Sunday, November 9, 2025

‘আলোকিত ডিরোজিও’, উৎপল সিনহার কলম

Date:

Share post:

উৎপল সিনহা

মাত্র ২২ বছরের জীবন । অথচ কি সুদূরপ্রসারী অভিঘাত সেই স্বল্প আয়ুষ্কালের ! দীর্ঘকালের জমাট অন্ধকার ভেদ করে প্রকৃতির বুকে সহসাই যেমন দেখা দেয় কান্তিময় আশ্চর্য আলো , আর সে আলোয় ভেসে যায় আদিগন্ত চরাচর , তেমনই এক অপরূপ আলোর নাম ডিরোজিও ।

হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও । জন্ম কলকাতায় , ১৮০৯ সালের ১৮ এপ্রিল । আর , অকাল মৃত্যুও কলকাতাতেই , ১৮৩১ সালের ২৬ ডিসেম্বর । সেই হিসেবে এখন , এই এপ্রিল ডিরোজিওর জন্মমাস ।
পেশায় শিক্ষক ডিরোজিও ছিলেন কবি ও নৃত্যশিল্পী । তিনি স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন একজন যুক্তিবাদী ও চিন্তাবিদ হিসেবে । মৃত্যুর দীর্ঘকাল পরেও ছাত্রদের মধ্যে যাঁর উত্তরাধিকার বেঁচে ছিল , যাঁরা ইয়ং বেঙ্গল নামে পরিচিত ছিলেন এবং যাঁদের মধ্যে অনেকেই পরবর্তীকালে সমাজসংস্কার , আইন এবং সাংবাদিকতায় বিশিষ্ট স্থান দখল করেছিলেন ।
নব্যবঙ্গ দল গঠন তাঁকে ভারতের জাতীয়তাবাদের ইতিহাসে অমর করে রেখেছে । সাহিত্য , ইতিহাস , বিজ্ঞান ও দর্শনকে কেন্দ্র করে চিন্তক ডিরোজিওর ভাবনা ও আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল বহুধাবিস্তৃত । ছাত্রদের কাছে তাঁর আকর্ষণ ছিল দুর্বার । ছাত্রমহলে প্রবল জনপ্রিয় ছিলেন তিনি ।

আজ যখন আমাদের গোটা দেশটাই কুসংস্কারের আরাধনায় সদাব্যস্ত , যখন বিজ্ঞানের সাধনা থেকে মুখ ফিরিয়ে আছেন দেশের অধিকাংশ মানুষ , যখন অবিজ্ঞানে মজে আছে প্রায় গোটা জাতিটাই , যখন মনুষ্যত্বকে শাসন করছে ধর্ম ও জাতিভেদ , যখন প্রতি মুহূর্তে জীর্ণ লোকাচারে অবশ ও অচল একটা জাতি প্রায় দিশেহারা , এমন অবক্ষয়ের সময়ে ডিরোজিও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন কালের অনিবার্য নিয়মেই , আর , ডিরোজিও চর্চাও অনিবার্য হয়ে ওঠে ইতিহাসের অমোঘ আহ্বানে ।

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে হিন্দু কলেজের তরুণ অধ্যাপক ডিরোজিও তৎকালীন রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার কাণ্ডারী হিসেবে বাংলার সংস্কার আন্দোলনের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন । এই আন্দোলনের ফলে তাঁর অনুসারীদের মধ্যে অন্ধবিশ্বাস ত্যাগ করে যুক্তিবাদী ও সত্যানুসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে যা তৎকালীন ধর্ম ও সমাজ ব্যবস্থার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল ।

কলকাতার এক সচ্ছল পর্তুগিজ পরিবারে ডিরোজিওর জন্ম হয়েছিল । বাবা ফ্রান্সিস , মা সোফিয়া । মাত্র ৬ বছর বয়সে মাতৃহারা হন ডিরোজিও । আর , মাত্র সতেরো বছর বয়সে তিনি হিন্দু কলেজে যোগ দেন ইতিহাস ও ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে । কৈশোর থেকেই যুক্তিবাদী ডিরোজিও ছিলেন নিরীশ্বরবাদী । খ্রীষ্টান সুলভ আচরণ তিনি ত্যাগ করেছিলেন । তিনি যুক্তিবাদের অস্ত্রে প্রতিবাদ সংগঠিত করেছিলেন হিন্দু সমাজের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে । কোনো বিষয়ে মত স্থির করার আগে তার পক্ষে ও বিপক্ষে যত যুক্তি আছে সেগুলো জেনে বুঝে বিচার করতে হবে । এই শিক্ষাই ডিরোজিওর স্বল্পায়ু জীবনের সবচেয়ে বড় কীর্তি । আবেগ বর্জিত ও পক্ষপাতমুক্ত হয়ে নিজস্ব বোধবুদ্ধির ওপর পূর্ণ আস্হা রেখে যে কোনো বিষয়ের বিচার করতে হবে । বিচারের যুদ্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র বিতর্ক , এই ছিল তাঁর দর্শন । মনের জড়তাকে চিহ্নিত করতে হবে । অন্ধত্ব পরিহার করতে হবে । মুক্তচিন্তার অনুসারী হতে হবে । ঠিক-ভুল পরখ করার চর্চা সর্বদা অব্যাহত রাখতে হবে ।

