই প্ত্রিকায় কাজের সুযোগও পেলেন তিনি।

কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ায় ‘শুকতারা’ পত্রিকার প্রকাশনা সংস্থা ‘দেব সাহিত্য কুটির’-এর নাম জানতে পারলেন। এরপর তার প্রুফ রিডারের সাহায্যে কর্ণধার সুবোধ মজুমদারের সাথে পরিচয় সারেন তিনি।  অবশ্য রত্ন চিনেছিলেন সুবোধবাবু। প্রথম দেখাতেই কাজের কথা পাড়েন তিনি। নারায়ণ দেবনাথও স্বপ্নের পথের প্রথম পদক্ষেপ ফেলেছিলেন অতি সতর্কভাবে। পেয়েছিলেন পারিশ্রমিকও। তারপর থেকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে।

‘হাঁদা ভোঁদা’ ছাড়াও নারায়ণবাবুর সৃষ্টির তালিকায় আছে আরো বেশ কিছু কালজয়ী কমিক স্ট্রিপ। এদের মধ্যে প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে ‘বাঁটুল দি গ্রেট’ এর। সময়টা তখন ১৯৬৫ সাল। ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের পটভূমিকায় বাঁটুলকে এনে ফেলেছিলেন স্রষ্টা নারায়ণ দেবনাথ।

শুরুতে বোধহয় কাহিনীর কাঠিন্যের কারণেই খুদে পাঠকরা তেমন একটা গ্রহণ করেনি বাঁটুলকে। কিন্তু সেই তারাই অল্প কিছুদিনের ব্যবধানে দারুণ ভালোবেসে ফেলল বাঁটুলকে। গোলাপি রঙের স্যান্ডো গেঞ্জি আর কালো হাফপ্যান্ট পরা, ৪০ ইঞ্চি বুকের ছাতি সমৃদ্ধ, কাঠির মতো সরু ও খালি পা-ওয়ালা বাঁটুলকে ভালো না বেসে কীভাবেই বা পারা যায়! তাছাড়া বাঁটুলের সাথে যে রয়েছে তাঁর দুই ভাগ্নে, ভজা ও গজাও।ব্যক্তিগতভাবে এই বাঁটুলকেই নিজের সবচেয়ে প্রিয় সৃষ্টি বলে মনে করেন নারায়ণবাবু।



এদিকে শুরুটা যে ‘হাঁদা ভোঁদা’কে দিয়ে, ১৯৬৯ সালে ঠিক তাদেরই আদলে তিনি তৈরি করেন ‘নন্টে ফন্টে’। ‘কিশোর ভারতী’ পত্রিকার জন্য সৃষ্ট এই কমিক স্ট্রিপের দুই কিশোর চরিত্র নন্টে-ফন্টে প্রথম দুই বছর হুবহু হাঁদা-ভোঁদার মতোই ছিল। কিন্তু ১৯৭২ সালে এসে অনেকটাই বৈচিত্র্য আসে তাদের চরিত্রে। এছাড়াও যোগ হয় নন্টে-ফন্টের হোস্টেল জীবন, হোস্টেল সুপারিনটেনডেন্ট আর কেল্টুদার মতো চরিত্র।

‘হাঁদা ভোঁদা’ যখন শুরু করেছিলেন, তখন বাংলা ভাষায় কমিকসের আবেদন প্রায় ছিল না বললেই চলে। অনেকটা একা হাতেই একটি জয়যাত্রার জন্ম দিয়েছিলেন নারায়ণবাবু, যা অব্যাহত থাকে তার পরের প্রতিটি সৃষ্টিতেই। বিশেষত ‘বাঁটুল দি গ্রেট’-এর মাধ্যমে বাংলাভাষী শিশুদের মাঝে কমিকপ্রীতির একটি অভূতপূর্ব জোয়ার আসে।

