Monday, November 10, 2025

‘অন্ধ কানাই পথের পরে’, উৎপল সিনহার কলম

Date:

Share post:

উৎপল সিনহা

ভিক্ষা ব্যবসা ছিল ও আছে । ভিক্ষা ব্যবসায়ী আছে । আছে আদি ভিক্ষাচক্র । সুবিশাল এই ভিক্ষাচক্রে ঘটে কত যে উত্থানপতন , ভাঙাগড়া , হিংসা , খুন , জখম , ধর্ষণ ও আত্মহনন । আবার বহুরূপী এই প্রাচীন বৃত্তিতে প্রেমও আসে মহাসমারোহে । শ্রাবণের পুঞ্জীভূত মেঘের মতো কখনও বা ঘনিয়ে ওঠে পূর্বরাগ , তারপর হয়তো বা গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে গাঢ় অভিমান , তিক্ত ও লবনাক্ত বিরহবেদন । অন্তিমে কখনও বা বিষাদ আঁধারে একলা পড়ে থাকে চিরবিচ্ছেদজর্জর মজ্জা।

এই যে তীব্র দহনজ্বালা ও আত্মধিক্কারের পাথর ছড়ানো রক্তমাখা সুদীর্ঘ অন্ধকার পথে জীবনভর চলার বাধ্যতা , এ কি সাধ করে কেউ বেছে নেয় ? আসলে সবটাই পেটের তাগিদ , পাপী পেট কা সওয়াল । আর , কে না জানে যে , একবার এই বাঁকা পথে ঢুকে পড়লে বেরোবার সব রাস্তা চিরতরে বন্ধ । এইভাবেই টলতে টলতে ঝলসে ঝলসে চলতে চলতে বিমর্ষতার ঘোর অন্ধকারে অন্তর বিদীর্ণ করে একদিন হঠাৎই বিদ্যুৎ চমকের মতো বেরিয়ে আসে সম্যক উপলব্ধির অনবদ্য আনন্দগান । তুড়ি মেরে ভিখারী গেয়ে ওঠে , ‘ একদা মনেতে বাসনা আছিল বুদ্ধিতে হবো পার … ‘ । গানে গানে মূর্ত হয়ে ওঠে দগ্ধ রহস্যাচ্ছন্ন ভিক্ষুকজীবন ।

মহামহিম নাট্যকার ব্রেটোল্ড ব্রেখটের ‘ দ্য থ্রি পেনি অপেরা ‘ অবলম্বনে ‘ তিন পয়সার পালা ‘ নাটকটি প্রযোজনা করেন আমাদের দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নট , নাট্যকার ও নির্দেশক মহামান্য অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় । অসম্ভব জনপ্রিয় এই নাটকটি বাংলা নাট্য-ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক ।

প্রাচীনকাল থেকেই মানবসমাজে ভিক্ষাবৃত্তি চলে আসছে । ভিক্ষা একটি সামাজিক সমস্যা ও অপরাধ । পৃথিবীর অনেক দেশেই তাদের প্রচলিত আইনে ভিক্ষা নিষিদ্ধ । সামাজিক জীবনে আমরা দেখতে পাই যারা ভিক্ষা করে তারা অসম্মানজনক , অবহেলিত ও তুচ্ছ জীবন যাপন করে । এটি একটি ঘৃণ্য সামাজিক সমস্যা । বিভিন্ন দেশের সরকার ভিক্ষাবৃত্তি নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পরেও এই বৃত্তি রমরম করেই চলছে , থামার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না । ভিক্ষুকদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও অনেকেই তাতে রাজি নয় । এমন পরিশ্রমহীন নিরাপদ পেশা তথা ব্যবসার আরাম ও স্বাচ্ছন্দ্য কেইবা সাধ করে ছাড়তে চায় ?

শারীরিক বৈকল্য যাকে পঙ্গু করে দিয়েছে এবং দেশের সরকার যার চিকিৎসা ও অন্নসংস্থানের দায় এড়িয়ে গেছে , সে যদি বাধ্য হয়ে জীবনধারণের জন্য ভিক্ষার পথ বেছে নেয় সেটা মেনে নেওয়া যায় । কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা কী দেখতে পাই ? কেউ অন্ধ সেজে , কেউ বোবাকালা ও পঙ্গু সেজে , কেউ কুষ্ঠরোগীর ছদ্মবেশে দিনের পর দিন মানুষকে বোকা বানিয়ে , ধোঁকা দিয়ে ভিক্ষা করতে থাকে । এরা বেশিরভাগই ভুয়ো । এদের বেশিরভাগই সম্পূর্ণ সুস্থ । আসলে প্রায় বিনা পরিশ্রমে মোটা আয়ের লোভ এরা সামলাতে পারে না । শহরে অনেক দালাল দেখা যায় যারা এই ভিখারীদের পরিচালনা করে । কেউ বা ভিখারীদের মহাজন । তারা বিভিন্ন জায়গা থেকে অসুস্থ বৃদ্ধবৃদ্ধা , হারিয়ে যাওয়া ছোট ছোট বাচ্চা , এমনকি অতি দরিদ্র বাবা-মায়ের কাছ থেকে তাদের সন্তানদের ক্রয় করে অথবা ভাড়ায় এনে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োগ করে । এই সমস্ত টাউট বাটপারদের জন্যই ভিক্ষাব্যবসা দিনেদিনে ফুলেফেঁপে উঠছে । এ এক বিচিত্র জটিল পেশা ।