হিন্দু কলেজকে ঘিরে ডিরোজিওর অবস্থান শুধু হিন্দু সমাজ নয় , সেই সময় আলোড়ন তুলেছিল কলকাতা কেন্দ্রীক সমস্ত ধর্মের সমাজে । তাঁর ছাত্রদের বলা হতো
‘ ডিরোজিয়ানস ‘ । তাঁর সংগঠন ইয়ং বেঙ্গল তো ছিলই , সাহিত্য ও বিতর্ক আলোচনার জন্য ১৮২৮ সালে তিনি তাঁর ছাত্রদের নিয়ে একটি সংগঠন ‘ অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন ‘ গড়ে তোলেন এবং সংগঠনের তরফ থেকে ‘ পার্থেনন ‘ নামে একটি পত্রিকাও বের করা হয় । সংঘর্ষের সূত্রপাত হয় এর পর থেকেই । পত্রিকার মাধ্যমে ডিরোজিও সমাজের তিনটি অন্ধকার দিক তুলে ধরেন :
এক , নারীশিক্ষা ও নারীস্বাধীনতা ছাড়া সমাজের অন্ধকার দূর করা অসম্ভব ।

দুই , সমস্ত ধর্মই অযৌক্তিক ।

তিন , বৃটিশ শাসনের কুফল ভোগ করছে দেশ ।
ফলে যা হবার তা হলো । তাঁর এই অনধিকার প্রবেশ ও চর্চাকে হিন্দু সমাজ ও বৃটিশ খ্রীষ্টান সমাজ কেউই মেনে নিতে পারলো না । সমাজের সব স্তর থেকে তুমুল আক্রমণ আসতে লাগলো ডিরোজিও ও তাঁর অনুগামীদের প্রতি ।

এর পরেই তিনি হিন্দু কলেজ থেকে বহিস্কৃত হন এবং প্রবল অর্থকষ্টে পড়েন । এই অবস্থাতেও তিনি সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্যে আন্দোলন গড়ে তোলা ও জাতীয়তাবোধের বিকাশ ঘটানোর লক্ষ্যে ‘ হেসপেরাস ‘ ও ‘ ক্যালকাটা লিটারেরি গেজেট ‘ নামে দুটি পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ শুরু করেন । তাঁর লেখা কবিতা ,
‘ ভারতবর্ষ , আমার স্বদেশের প্রতি ‘ , কবিতাটি পড়লে তাঁর গভীর দেশপ্রেমের পরিচয় পাওয়া যায় ‌।

আরও পড়ুন- রাজ্যে চোখরাঙাচ্ছে কো.ভিড! পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃ.ত্যুও

১৮৩১ , ২৬ ডিসেম্বর , কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মাত্র ২২ বছর বয়সে মারা যান ডিরোজিও । গির্জা ও খ্রীষ্টধর্ম সম্পর্কে তাঁর বিরুদ্ধ মতের কারণে পার্কস্ট্রিটের গোরস্থানে তাঁকে সমাহিত করতে বাধা দেওয়া হয় । গোরস্থানের ঠিক বাইরে তাঁকে সমাহিত করা হয় ।
হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও অন্ধকার ভারতবর্ষে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী আন্দোলনের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে এক অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করে গেছেন আজ থেকে দুশো বছর আগে , একথা ভাবলেই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে ।

 

 

spot_img

Related articles

পশ্চিমবঙ্গই সেরা পারফর্মার: এসআইআর-এ রাজ্যের সাফল্যে সন্তুষ্ট নির্বাচন কমিশন

রাজনৈতিক সংঘাত ও প্রশাসনিক টানাপোড়েনের মধ্যেও এসআইআর সংক্রান্ত সামগ্রিক কাজ এবং এনুমারেশন ফর্ম বিলির ক্ষেত্রে সবার আগে পশ্চিমবঙ্গ।...

রবিতেও ঠাকুরনগরে এলো অ্যাম্বুল্যান্স: ২১ অনশনকারীর মধ্যে অসুস্থ ৯

এসআইআর-এর প্রতিবাদে আমরণ অনশনে মতুয়া পরিবারের সদস্যরা। মতুয়া দলপতিদের অনশনের সিদ্ধান্তে সমর্থন জানিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন তৃণমূল সাংসদ মমতাবালা...

কংগ্রেসকেও সমর্থন করতে পারত RSS: অরাজনৈতিক সাজার চেষ্টা মোহন ভাগবতের!

একশো বছর উদযাপন ঘিরে রাতারাতি প্রচারের আলোয় অনেক বেশি করে আসছে আরএসএস। সেই সঙ্গে এবার প্রকাশ্যে হিন্দুত্ববাদী চিন্তাধারাকে...

সহপাঠীকে গুলি একাদশ শ্রেণির দুই ছাত্রের, ফ্ল্যাটে উদ্ধার অস্ত্রের সম্ভার

শনিবার রাতে গুরুগ্রামের সেক্টর ৪৮-এ এক অভিজাত আবাসনে ডিনারে ডেকে এনে সহপাঠীকে গুলি করার অভিযোগ উঠল একাদশ শ্রেণির...