প্রথমদিকে কয়েকটি একই রকম চরিত্র নির্মাণের পর নারায়ণবাবু উদ্যোগী হন ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের চরিত্রদের নিয়েও পরীক্ষানিরীক্ষা চালাতে। যেমন- পটলচাঁদ চরিত্রটি (১৯৬৯ সালে সৃষ্ট) একজন জাদুকর, যে তার মেধা দিয়ে পাড়তো সব সমস্যার সমাধান করে। বাহাদুর বেড়াল (১৯৮২ সালে সৃষ্ট) খুবই অদ্ভূত ও বুদ্ধিমান একটি প্রাণী, যা তার নিজের জন্যই বারবার কাল হয়ে দাঁড়ায়। ডানপিটে খাদু আর কেমিক্যাল দাদুর (১৯৮৩ সালে সৃষ্ট) সাথে অনেকটাই সাদৃশ্য খুঁজে পাবেন মর্টি ও রিকের। বটুকলাল (১৯৮৪ সালে সৃষ্ট) নামের স্কুল শিক্ষকটি আবার খুবই পেটুক, যে সবসময় সুযোগ খোঁজে খাবার চুরির, কিন্তু ছাত্রদের কারণে তাঁর সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।

কয়েকটি কমিকসের মাধ্যমেও আলোড়ন তোলেন নারায়ণবাবু। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো গোয়েন্দা কৌশিক রায়কে নিয়ে তাঁর নিজের লেখা ১৪টি গল্পের ধারাবাহিক, এবং দিলীপ চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘ইন্দ্রজিৎ ও ব্ল্যাক ডায়মন্ড’ (১৯৭০)।

বাংলা সাহিত্যের জগতে বিশিষ্ট কমিকস শিল্পী হিসেবে নারায়ণ দেবনাথের অবদান বলার অপেক্ষা রাখে না। অবশ্য তাঁর অবদানের স্বীকৃতিও পেয়েছেন শিল্পী। মিলেছে সাহিত্য অ্যাকাদেমি পুরস্কার, এরপর একে একে পেয়েছেন , বিদ্যাসাগর পুরস্কার, বঙ্গবিভূষণ। পদ্মশ্রী পুরস্কারেও সম্মানিত হয়েছেন তিনি।

জাগতিক নিয়মে শিল্পীর মৃত্যু হয়। কিন্তু তাঁর শিল্পের মৃত্যু হয় না। আগামী দিনেও ছুটির নিরালা দুপুরে ফের খুদে পাঠকদের ঘরে ফিরে ফিরে আসবে নারায়ণ দেবনাথ সৃষ্ট চরিত্ররা। এই শোকের মধ্যে আপাতত এটুকুই সান্ত্বনা বাঙালির।

spot_img

Related articles

1+1=3: সুখবর শোনালেন পরিণীতি-রাঘব

বিয়ের পর থেকেই পরিণীতির (Pariniti Chopra) প্রেগনেন্সি নিয়ে নানা গুজব ছড়ায়। কখনও নায়িকার পোশাক বা কখনও স্বামী রাজনীতিবিদ...

কৃষ্ণনগরে বাড়ির দোতলায় উঠে প্রথমবর্ষের কলেজ ছাত্রীকে গুলি করে খুন!

বাড়ির দোতলায় উঠে প্রথমবর্ষের কলেজ ছাত্রীকে (College Student) গুলি (Fire) করে খুন। ঘটনায় তীব্র চাঞ্চল্য কৃষ্ণনগরে। সোমবার, দুপুর...

Petrol Diesel price: গোটা দেশে অপরিবর্তিত আজকের পেট্রোল-ডিজেলের দাম

২৫ অগাস্ট (সোমবার), ২০২৫ কলকাতায় লিটার প্রতি পেট্রোলের দাম ১০৫.৪১ টাকা, ডিজেলের দাম লিটার প্রতি ৯২.০২ টাকা দিল্লিতে লিটার প্রতি...

নুন চুরি! বিজেপি নেতার মদতে কোন্নগরে সক্রিয় নুন চুরি চক্র! তদন্তে পুলিশ

রাজ্যের শাসকদলের বিরুদ্ধে চুরির ‘ভিত্তিহীন’ অভিযোগে সরব হওয়া বিরোধী বিজেপির(BJP) নেতা-নেত্রীরাই চুরিতে অভিযুক্ত। সম্প্রতি সমাজ মাধ্যমে একটি ভিডিও...