
… সেদিন মরণ এসে
অন্ধকারে আমার জীবন
ভিক্ষা করে লয়ে যাবে …

ভিক্ষুকের রূপে মৃত্যু আসবে অন্ধকারে ? জীবনানন্দ কবি তো নানাভাবে বহুরূপে মৃত্যুকে দেখেছেন , লিখেছেন , সঙ্কেত রেখেছেন অজস্র অসামান্য উপমায় । সাধ করে কে আর মরতে চায়! মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে লেখেন রবি কবি । তিনিই আবার লেখেন , মরণ রে তুহুঁ মম শ্যাম সমান । মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জীবনকে বুঝতে চাওয়া মানুষের আবহমান অভ্যাস ।

কখনো চোরের মতো চুপিচুপি , আবার কখনও বা মৃত্যু আসে সাড়া জাগিয়ে রাজসমারোহে । তবে মৃত্যুর হাতে সহজে নিজেকে সঁপে দিতে রাজি ছিলেন না কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় । তিনি বলেন যদিও কালের নিয়মে মৃত্যু অনিবার্য , তবুও মৃত্যুকেও যেন একটা নির্দিষ্ট সময় অবধি অপেক্ষা করতে হয় । এলাম , দেখলাম আর জয় করলাম ধরনের সুবিধা তিনি মৃত্যুকে দিতে নারাজ ।

কবির সব কাজ সমাপ্ত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে মৃত্যুকে । মৃত্যুচর্চা মোটেও নেতিবাচক কিছু নয় । মৃত্যুচেতনা এসেই পড়ে । এও মানুষের জীবন উদযাপনের এক জরুরি অংশ । অনেক সহজ হয়ে ওঠে বেঁচে থাকা , যদি সঙ্গে থাকে মৃত্যুবোধ ।

কবি তথা জীবনানন্দ গবেষক গৌতম মিত্র অনুবাদ করেছেন জাপানি কবিদের লেখা মৃত্যু সংক্রান্ত কিছু কবিতা । এখন পাঠ করা যাক সে সব কবিতার কয়েকটি ।

যখন মারা যাব
আমি যা দেখব
ঢলঢলে ওই চাঁদ
( হায়াকুরি , ১৭২৭ , ৭২ বছর বয়সে মারা যাবেন )

জীবনে এমন একেকটা সময় আসে যখন মনে হয় মৃত্যুই সবচেয়ে বড় আশ্রয় । শ্রেয়তর । আর তখন কবিতার কাছে যাওয়া ছাড়া অন্য উপায় থাকে না ।

একটি চূর্ণ স্বপ্ন
তারা কোথায় যায়
ওই প্রজাপতিরা ?
( ইচিমু , ১৮৫৪ , ৫১ বছর বয়সে মারা যাবেন )

মৃত্যুর আগে লেখা জীবনের শেষ কবিতা এভাবেই খোদাই করে গেছেন জাপানি কবিরা। জীবনের শেষ মুহূর্তে একজন কবির মনপ্রকৃতি কেমন হতে পারে তা বোঝার চেষ্টা করা যেতে পারে এই কবিতাগুলো পাঠ করে ।

মৃত্যুর পরব —
কতক্ষণ এটি চলবে ?
লণ্ঠন উঁচুতে ঝোলানো
( চিরি , ১৭১৬ , ১৬ বছর বয়সে মারা যাবেন )

আহা , মাত্র ১৬ বছরের আয়ু নিয়ে পৃথিবীতে আসা এক কবি মৃত্যুকে দেখছেন পরব! উৎসব , মৃত্যুও এক উৎসব ! নিজের নিভে আসা আয়ু নিয়ে কিশোর কবি জানতে চান মৃত্যু পরবের আয়ু !
প্রান্তরের দিকে তাকাও ;
কোনও বাসগৃহ অবশিষ্ট নেই
শুধু কোকিলের কান্না
( বাকো , ১৭৫১ , ৬৫ বছর বয়সে মারা যাবেন )
আমার পৃথিবীতে
এখন বসন্ত এসেছে ;
বিদায় !
( বাইনেন , ১৯০৫ , ৮০ বছর বয়সে মারা যাবেন )
মৃত্যু মানে তো জীবনের সমাপ্তি উদযাপন । এই কথাটি বুঝতে আমাদের কত দেরি হয়ে যায় । অন্ধকার না থাকলে আলোর গতি কী হতো ভাবতে শিউরে উঠি ।
নাম ফিরিয়ে নিচ্ছি
যেই আমি পা রাখলাম
ফুলের এই অমরাবতীতে
( ইনসেকি , ১৭৬৫ , ৬৭ বছর বয়সে মারা যাবেন )
একটা সময় আসে যখন আমাদের নিঃস্ব হতেই হয় । নিঃস্ব না হলে পরমকে ছোঁয়া যাবে কীভাবে ?
পদ্ম ফুলের ওপর
ভোরের শিশির
ক্ষীণতর হচ্ছে
( ফুসো , ১৮৮৬ , ৪৭ বছর বয়সে মারা যাবেন )
আমি লিখি , মুছি , আবার লিখি , আবার মুছি , আর তখন একটি পপি ফুল ফোটে
( হোকুসি , ১৭১৮ তে মারা যাবেন )
ফুল ঝরানো সহজ
কিন্তু ফুল ফোটানো নয়
জীবন শিখতে হয় না
কিন্তু মৃত্যু শিখতে হয় ।
যখন তোমরা ধোঁয়া দেখবে
চিন্তা কোরো না
নিষ্ফলা জমিতে তারা
আগুন জ্বালিয়েছে
( বাইকা , ১৮৪৩ , ৭৯ বছর বয়সে মারা যাবেন )
পশ্চিম দিকে যাত্রা
যে পথে সকল পৃথিবী যায় ;
ফুলের মাঠ
( বাইসেকি , ১৭১৬ , ৬৭ বছর বয়সে মারা যাবেন )
আমি ভয় করবো না
ভয় করবো না
দু’বেলা মরার আগে
মরবো না ভাই
মরবো না
আরও পড়ুন – মুম্বই-পুনে এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনা, ২০টি গাড়িতে ধাক্কা মারল কন্টেনার!