” বুড়ো মানুষটি ডিঙি নৌকো নিয়ে খাঁড়ির কাছে একা একা মাছ ধরতো । ৮৪ দিন কেটে গেছে , একটা মাছও ধরতে পারে নি সে । ” পারাবার নাকি কাউকে ফেরায় না । কিন্তু ৮৪ দিন তো বড়ো কম নয় । এতদিন ধরে ধৈর্য্যের পরীক্ষা ! তাও এই বুড়ো বয়সে ? তাহলে কি হাল ছেড়ে দিয়ে বাড়ি ফিরে বিশ্রাম নেবেন তিনি ? তাঁর কি অবসর জীবন আছে ? আছে বিশ্রামের কোনো অবকাশ ?

বৃদ্ধ সান্তিয়াগো । সম্বল বলতে তাঁর আছে একটা ভাঙা নৌকো , আর ভাঙা একটা দেহ । দিনের পর দিন মাছ না পেলেও সমুদ্রে যেতে ভোলেন না তিনি। তাঁর মনে একরাশ স্বপ্ন , একদিন তিনি সমুদ্রের সবচেয়ে বড়ো ও সুন্দর মাছটি ধরবেন । এই হাল না ছাড়া মনোভাবই তাঁকে জিতিয়ে দেয় একদিন । ৮৫ তম দিনে তিনি ধরে ফেলেন এক বিশাল আকৃতির মাছ ।

‘ দ্য ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সি ‘ উপন্যাসের নায়ক সান্তিয়াগোর জীবনপণ লড়াই আমাদের নানাভাবে শিক্ষিত করে । লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে এখানেই সফল । Effort never dies , মনে মনে নিশ্চয়ই মানতেন সান্তিয়াগো । জানতেন শেষ নিঃশ্বাস অবধি আশা ছাড়া যাবে না । জানতেন সাফল্য ধরা দেবেই একদিন ।

বেঁচে থাকার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে চাই দুর্জয় সাহস । পরিস্থিতির অক্টোপাস আটদিক থেকে পেঁচিয়ে ধরে দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের শ্বাসরোধ করতে চায় প্রতিদিন , প্রতিমুহূর্তে । সারাজীবন চলতে থাকে সংগ্রাম । প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর খেয়ে না খেয়ে এই লড়াই করার অপরিসীম ক্ষমতা মানবসভ্যতার চিরকালের বিস্ময় ।

এই মহৎ উপন্যাস আমাদের বোঝাতে চায় মানুষের অপরাজেয় মনোভাব তাকে হারতে দেয় না । মানুষ নিজের ধ্বংস মেনে নেয় , কিন্তু পরাজয় মানতে চায় না কিছুতেই । সফলতা মানেই বিপুল রোজগার আর প্রভাবশালী হয়ে ওঠা নয় ।

সফলতা একটা দৃষ্টিভঙ্গি , যা সততা ও কঠোর পরিশ্রমের পাশাপাশি ছায়ার মতো চলতে থাকে । কারোর কাছে হাত পাতার দরকার নেই । কোনো আনুগত্য প্রদর্শন কিংবা মেরুদন্ড বিক্রির প্রয়োজন নেই । একটা আদর্শ , একটা মূল্যবোধ থাকা চাই । আর চাই সহজ সরল জীবন যাপন ।

সান্তিয়াগোর জীবিকার একমাত্র উৎস ছিল মাছধরা। অতি দরিদ্র এই মানুষটি কখনো অনাহারে , কখনও বা অর্ধাহারে দিন কাটাতেন । কিন্তু কখনোই ভেঙে পড়েন নি । কোনো বিদ্রুপে বিচলিত হন নি । একটুও সময় নষ্ট করেন নি তিনি । তাঁর মনে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল একদিন তাঁর স্বপ্ন পূরণ হবেই । তা বলে ভাগ্যের হাতে সব ছেড়েছুড়ে ঘরে বসে থাকেন নি এই লড়াকু বৃদ্ধটি । সুযোগ কখন এসে যায় কে বলতে পারে !
সুযোগের সদ্ব্যবহার করার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকতে হয় সবসময় । প্রতিটি ভোরে ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতেও কখনও নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করতেন না বুড়ো সান্তিয়াগো । কারোর প্রতি কোনো অভিযোগ ছিল না তাঁর ।বরং যা পেয়েছেন , যতটুকু পেয়েছেন তার জন্য তাঁর মনে ছিল অশেষ কৃতজ্ঞতা ।
প্রতিকূলতা যাঁর নিত্যসঙ্গী , এমনকি প্রতিকূলতা তাঁর বহু কষ্টের অর্জনকে কেড়ে নিলেও তিনি দমে যান না , হেরে যান না । এখানেই তাঁর বিজয় । এখানেই মানুষ অপরাজেয় । ৮৫ তম দিনে মাছের খোঁজে সান্তিয়াগো চলে যান দূর সমুদ্রে এবং গাল্ফ স্ট্রিমে বিশাল দৈত্যাকার এক মার্লিন মাছকে তিনি বঁড়শিতে

গাঁথতে সমর্থ হন । তারপর দু’দিন দু’রাত ধরে বিশাল আকৃতির মাছটিকে বাগে আনতে লড়াই করতে থাকেন তিনি । হারপুনে গেঁথে নৌকার একপাশে মাছটি রেখে তীরের দিকে ফিরতে শুরু করেন তিনি । কিন্তু তাঁর বহুদিনের কাঙ্ক্ষিত পুরস্কারটি ছিনিয়ে নিতে দলে দলে ছুটে আসতে থাকে হাঙরেরা । আবার শুরু হয় নতুন এক লড়াই । অবশেষে হাঙরদের বধ করে যখন রণক্লান্ত সান্তিয়াগো মাছটির দিকে তাকান , তখন দেখেন হাঙরদের ক্রমাগত কামড়ে মাছটির কঙ্কালটুকু অবশিষ্ট রয়েছে । বিধ্বস্ত ও পরিশ্রান্ত বৃদ্ধ সান্তিয়াগো কোনোরকমে ঘরে ফিরেই ঘুমিয়ে পড়লেন ।
ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখতে লাগলেন পরের দিনের । তাঁর মনে একরাশ প্রশান্তি । জয় এসেছে অবশেষে । তাঁর স্বপ্ন সফল । তিনি আবার স্বপ্ন দেখতে চান আগামীর । আবহমান মানুষের মহোত্তর উপলব্ধির প্রতীক সান্তিয়াগো নতুন জীবন সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে থাকেন । আরো বাঁচতে হবে , আরও আরও বাঁচতে হবে ।
আরও পড়ুন – গুজরাটে মহিলা পুলিশ আধিকারিককে খুন লিভ ইন সঙ্গী সিআরপিএফ জওয়ানের
_
_
_