কোনোরকম লেনদেন ছাড়া শুধুমাত্র অপরের দয়াদাক্ষিণ্য ও অনুগ্রহে অর্থ আদায়ের এই ফন্দি আদিকাল থেকেই চলে আসছে । বিনাশ্রমের এই নিয়মিত আয় বহু সুস্থসবল মানুষকেও আত্মমর্যাদাহীন অলস জীবনের দিকে ঠেলে দিয়েছে ।

এও ঠিক যে , অনেকেই প্রকৃত অর্থেই সর্বস্বান্ত হয়ে ভিক্ষায় নেমেছেন । কেউ বা নেমেছেন খুব সহজেই আয় করা যায় ব’লে । এছাড়াও রয়েছে ‘ বেগিং মাফিয়া ‘ , যারা বিভিন্ন উপায়ে নানা অপকর্ম করা ছাড়াও ভিক্ষুকদের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য গোপনে কাজ করে চলেছে ।

ভিক্ষুকেরা পথচারীদের যেমন বিব্রত করে , তেমনি বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডেও অংশগ্রহণ করে অনেকসময় জেনে অথবা না জেনে । ভিক্ষুকদের উৎসাহিত করার ক্ষেত্রে পুণ্যলাভপ্রার্থী সাধারণ মানুষের অবদানও কম নয় । পুণ্য অর্জনের লোভেই যে জনগণের দান খয়রাত , সেটা ভিক্ষুকেরা ভালোই জানে । মন্দির , মসজিদ , গির্জা ইত্যাদির আশেপাশে ভিক্ষুকদের দলেদলে দেখা যায় । দেখা যায় বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান উৎসবের দিনগুলিতে ভিক্ষাপাত্র হাতে অসংখ্য ভিক্ষুকদের সমাবেশ , কারণ , উৎসবের দিনে , পালাপার্বণের সময় মানুষের মন প্রসন্ন থাকে । তখন গরীব দুঃখীদেরকে কিছু দান করার ঔদার্য জাগে মানুষের মনে ।

আরও পড়ুন- রাজ্যপাল আনন্দ বোস কেন বিজেপির ক্যাডার নয়? ধনকড়ের অভাব অনুভূতি শুভেন্দুর

তবে হ্যাঁ , বিভিন্ন দেশের সরকারগুলির যদি প্রকৃত সদিচ্ছা থাকে , তাহলে ভিক্ষুকদের পুনর্বাসন ও ভিক্ষাবৃত্তি নির্মূল করার উদ্যোগ সফল হয়ে উঠতে পারে । তবে তার জন্য চাই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ।

 

 

spot_img

Related articles

ধর্মীয় বই কিনতে গিয়ে ২ কোটি টাকার প্রতারণার ফাঁদে কলকাতা ইসকন! গ্রেফতার ১ 

ধর্মীয় বই কেনার অর্ডার দিতে গিয়ে প্রায় ২ কোটি টাকার প্রতারণার শিকার হল কলকাতা ইসকন। অভিযোগ, অর্ডার অনুযায়ী...

বিশ্বকাপজয়ী মেয়ের সৌজন্যে হারানো পুলিশের চাকরি ফিরে পাচ্ছেন বাবা

কয়েকদিন আগেই আইসিসি একদিনের বিশ্বকাপ(ICC World Cup)  জিতেছে ভারতীয়  মহিলা দল। মেয়েদের সাফল্যে গর্বিত মা-বাবারা। তবে বিশ্বকাপজয়ী মেয়ের...

গ্যাস-সমস্যায় নিঃশ্বাসের পরীক্ষা: যুগান্তকারী আবিষ্কারে বিশ্বে স্বীকৃতি বাঁকুড়ার চিকিৎসকের

একটি সাধারণ সমস্যা, যাতে জর্জরিত বর্তমান যুবসমাজ থেকে শিশুরা পর্যন্ত। গ্যাস বা গ্যাসট্রাইটিসের মতো সমস্যা নির্ধারণ করার জন্য...

একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষক নিয়োগে বাড়তে পারে আসন সংখ্যা, জানালো এসএসসি 

রাজ্যের একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষক নিয়োগের ফলাফল ইতিমধ্যেই প্রকাশ করেছে স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি)। প্রকাশিত ফল অনুযায়ী,...