দেবাশিস দত্ত, অফিসার ইন চার্জ, মানিকতলা থানা
“মা আসছেন, তাই আবার নাহয় একসাথে একযোগে নতুন করে বাঁচি আর একবার.. বহুবার।”
পুজো পুজো গন্ধ মানেই আবার নতুন করে বাঁচার তাগিদ, নতুন ভাবে চিন্তা আর মননের মেলবন্ধন, নতুন রূপে একসাথে উদযাপনের অঙ্গীকার। শৈশবের দিনগুলো মানেই আমাদের কাছে ছিল নটিবয় জুতোর মচ মচ আওয়াজ, মা দিদির নতুন শাড়ির গন্ধ, আমার ও বাবার পাড়ার সন্তোষ কাকুর টেইলারিং shop-এ ছিট কাপড়ের শার্ট প্যান্ট। সাথে ছিল cap বন্দুকের কম্পেটিশন, গ্যাস বেলুন আর নবমীর মেলা।

২০২৫-এর পুজো প্রায় একই রকম আমার কাছে। তবে ওই গ্যাস বেলুন, মেলা বা ক্যাপ বন্দুকের শুধু দর্শক আমি আর আমার দায়িত্ব সেই শিশুদের আর তাদের অভিভাবক দের সুরক্ষিত রাখা। তবে এতসবের মধ্যেও খারাপ লাগে যখন কোনও বাচ্চাকে আবদার না মেটাতে পারা বাবা-মা রাস্তায় কর্তব্যরত পুলিশকর্মীকে দেখিয়ে ভয় দেখান। অবাধ্য বাচ্চাকে সামলাতে না পেরে বলেন, “ওই যে পুলিশ আছে ধরিয়ে দেব”। তখন মনে হয় যাঁদের সুরক্ষার জন্য ৮-১০ ঘণ্টায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকি তাঁরা আমাদের ‘জুজু’ তৈরি করছেন। একটা অপরিণত মনে ছোট থেকেই পুলিশ (Police) সম্পর্কে বিরুদ্ধ ধারণা গড়ে উঠছে। তবে সবাই সেটা করেন না।

নতুন রং বেরঙের পোশাকের বদলে গায়ে ওঠে সাদা ধবধবে Uniform, পালিশ করা কালো জুতো আর ২৪× ৭ জেগে থাকার প্রস্তুতি। পরিবার তথা প্রিয়জনের সাথে পুজো না কাটানো অভ্যাস বহুদিন আগেই তৈরি হয়ে গেছে আমার বা আমাদের। উৎসবের সময় পরিবার থেকে দূরে থাকাটা অভ্যাস হয়ে যায়। মনে হয় সবাই কাজ করছে, দায়িত্ব পালন করছে, আর আমি বাড়িতে বসে থাকব! সেটা হতে পারে না। শুধু নিজের পরিবার নয়, দীর্ঘদিন পুলিশের (Police) দায়িত্ব পালন করতে করতে যে বিষয়টা ধমনীতে ঢুকে গেছে সেটা হল বৃহৎ পরিবারের ভাবনা। সেখানে যেমন নাগরিকরা রয়েছেন, তেমন না-মানুষরাও আছে। পুজোর সময় হয়তো অনেক আলো, অনেক শব্দে তারা ভয় পেয়ে লুকিয়ে থাকে। তাদের খাবার ব্যবস্থা করা হয়। সেটা করে এই মানিকতলা থানার আশেপাশে থাকা বাচ্চারাই। সহযোগিতা করি আমরা। এই শহরটাই যেন আমার বৃহৎ পরিবারের মতো লাগে এখন। ব্যক্তিগত খারাপ লাগা ভেসে যায় প্রাণের জোয়ারে, ভালোবাসার আবেগে। কচিকাচাঁদের কলতানে কখন রাত কেটে দিন, দিন থেকে রাত হয়ে যায় পুজোর সব কটা দিন, তার হিসেব বোধহয় শুধুই মা দূর্গা জানেন।

বহু মানুষ এই সময় রাস্তায় বেরোন-যাঁরা হয়তো তেমন অভ্যস্থ নন। কেউ আবার আসেন কলকাতার (Kolkata) বাইরে থেকে। তাঁদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার মোড়ে অস্থায়ী পুলিশ কিয়স্ক তৈরি করা হয়। যেখানে পদস্থ পুলিশ আধিকারিকরা থাকেন। এমনকী আমি নিজেও অনেক সময় গিয়ে সেখানে বসি। যে কোনও মানুষ- শুধু দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া বা সঙ্গীকে হারিয়ে ফেলার জন্যই নয়, যে কোনও রকম সমস্যায় তাঁরা এসে যদি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, আমরা তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা করি। সুবিধা হয়, খুব তাড়াতাড়ি মুভ করা যায়। এলাকায় যতগুলো পুজো হয় তার সব কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হয় হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ করে। এর ফলে কোনও অসুবিধে হলেই সাথে সাথে সেই খবর পুলিশের অভ্যন্তরীণ হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে দিয়ে দেওয়া হয়। ফলে সাহায্য পৌঁছতে দেরি হয় না।

মেঘের ভেলা, নীল আকাশ, কাশ বনে মিষ্টি হওয়ার হিল্লোল। মা আসছেন। যত ম্লান মুখের মেলা, যত অভাব অনুযোগ, যত রিক্ততার হাহাকার, সবই যেন শ্রাবণ ধারায় শিক্ত হয়ে নব কলবরে জেগে ওঠে শরৎ প্রারম্ভে, আগমনীর সাথে, মায়ের আহ্বান আর আবাহনে। আশার ডানায় ভর করে বাঙালি তার বাঙালিয়ানাকে আবার নতুন করে সমৃদ্ধ করে তোলার বাসনায় আর উন্মাদনায় ঢাকের তালে, কাঁশরের ছন্দে বরণ করে নেয় মৃন্ময়ী রূপের চিন্ময়ীকে। প্রতি পুজোর দশমীর সন্ধেবেলা মন ভারাক্রান্ত হয়ে আসে যখন ভাসানের ঢাকের বোল ভীষণ করুন হয়ে আসে, মণ্ডপের আলোগুলো আসতে আসতে নিভে আসে, অঞ্জলির বাসি ফুলগুলো কল্লোলিনীর স্রোতো ধারায় ভাসতে ভাসতে দৃষ্টির অগোচরে চলে যায়। সেই বিষাদের মুহূর্তেও আশার আলো নিয়ে আসে সেই আবছা কলরব “আসছে বছর আবার হবে ” আর প্রস্তুতি নিতে থাকি মায়ের অবর্তমানে এই শহর আর সমাজকে সুরক্ষিত রাখার। বুকের মাঝে শব্দ বুনি “আবার এসো মা ”

বাংলা এখন বিশ্ব বাংলা, বিশ্বজনীন। কলকাতার দুর্গাপুজো পেয়েছে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের তকমা। এইটাকে বাঁচিয়ে রাখার, এর সম্মান রাখার দায়িত্ব আমাদের সকলের। সেই সম্মান যেন আমরা রাখতে পারি। শারদীয়ায় এটাই আমাদের অঙ্গীকার।
শুভ শারদীয়া।

–

–

‘

–