
এ পৃথিবী একবার পায় তারে , পায়নাকো আর…
কার কথা ভেবে এমন অসামান্য পংক্তি লিখে গেছেন জীবনানন্দ?
গূঢ় এ আলোচনা শুরুর আগে গুরুর কিছু আশ্চর্য কাণ্ডকারখানা নিয়ে কথা বলে নেওয়া খুব জরুরি।
মহাগুরু কিশোর কুমার এমনিতেই গায়ক হিসেবে অননুকরণীয়। গীতিকার, সুরকার, অভিনেতা এবং পরিচালক হিসেবেও অবিস্মরণীয় । মানুষ কিশোর তো ধরাছোঁয়ার বাইরে। জীবনভর যতসব তথাকথিত উদ্ভট , বেহিসাবি, লাগামছাড়া কাজকারবার , অথচ শিল্পময়, ব্যতিক্রমী, স্বতন্ত্র ও বিরল। তিনি নিজে হাসতে হাসতে হাসাতে হাসাতে গলার যে কাজ ( হরকত, এ হরকত কিন্তু চূড়ান্ত ব্যতিক্রমী , একেবারে সিলেবাসের বাইরে ) করতেন, বিভিন্ন অভিব্যক্তি প্রকাশ করতেন আপাত অর্থহীন আওয়াজ দিয়ে , তা অন্য কারোর পক্ষে অসম্ভব। মূলত অসম্ভবের ছন্দেই জীবন কেটেছে তাঁর।

অসম্ভবের অপর নাম কিশোর কুমার। ১৯৭১ সালের চলচ্চিত্র ‘ পরায়া ধন ‘ । সঙ্গীত পরিচালক রাহুল দেব বর্মন।
এই ছবির একটা বিখ্যাত গান ‘ আও ঝুমে গায়ে… ‘ , গেয়েছেন কিশোর কুমার এবং আশা ভোঁসলে। এ গানের শুরুতেই রয়েছে অপ্রত্যাশিত চমক। ‘ আও ঝুমে ‘ বলার পরই ‘ গায়ে ‘- তে গলা ভেঙে ইয়োডেলিং করেছেন কিশোর। ভাবা যায় না শুরুতেই এই কাণ্ড! শোনা যায় সুরকার স্বয়ং চিন্তিত ছিলেন শুরুটা নিয়ে। কিন্তু সুরকারকে চমকে দিয়ে কিশোর যে অসম্ভব কাজটি করে গেলেন তার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিলেন না। শোনার পর স্বভাবতই মুগ্ধ, উত্তেজিত, উচ্ছসিত আর ডি বর্মন ।

ইওডেলিং ( yodeling , yodelling ) মানে হলো স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর ( chest voice) এবং উচ্চ বা ফলসেটো ( falsetto) কণ্ঠস্বরের মধ্যে হঠাৎ এবং দ্রুত পরিবর্তন করে গান গাওয়া বা শব্দ করা। এটি গানের শব্দ প্রক্ষেপণের বিশেষ একটি ধরণ যা সারা বিশ্বে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে ব্যবহৃত হয়। Yodeling করার সময় গায়ক বা বক্তা স্বাভাবিক নিচু পিচ-এর ( lower pitch) চেস্ট ভয়েস থেকে হঠাৎ করে উচ্চ ও তীক্ষ্ণ pitch -এর falsetto voice – এ চলে যান এবং আবার আগের জায়গায় ফিরে আসেন। এই কৌশলটি মূলত গান গাওয়ার একটি বিশেষ পদ্ধতি , যেখানে খুব দ্রুত সুরের পরিবর্তন ঘটে। শব্দটি জার্মান শব্দ ‘ jodein ‘ থেকে এসেছে, যার অর্থ জোরে উচ্চারণ করা।

স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর ভেঙে যখন কেউ উঁচু পিচ-এ চিকন স্বরে দ্রুত যাওয়া আসা করে গান গায়, সেটাই হলো yodeling , ইয়োডেলিং। এর মূল বিশেষত্ব পিচ ও কণ্ঠস্বর পরিবর্তন। কৃত্রিম স্বর এবং অস্বাভাবিক সুর ফলসেটোর মূল কথা।
সুইস পর্বত অভিযাত্রীদের অনুকরণে গান গাওয়া বা সাঙ্গীতিকভাবে কাউকে আহ্বান জানানো হয় এই কৌশলের সাহায্যে। এই গীতিময় ডাক যিনি দেন তিনি yodeller, ইওডেলার বা জোডেলার। ইউরোপে আলপাইন ইওডেলিং দীর্ঘকালের পরম্পরাগত একটি গ্রামীণ ঐতিহ্য , যা ১৮৩০-এর সময়ে থিয়েটার এবং সঙ্গীতের ক্ষেত্রে বিনোদন হিসেবে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এখনও সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া এবং দক্ষিণ জার্মানির লোকসঙ্গীতের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য এই ইওডেলিং-এর ব্যবহার। আল্পস পর্বতে ইওডেলিং ব্যবহার করতেন মূলত পশুপালকেরা , পশুদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং আলপাইন গ্রামগুলোর মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার জন্য।

পাহাড়ের পথে দীর্ঘ দূরত্বে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখার জন্য একটি তীক্ষ্ণ সুরেলা চিৎকার, যা একই সঙ্গে সাংকেতিক, যাকে বলা হয় লালিং ( lulling) , ইওডেলিং-এর মতোই জনপ্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ। হ্যারি হপকিনসন, ফ্রান্জ লাং , জিমি রজার্স প্রমুখ ইয়োডেলার বিশ্বখ্যাত। কিন্তু গুরুমারা বিদ্যা জানতেন আমাদের কিশোর কুমার। তিনি যাঁদের থেকে ইওডেলিং শিখলেন, তাঁদের চেয়েও অনেক ভালো ইয়োডেলিং করে সারা বিশ্বকে মুগ্ধ করে চলে গেলেন। কিশোরের মতো এত মেলোডিয়াস ইওডেলার এই পৃথিবীতে সম্ভবত আর জন্মাবেন না। শুধু তো ইওডেলিং নয়, নানা ধরনের তথাকথিত আজব, উদ্ভট আওয়াজ ও শব্দ তিনি বারবার নিয়ে এসেছেন তাঁর গানে এবং সেগুলো হয়ে উঠেছে সুরে ছোঁয়া হীরে। আর একই সঙ্গে এইসব আশ্চর্য মণিমুক্তো হয়ে উঠেছে গানের অনিবার্য, অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই জাদু, এই কৌশল , এই ইন্দ্রজালের কোনো উত্তরাধিকার নেই , সম্ভবত অত্যাশ্চর্যের কোনো উত্তরাধিকার হয় না বলেই।
ম্যায় হুঁ ঝুমঝুম ঝুমঝুম ঝুমরু, দেখা না হ্যায় রে সোচা না হ্যায়, চলা যাতা হুঁ, জিন্দেগী এক সফর হ্যায় সুহানা ইত্যাদি ইয়োডেলিং সমৃদ্ধ গানে এক অন্য, অনন্য কিশোরকে আমরা পাই , যা প্রকৃত অর্থে বিরলের মধ্যে বিরলতম। এ পৃথিবী একবার, শুধু একবার পায় তারে…

তাঁর ইয়োডেলিং গানের তালিকা কিন্তু বিশাল। যে গানগুলিতে সদা প্রাণবন্ত কিশোর তুমুল আনন্দের সপ্তম স্বর্গে হাত ধরে পৌঁছে দেন শ্রোতাদের।


_

_

_
_